হাতির সাথে এ কেমন নিষ্ঠুরতা!

  16-12-2017 08:20PM

পিএনএস ডেস্ক : চার বছরের আম্বিয়া। এই বয়সেই তাকে কামাই-রোজগারে নামতে হবে। তার আগে নিতে হবে তিন মাসের প্রশিক্ষণ। স্থানীয় ভাষায় এর নাম ‘হাদানি’।

এই আম্বিয়া আসলে একটি হাতিশাবক। হাতির খেলা বা শারীরিক কসরত দেখে মানুষ আনন্দ পায়। এই হাদানিই আম্বিয়াকে সেই বিনোদনের জন্য প্রস্তুত করবে। কিন্তু প্রশিক্ষণের নামে আম্বিয়াকে যে নিষ্ঠুরতার মধ্য দিয়ে যেতে হবে, তা জানলে বিবেকবান কেউ আর হয়তো হাতির মাধ্যমে বিনোদন নিতে চাইবেন না।

প্রশিক্ষণের জন্য মা লক্ষ্মীর কাছ থেকে আলাদা করা হয়েছে আম্বিয়াকে। কারণটা বললেন প্রশিক্ষক দলের প্রধান আবদুল মান্নান, ‘পশুদেরও আবেগ-অনুভূতি আছে। হাদানির সময় অনেক শারীরিক নির্যাতন সইতে হয়। মা কাছে থাকলে তা সহ্য করতে পারবে না। মানুষের ওপর আক্রমণ চালাতে পারে। তাই মাকে সরিয়ে রাখতে হয়।’

এই বয়সে মায়ের কাছ থেকে আলাদা করার মাধ্যমে আম্বিয়ার প্রতি নিষ্ঠুরতার শুরু মাত্র। আসল নিষ্ঠুরতা চলে এরপরই। এর মধ্যে রয়েছে পা ও গলায় দড়ি পরিয়ে বেঁধে রাখা, লাঠিপেটা এবং আহত অবস্থাতেই টেনে টেনে ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়ানো।

৮ ডিসেম্বর সকালে সরেজমিনে মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার সমাই বাজারে হাতিশাবক আম্বিয়ার ওপরে নিষ্ঠুরতার কিছু অংশ প্রত্যক্ষ করেন এই প্রতিবেদক। বাজারের পাশের একটি মাঠে উৎসুক লোকজনের ভিড়। মাঠের মাঝখানে গুঁড়ির সঙ্গে বাঁধা আছে আম্বিয়া। সামনে ও পেছনের পা এবং গলায় দড়ি পরানো।

প্রশিক্ষকেরা প্রথম পাঠ হিসেবে হাতিটিকে মানুষের ডাকে সাড়া দেওয়া শেখানোর চেষ্টায় ব্যতিব্যস্ত। একেকটা শব্দ করছেন; তাতে সাড়া না দিলে ছোট বাঁশের লাঠি দিয়ে পেটানো হচ্ছে। পিটুনির চোটে শৃঙ্খলমুক্ত হতে জোরাজুরি করছে আম্বিয়া। না পেরে শুঁড় ওপরে তুলে কাতরাচ্ছে সে। নির্যাতনে হাতিটির শরীরের বিভিন্ন স্থানে ক্ষত হয়ে গেছে।

একপর্যায়ে কাঠের গুঁড়ি থেকে হাতিটিকে ছাড়িয়ে নেন প্রশিক্ষকেরা। আহত অবস্থাতেই তাকে টেনে টেনে মাঠের চারপাশে ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়ানো হলো কিছুক্ষণ। এটাও প্রশিক্ষণের অংশ। হাতির সঙ্গে আশপাশের মানুষের ‘ভালো সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা’র চেষ্টা এটা।


নির্যাতনের ব্যাপারে জানতে চাইলে প্রধান প্রশিক্ষক আবদুল মান্নান বলেন, ‘দুষ্টুমি করলে, পড়া না পারলে স্কুলে বাচ্চাদেরও তো স্যাররা শাসন করেন। এইটাও সেই রকম বলা যায়। এইটা না করলে তারে (হাতি) পোষ মানাইমু কেমনে?’ প্রশিক্ষণকালে হাতির শরীরে ক্ষত সৃষ্টির বিষয়টি স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘পাহাড়ি গাছের লতাপাতা দিয়া মলম বানাই। পরে এইটা শরীরে লাগাইয়া দেই।

আস্তে আস্তে রোগ কমি যায়।’বেশির ভাগ মানুষই ‘হাদানি’ দেখতে এসেছে কৌতূহলবশত। তবে নিরীহ প্রাণীর প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ অনেকের মনে দাগ কেটেছে। এমনই একজন জুড়ী উপজেলা সদরের ব্যবসায়ী শাহ আলম। তিনি বললেন, ‘হাতির হাদানির কথা অনেক শুনেছি। কিন্তু আগে কখনো দেখিনি। এবার এলাম। তবে দেখে খুব কষ্ট লেগেছে।

কথায় আছে, বন্যেরা বনে সুন্দর আর শিশুরা মাতৃক্রোড়ে।’
এই প্রশিক্ষণে মান্নানের সহযোগী হিসেবে আছেন আরও পাঁচজন।

প্রশিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বৃহত্তর সিলেট ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বহুকাল ধরে পোষা হাতিকে নানা কাজে ব্যবহার করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে পাহাড় থেকে গাছ টেনে নামানো, সার্কাস ও বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে খেলা ও শারীরিক কসরত দেখানো।

এর জন্য প্রস্তুত করতে শৈশবেই হাতির ‘হাদানি’ করাতে হয়। বয়স্ক হাতির ক্ষেত্রে সেটা করা কঠিন হয়ে পড়ে। প্রশিক্ষণকালে হাতিকে আখ, খড়, কলাগাছ ও মিষ্টান্ন খাওয়ানো হয়। খাবারের ব্যয়ও অনেক। সেটা হাতির মালিক বহন করেন।

আম্বিয়ার মালিক শাহাব উদ্দিন আহমদ। তিনি পাশের বড়লেখা উপজেলার পূর্ব দক্ষিণভাগ গ্রামের বাসিন্দা ও স্থানীয় গোয়ালবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান। একসময় হাতির মাহুত (হাতি দেখাশোনার কাজ) ছিলেন শাহাব উদ্দিন। এখন ছয়টি হাতির মালিক।

শাহাব উদ্দিন মুঠোফোনে বলেন, বাপ-দাদার আমল থেকে তিনি বন বিভাগের অনুমতি নিয়ে হাতি পুষছেন। এখন ছয়টি হাতি আছে। এগুলো সার্কাসে ও পাহাড়ি এলাকার বড় বড় গাছের গুঁড়ি টানার কাজে ভাড়ায় দেন। এতে বেশ টাকা পান। আম্বিয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ট্রেনিংয়ে একটু-আধটু মার তো খেতে হবে। সব মালিকই হাতিদের এ রকম ট্রেনিং দেন।’

আম্বিয়ার মা লক্ষ্মী থাকে পাশের হাড়ারগজ সংরক্ষিত বনে। ৫ ডিসেম্বর থেকে আম্বিয়ার ‘হাদানি’ শুরু হয়েছে। চলবে আগামী ফেব্রুয়ারির শেষ পর্যন্ত। এই তিন মাসে তাকে ডাকে-কথায় সাড়া দেওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের খেলা, শারীরিক কসরত ও গাছ টানানো শেখানো হবে।

বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের মৌলভীবাজারের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মিহির কুমার দো বলেন, সরকারের নীতিমালা অনুযায়ী পোষা হাতিকে প্রশিক্ষণ দেওয়া যাবে। তবে প্রশিক্ষণকালে তাকে নির্যাতন করা যাবে না। এ ব্যাপারে মালিকদের সতর্ক করে দেওয়া হবে।
বন্য প্রাণী বিশেষজ্ঞ শরীফ খান মুঠোফোনে বলেন, মায়ের কাছ থেকে আলাদা করে শিশু-হাতির ওপর নির্যাতন চালানো মোটেও সমীচীন নয়। বিভিন্ন কাজে ব্যবহারের জন্য দেশে দেশে নির্যাতন ছাড়াই হাতিকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। সরকার যেহেতু হাতি পোষার অনুমতি দিয়েছে, সেহেতু তেমন উন্নত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে সরকারকেই।-প্রথম আলো

পিএনএস/জে এ /মোহন

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন