কী হচ্ছে পাবর্ত্য চট্টগ্রামে?

  21-04-2018 08:24AM


পিএনএস, খাগড়াছড়ি: পার্বত্য খাগড়াছড়ি জেলায় অনিবন্ধিত আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে খুন, গুম, অপহরণ, অগ্নিসংযোগ করাসহ অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানিতে ফের উত্তপ্ত হয়ে উঠছে পার্বত্য অঞ্চল। বিশেষ করে খাগড়াছড়ি জেলা। নিরাপত্তাহীনতায় এলাকার সাধারণ মানুষ। এ দিকে গতকাল দুপুরে খাগড়াছড়ি প্রেস ক্লাবে বাঙালি ছাত্র পরিষদ আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে উপস্থিত ছিলেন- বাঙালি ছাত্র পরিষদের নেতা নজরুল ইসলাম মাসুদ, রবিউল হোসেন ও বেলাল হোসেন। সংবাদ সম্মেলনে অপহৃত বাহারের স্ত্রী জোহরা আক্তার বলেন ‘তার স্বামীকে পাহাড়ি উপজাতি সন্ত্রাসীরা চার দিন ধরে গুম করে রেখেছে। পুলিশ প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ২২ এপ্রিলের মধ্যে তিন বাঙালি উদ্ধার না হলে ২৩ এপ্রিল খাগড়াছড়ি জেলায় সকাল-সন্ধ্যা হরতাল পালন করা হবে। খাগড়াছড়ি জেলায় প্রতিটি জেলায় রোববার বিক্ষোভ মিছিল এবং জেলা প্রশাসক বরাবরে স্মারকলিপি প্রদানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলেও সাংবাদিকদের জানানো হয়েছে।

স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে, আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল ইউনাইডেট পিপলস ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্টে (ইউপিডিএফ) ‘প্রসীত খীসা’, (ইউপিডিএফ গণতন্ত্র) ‘তপন বর্মা সমর্থিত’ এবং জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) ‘সন্তু লারমা’ ও ‘জেএসএস’ সংস্কার (এমএন লারমা সমর্থিত)। এই চার গ্রুপের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে ঘটছে একের পর এক খুন, গুম এবং অগ্নিসংযোগের মতো নৃশংস এসব ঘটনা। বাড়ছে অপহরণ।

সূত্র জানায়, গত রোববার রাত ৮টায় উভয়পক্ষের মধ্যে গোলাগুলিতে খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় তপন চাকমা (৪০) ও খাগড়াছড়ির দীঘিনালার সীমান্ত লাগায়ো রাঙামাটির বাঘাইছড়ির আট কিলোমিটার এলাকায় বিজয় চাকমা (৩০) নামে দু’জন নিহত হওয়ার খবর শোনা যায়। তবে ঘটনাস্থলে গিয়ে পুলিশ কোনো লাশ খুঁজে পায়নি বলে জানান, দীঘিনালা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শামসুদ্দিন ভূঁইয়া। অন্য দিকে বাঘাইছড়ি থানার ওসি আমির হোসেন জানিয়েছেন, জেলার ‘মারিশ্যা দীঘিনালা সড়কের আট কিলোমিটার এলাকায় একজন নিহতের খবর শুনে পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়। কিন্তু সেখানে কোনো লাশ খুঁজে পাওয়া যায়নি।’

১৬ এপ্রিল খাগড়াছড়ি জেলায় পানছড়ি উপজেলাতে বাবু চাকমা নামে এক এইচএসসি পরীক্ষার্থীকে পানছড়ি কলেজের সামনে থেকে অপহরণের চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে ছুরিকাঘাতে আহত করে পালিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। এ বিষয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি) খাগড়াছড়ি জেলা শাখার সভাপতি তপন চাকমা ও সাধারণ সম্পাদক অমল ত্রিপুরা এক বিবৃতিতে বলেছেন, বেলা ১টায় খাগড়াছড়ির, পানছড়ি কলেজে পরীক্ষার হলে ঢুকে ‘জেএসএস’ সংস্কারপন্থীরা পিসিপি কলেজ শাখার সদস্য ও এইচএসসি পরীক্ষার্থী বাবু চাকমাকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে জখম করেছে। পরে আশপাশের লোকজন এগিয়ে এলে সন্ত্রাসীরা পালিয়ে যায়।

খাগড়াছড়ি জেলার পানছড়ি থানার ওসি মো: মিজানুর রহমান ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, ‘পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের দুই অংশের বিরোধ নিয়ে ঘটনার সূত্রপাত। আহত বাবু চাকমাকে খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।’ এখনো খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তিনি।

১৬ এপ্রিল বিকেলে জেলা সদরের আপার পেরাছড়া এলাকায় সূর্য্য বিকাশ চাকমা (৪৫) নামে এক ব্যক্তিকে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। খাগড়াছড়ির শহরের স্লুইচ গেট এলাকার মৃত ফণি ভূষণ চাকমার ছেলে তিনি। সূর্য্য বিকাশ চাকমা গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে জেলা সদরের কমলছড়ি ইউনিয়ন থেকে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করেছিলেন।

নিহতের স্ত্রী রিপনা চাকমা জানান, ‘বেলা ২টায় তার সাথে আমার কথা হয়। তিনি দয়াল কুমার চাকমার বাড়িতে দাওয়াত খেতে গিয়েছিলেন।

দয়াল চাকমার স্ত্রী নিপু দেওয়ান বলেন, ‘দুপুরে সবাই মিলে এক সাথে খাচ্ছিলাম। হঠাৎ দু’টি বিকট শব্দ শুনতে পাই। প্রথমে ভেবেছি বাজি ফুটছে। পরে ঘর থেকে বের হয়ে দেখি উঠানে রক্তাক্ত অবস্থায় সূর্য্য মাটিতে পড়ে আছেন। আমরা কেউ ভয়ে কাছে যাইনি, পরে বিকেলে পুলিশ এসে তার লাশ উদ্ধার করে খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালে নিয়ে যায়।

ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন, খাগড়াছড়ির পুলিশ সুপার (এসপি) আলী আহম্মেদ খান ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এম এম সালাউদ্দিন। পুলিশ সুপার আলী আহম্মেদ খান জানান, কে বা কারা এ হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত তা এখনো জানা যায়নি। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

তবে এ ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে (ইউপিডিএফ) ‘প্রসীত খীসা সমর্থিত’ খাগড়াছড়ি জেলা ইউনিটের প্রধান সংগঠক সচিব চাকমা এক বিবৃতিতে বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে হানাহানিমুক্ত শান্ত পরিবেশ বজায় থাকুক, তা একটি ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী চায় না। জনগণের আন্দোলন বাধাগ্রস্ত করার হীন উদ্দেশে তাদের লেলিয়ে দিয়ে একটি গোষ্ঠী পার্বত্য চট্টগ্রামে আবার নতুন করে খুনখারাবিতে মেতে ওঠেছে। বিবৃতিতে বলা হয়, সংস্কারপন্থী বলে চিহ্নিত তিন সশস্ত্র সন্ত্রাসী সমাজকর্মী সূর্য্য বিকাশ চাকমাকে দয়াল চাকমার বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে বাড়ির উঠানে গুলি চালিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে পালিয়ে যায়।

একই দিন ১৬ এপ্রিল জেলার মহালছড়ি উপজেলাতে কাঠ ক্রয় করতে গিয়ে এখনো নিখোঁজ রয়েছেন মো: সালাহ উদ্দিন (২৮), মো: মহরম আলী (২৭) ও মো: বাহার মিয়া ড্রাইভার (৩০) নামে মাটিরাঙ্গা উপজেলার তিন বাঙালি যুবক। এ তিন যুবক কাঠ ক্রয় করতে মহালছড়ির মাইসছড়ি যাওয়ার পথে অজ্ঞাত সন্ত্রাসীরা অপহরণ করেছে বলে দাবি করে পৃথকভাবে এ ঘটনার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে খাগড়াছড়ি জেলা বিএনপি ও সমঅধিকার আন্দোলন।

অপর দিকে খাগড়াছড়ি জেলা বিএনপির এক বিবৃতি দিয়েছে। এখনো তাদের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি উল্লেখ করে অপহৃতদের জীবননাশের শঙ্কা প্রকাশ করে দ্রুত তিন বাঙালি যুবকের নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করেছেন খাগড়াছড়ি জেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য ওয়াদুদ ভূঁইয়া। তাদের উদ্ধারে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করে, পাহাড়ে এমন কর্মকাণ্ড, খুন, অপহরণ, চাঁদাবাজি, মুক্তিপণ আদায় বন্ধ করাসহ সশস্ত্র গ্রুপগুলোর কাছে থাকা অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের আহ্বান জানান তিনি।

পার্বত্য চট্টগ্রাম সমঅধিকার আন্দোলন জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক মো: মোশাররফ হোসেন স্বাক্ষরিত পৃথক বিবৃতিতে বলা হয়, সাম্প্রতিককালে পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী কর্তৃক গুম, খুন, অপহরণ ও চাঁদাবাজি বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষ আতঙ্কিত। সন্ত্রাসীদের কর্মকাণ্ড বন্ধ না হলে সবাইকে নিয়ে বৃহত্তর কর্মসূচির ডাক দেয়া হবে বলেও উল্লেখ করা হয়। এ ছাড়াও নিখোঁজ তিন বাঙালি যুবককে অপহরণ করা হয়েছে দাবি করে মাটিরাঙ্গায় বিক্ষোভ সমাবেশ করেছিল পার্বত্য বাঙালি ছাত্র পরিষদ।

১৭ এপ্রিল দুপুরে ‘সন্তু লারমা সমর্থিত’ যুব সমিতির পানছড়ি শাখা অফিস আগুন দিয়ে পুড়ে দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনার জন্য প্রতিপক্ষ ইউপিডিএফকে দায়ী করেছে জেএসএস।

১৮ এপ্রিল বেলা সাড়ে ১০টায় পাহাড়ে জ্বালানি কাঠ আনতে গেলে লাশ দেখতে পেয়ে পুলিশে খবর দেন স্থানীয়রা। পরে মাটিরাঙ্গা উপজেলার দুর্গম ভাঙামুড়া এলাকা থেকে নতুন কুমার ত্রিপুরা (৩৫) নামে ওই ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।

খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা থানার ওসি মো: জাকির হোসেন ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, নিহত ব্যক্তি মাটিরাঙ্গার গোমতি ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের পূর্ণ কুমার ত্রিপুরার ছেলে। তিনি গত ১৫ এপ্রিল থেকে নিখোঁজ ছিলেন বলে জানা গেছে। কে বা কারা কি কারণে তাকে খুন করেছে রহস্য জানার চেষ্টা করছি। তবে ইউপিডিএফের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

খাগড়াছড়ি পুলিশ সুপার আলী আহম্মদ খান জানিয়েছেন, খাগড়াছড়ি জেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো আছে কোনো সমস্যা নেই।
বাঙালি তিন কাঠ ব্যবসায়ী অপহরণের বিষয়ে বলেন, তাদের কেউ জোর করে অপহরণ করে নিয়ে যায়নি। তারা স্বেচ্ছায় ব্যবসার কাজে সেখানে গেছেন। আমরা খোঁজখবর নিচ্ছি। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাদের উদ্ধার করা হবে।

পাহাড়ের আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোর সাম্প্রতিক ঘটনার বিষয়ে তিনি বলেন, এটি তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার, তবে এ বিষয়গুলো নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতায় দোষীদের গ্রেফতারে প্রশাসনের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

তবে, খাগড়াছড়ির মহালছড়িতে কাঠ ক্রয় করতে গিয়ে নিখোঁজ তিন বাঙালি যুবককে উদ্ধারের দাবিতে খাগড়াছড়িতে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল করেছে পার্বত্য বাঙালি ছাত্রপরিষদ। ১৯ এপ্রিল দুপুর ১২টায় জেলা শহরের চেঙ্গি স্কয়ারে এ মানববন্ধন করেন তারা। নিখোঁজ যুবকদের উদ্ধারে প্রশাসনকে ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম দেয়া হয় মানববন্ধন থেকে।

পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন