সরকারের কাছে হাওরবাসীর দাবি আশ্রয় কেন্দ্রের

  26-05-2018 01:55PM


পিএনএস, সিলেট প্রতিনিধি: বিশ্বের সবচাইতে বজ্রপাতপ্রবণ এলাকাগুলোর মধ্যে অন্যতম সুনামগঞ্জ। এ অঞ্চলের অধিকাংশ এলাকাই উন্মুক্ত হওয়ায় বজ্রপাতে নিহতের তালিকাও বেশ লম্বা। গত দুই মাসেই বজ্রপাতে এই হাওর জেলায় প্রাণ হারিয়েছে ৩২ জন।

এ অবস্থায় বজ্রপাত থেকে মানুষদের রক্ষা করতে তালগাছ লাগানোর একটি পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে প্রশাসন। জেলা প্রশাসক মো. সাবিরুল ইসলাম জানান, সুনামগঞ্জে ৩০ হাজার তালগাছ লাগানো হয়েছে।

কিন্তু, একটা তালগাছ বড় হতে ২০ থেকে ৩০ বছর লাগে। তাই, এই সময়ে বা আগামী বছরগুলোতে মানুষ বজ্রপাত থেকে কিভাবে রক্ষা পাবে- সেটাই দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে হাওরবাসীর জন্য।
‘তালগাছ বড় হতে হতে মানুষ মরে সাফা’

‘হাওর বাঁচাও, সুনামগঞ্জ বাঁচাও’ আন্দোলনের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা বজলুর মজিদ চৌধুরী বলেন, ‘সুনামগঞ্জের বজ্রপাত, হাওর এলাকার জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বজ্রপাত শুরু হলে প্রায় প্রতিদিনই মানুষ মরছে। তাই মানুষকে বাঁচাতে তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রশাসন তালগাছ লাগানোর মত দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার কথা বলছেন। কিন্তু কবে তালগাছ বড় হবে, কবে কী হবে। আর তালগাছ বড় হতে ২০ থেকে ৩০ বছর সময় লেগে যাবে। তাহলে কি এই সময়ের মধ্যে মানুষ মরে সাফ হয়ে যাবে? আমরা দেখেছি, কক্সবাজারে মানুষকে ঘূর্ণিঝড় থেকে বাঁচাতে যেভাবে আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে, ঠিক একইভাবে সুনামগঞ্জে মানুষকেও বাঁচাতে আশ্রয়কেন্দ্রের কোনো বিকল্প নেই।’

বজ্রপাতে নিহতদের পরিবার, প্রত্যক্ষদর্শী ও আহতদের কাছ থেকে জানা যায়, সচেতন থাকার পরেও নিরাপদ জায়গায় যাওয়ার আগেই বজ্রপাতের শিকার হচ্ছেন কৃষকেরা। আর অধিকাংশ জায়গা উন্মুক্ত ও কোনো আশ্রয়স্থল না থাকায় দ্রুত নিরাপদ স্থানে যেতেও পারছেন না তারা। ফলে বজ্রপাত আতংকে এখন ফসলের মাঠে যেতে চাইছেন না অনেক কৃষক। দাবি জানাচ্ছেন, হাওড়াঞ্চলে আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের।

একইসঙ্গে বজ্রপাত নিরোধক টাওয়ার স্থাপনের দাবিও তুলেছেন কৃষকেরা। বজ্রপাত নিরোধক টাওয়ার হলে বেশিরভাগ সময় টাওয়ার বজ্রপাত টেনে নেয়।

‘আমরা জায়গা দিব, তাও আমাদের বাঁচান’
সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার খরচার হাওরপাড়ের কৃষক স্বপন কুমার দেব বলেন, ‘আমার ৩৬ কেয়ার জমিতে বোরো ধানের আবাদ করেছিলাম। কিন্তু এ বছর বজ্রপাত আতঙ্কে কৃষক ক্ষেতে যেতে চায়নি। গত দুই-তিন দিনে পাঁচজন বজ্রপাতে মারা গেছে। সত্যি কথা বলতে বজ্রপাত শুরু হলে আমি নিজেও খেতে নামতে চাই না। তাই জোর করে অন্য কাউকে কী করে নামতে বলি? কারণ বজ্রপাত শুরু হলেই মারা যাওয়ার ভয় থাকে। তাই, আমরা সরকারের কাছে মিনতি করে বলি আমাদের বাঁচাতে হাওরে হাওরে আশ্রয়কেন্দ্র স্থাপন করে দেন। যাতে বজ্রপাত শুরু হলে আমরা আশ্রয়কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে জীবন বাঁচাতে পারি। দরকার হলে সরকার আমাদের কাছ থেকে জায়গা নিক। আমরা জায়গা দিব। তারপরও আমাদেরকে বাঁচান।’

বজ্রপাতে আহত সুজন মিয়া (২১) জানান, তিনি তাহিরপুর উপজেলার শনির হাওরে কাজ করছিলেন। হঠাৎ ঝড়ো বৃষ্টির সঙ্গে বজ্রপাত শুরু হয়।এ অবস্থায় তিনি বজ্রপাত থেকে বাঁচতে নিরাপদ স্থানের উদ্দেশে যাওয়ার পথে বজ্রপাতে আহত হন। বজ্রপাত সুজন মিয়ার নাভির নিচে আঘাত করে। এই আঘাতে তার কোমড়ের নিচের অংশ পুড়ে যায়। তিনি বলেন, ‘কয়েকদিন ধরে ভাল মত প্রস্রাবও করতে পারছি না।’

খরচার হাওরপাড়ের রাধানগর গ্রামের মো. আব্দুল আব্দুল মজিদ (৬০) বলেন, ‘আমরা সারাদিন হাওরে কাটাই। এখন এই হাওরই মরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেখানে আমরা বেঁচে থাকার জন্য কাজ করি সেই হাওরই এখন আমাদের মরণফাঁদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই সরকার আমাদের কথা চিন্তা করে যেমন শত শত কোটি টাকা খরচ করে হাওরে ফসল রক্ষা বাঁধ দিয়েছে, আমাদের বাঁচাতেও সরকার হাওরে আশ্রয়কেন্দ্র স্থাপন করে দিবেন।’

‘এখন যদি একটা আশ্রয়কেন্দ্র থাকতো’
কৃষাণী রওশন আরা (৫০) বলেন, ‘ধান কেটে আনার পর আমরা খলাতে সারাদিন ধান শুকাই। দেখা গেছে, বজ্রপাত শুরু হলে আমরা খলাতে থেকেও জানে বাঁচতে পারি না। গত দুই দিন আগে খলাতে ধান শুকাতে গিয়ে আমার পাশের ঘরের একজন মারা গেছে। তাই, এখন যদি একটা আশ্রয়কেন্দ্র থাকত, ঝড়-বৃষ্টি, বজ্রপাত শুরু হলে আমরা ওই সময়টাতে গিয়ে দাঁড়াতে পারতাম।’
কৃষক আব্দুল গণি (৪৫) বলেন, ‘শুধু ঝড়-বৃষ্টি কিংবা বজ্রপাতে নয়, দেখা গেছে, আমরা প্রচণ্ড গরমের মধ্যেও হাওরে প্রায় দিনের বেশির ভাগ সময় কাজ করি। যদি হাওরে আশ্রয়কেন্দ্র থাকে, ওই আশ্রয়কেন্দ্রে বসে একটু পানি খেয়ে জিরিয়ে নিতে পারব। এমনকি নৌকা ডুবি বা যেকোনো ধরনের সমস্যা হলে আমরা সেখানে আশ্রয় নিতে পারব।’

‘আমরা খুব ভয়ের মধ্যে থাকি’
হাওর পাড়ের জেলে গফুর মিয়া (৫০) বলেন, ‘সরকারের কাছে দাবি করছি, একটি আশ্রয়কেন্দ্র করে দেন। কিছু লাগবে না শুধু উপরে ছাদ দিয়ে কয়েকটা পিলার দিয়ে হলেও চলবে। আমরা খুব ভয়ের মধ্যে থাকি।’

হাওর আন্দোলনের নেতারাও একই কথা বলছেন। তারা বলেন, যেহেতু প্রাকৃতিক পরিবেশ নিয়ন্ত্রণে কারো কোনো হাত নেই। প্রাকৃতিক পরিবেশকে বশে আনাও সম্ভব না। তাই হাওরে মৃত্যু ঝুঁকি কমাতে এবং মানুষের নিরাপত্তার জন্য হাওরে হাওরে আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের দাবি জানান তাঁরা।

এদিকে, বজ্রপাতে শুধু মানুষ না, ওই অঞ্চলের হাওরে ও খোলা মাঠে থাকা গবাদি পশুও মারা যাচ্ছে। গত চার বছরে সুনামগঞ্জে গড়ে ২৫ জনেরও বেশী মানুষ বজ্রপাতে মারা গেছেন। এই ধারাবাহিকতায় শুধু গত দুই মাসে সুনামগঞ্জে ৩২ জন নারী-পুরুষ মারা গেছেন। আর মে মাসের প্রথম ১০ দিনে ১৯ জন মানুষ বজ্রপাতে মারা গেছেন। আহত হয়েছেন আরও শতাধিক।

প্রায় ৩০ লাখ মানুষের জেলা সুনামগঞ্জ। এই জেলার চার ভাগের তিন ভাগ এলাকাই মুক্ত হাওর। আছে ছোট বড় নদ-নদীও। সুনামগঞ্জের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে হাওর থাকায় এখানকার জীবন-জীবিকা হাওরনির্ভর। সেই সঙ্গে বোরো ধান তুলে নেওয়ার পর হাওরে ও নদীতে পানি বেড়ে গেলে, তখন জীবিকা নির্বাহ করা হয় মাছ ধরে।

দেখা গেছে, কৃষকেরা দিনে এবং রাতের ১৫ থেকে ১৬ ঘণ্টারও বেশি সময় হাওরে ধান কাটতে-শুকাতে, আর না হয় নদীতে মাছ ধরে কাটান। তাই, কৃষি বাঁচাতে, কৃষককে বাঁচাতে আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ এখন হাওড়াঞ্চলের মানুষের প্রাণের দাবি।

পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন