খুলনার কালাবগির নতুন নাম ‘ঝুলনপাড়া’

  27-05-2018 09:40AM


পিএনএস, খুলনা প্রতিনিধি: ঘূর্ণিঝড় আইলার আঘাতে ২০০৯ সালের ২৫ মে প্রবল জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হয় খুলনার দাকোপ ও কয়রা এলাকা। জলোচ্ছ্বাস থেকে বাঁচতে সেই সময় বেড়িবাঁধে টং ঘর পেতে বসবাস শুরু করে দাকোপের কালাবগি এলাকার বিপন্ন মানুষেরা। গত ৯ বছরেও আইলার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারেননি তারা। ফিরে যেতে পারেননি নিজেদের আগের ঠিকানায়। টং ঘরেই চলছে তাদের ঘর-সংসার। আর এসব টং ঘরের কারণেই ধীরে ধীরে কালাবগির নতুন নাম হয়ে গেছে ‘ঝুলনপাড়া’।

দাকোপ উপজেলা প্রশাসনের তথ্য মতে, আইলায় দাকোপ উপজেলার ২৯ হাজার ১৩২টি পরিবারের এক লাখ তিন হাজার ৭০০ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এছাড়া, তিন হাজার ২৮০ একর আবাদি জমি, ৩৩ হাজার ৪১৬টি বসতবাড়ি, ২৩৯টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ৫৬৩ কিলোমিটার রাস্তা এবং ১১৮ কিলোমিটার ওয়াপদা বেড়িবাঁধ সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গবাদিপশু ও অন্যান্য সহায় সম্পদ মিলে ক্ষতির পরিমাণ ছিল হাজার কোটি টাকার বেশি। ৯ বছর পরও আইলা আক্রান্ত এই এলাকার মানুষের চোখে-মুখে হতাশার ছাপ।

দাকোপের আইলা আক্রান্ত কালাবগির ৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডের একটি এলাকার কয়েকশ’ মানুষ বেড়িবাঁধের ওপরে এবং বাঁধ ঘেঁষে টং ঘর নির্মাণ করে আছে। তারা অনেকটা নদীর চরে ঝুলে বসবাস করছে। তাই এলাকাটির নাম হয়েছে ‘কালাবগি ঝুলনপাড়া’। এই ঝুলনপাড়ার একটি অংশ কালাবগি ৯ নম্বর ওয়ার্ডের বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো। চারপাশে কোনও বাঁধ নেই। কোনও রকমে টং ঘর তুলে রাখা হয়েছে। নদীতে জোয়ার আসলে সাঁতার কেটে মূল ভূ-খণ্ডের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতে হয়। স্কুলগামী শিক্ষার্থীদের কখনও নৌকায় চড়ে, অথবা বই-খাতা হাতে নিয়ে সাঁতরে পারাপার হতে হয়। স্বাভাবিকের চেয়ে নদীর পানি একটু বাড়লেই তাদের জীবন হুমকির মুখে পড়ে।

কালাবগি ৯ নম্বর ওয়ার্ডের বিচ্ছিন্ন দ্বীপাঞ্চলের বাসিন্দা হারুন সানা বলেন, ‘এখানে বেঁচে থাকা এখন দায় হয়ে উঠেছে।’ গৃহবধূ আনোয়ারা বেগম বলেন, ‘হয় সৃষ্টিকর্তা আমাগে তুলে নিয়ে যাক, না হয় আমরা এদেশ ছাইড়ে অন্য কোনও জাগায় চলে যাবো, আর সহ্য হয় না।’

দাকোপ উপজেলা চেয়ারম্যান শেখ আবুল হোসেন বলেন, ‘সাধারণ বাঁধ শিপসা নদীর ভাঙন থেকে ওই অঞ্চলকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হওয়ায় সরকার বিশ্বব্যাংকের মাধ্যমে উপযুক্ত বাঁধ নির্মাণের কাজ করছে। আশা করছি, এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে দুর্যোগ ঝুঁকি অনেকাংশে কেটে যাবে।’

তিনি জানান, কয়রা উপজেলার দক্ষিণ বেদকাশী, উত্তর বেদকাশী, কয়রা সদর ও মহারাজপুর ইউনিয়নের পাউবোর বেড়িবাঁধের ওপরেও কয়েকশ’ মানুষ সেই থেকে ঝুপড়ি ঘর বেঁধে বসবাস করছে। মাথা গোঁজার ঠাঁই না পেয়ে শত কষ্টের মধ্যে দিয়ে বেড়িবাঁধকে আঁকড়ে রেখেছে তারা। আইলার ৯ বছর অতিবাহিত হলেও পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপকূল রক্ষা বেড়িবাঁধগুলো এখনও সংস্কার হয়নি। সামান্য ঝড় কিংবা বৃষ্টিতে ঝুঁকির মধ্যে থাকতে হচ্ছে এ জনপদের কয়েক লাখ মানুষকে। এ মুহূর্তে উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) দুটি পোল্ডারে কমপক্ষে ২১ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ঝুকিপূর্ণ রয়েছে। বাঁধের ঝুকিপূর্ণ স্থানগুলো হলো— মহারাজপুর ইউনিয়নের লোকা, পূর্ব মঠবাড়ি, দশাহালিয়া, কয়রা সদর ইউনিয়নের গোবরা, গুড়িয়াবাড়ি স্লুইস গেট এলাকা, চার নম্বর কয়রা লঞ্চঘাট, মহেশ্বরীপুর ইউনিয়নের বানিয়াখালী, হড্ডা খেয়াঘাট এলাকা, তেঁতুল তলার চর ট্রলার ঘাট এলাকা, উত্তর বেদকাশী ইউনিয়নের গাতিরঘেরি, কাশিরহাট ও গাববুনিয়া এলাকা এবং দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের চরামুখা, মাটিয়াভাঙ্গা, জোড়শিং ও ছোট আংটিহারা এলাকা। এর মধ্যে ১৩-১৪/২ নম্বর পোল্ডারে লোকা ও পুর্ব মঠবাড়ি এলাকায় সাড়ে তিন কিলেমিটার এবং ১৪/১ নম্বর পোল্ডারে চার নম্বর কয়রা লঞ্চঘাট, গোবরা, ঘাটাখালী, গুড়িয়াবাড়ি স্লুইস গেটের পূর্ব পাশে, জোড়শিং চরামুখা, মাটিয়াভাঙ্গা ও ছোট আংটিহারা এলাকার সাত কিলোমিটার বাঁধ অধিক ঝুকিপূর্ণ।

দক্ষিণ বেদকাশীর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শামসুর রহমান জানান, কয়েকদিন আগে তার ইউনিয়নের জোড়শিং বাজারের বেড়িবাঁধ ভয়াবহ ভাঙনের কবলে পড়ে। সেই থেকে ওই এলাকার মানুষ এখনও নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে। স্থানীয়ভাবে বাঁধ রক্ষায় কাজ করা হলেও পাউবো কর্তৃপক্ষ কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছে না।
পাউবোর আমাদী সেকশন অফিসার মসিউল আবেদিন বলেন, ‘ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধ সংস্কারের বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।’ কয়রা উপজেলা নির্বাহী অফিসার শিমুল কুমার সাহা বলেন, ‘বেড়িবাঁধ, সুপেয় পানিসহ যেসব সমস্যা আছে, তা সমাধানের জন্য সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।’

উপজেলা চেয়ারম্যান আ খ ম তমিজ উদ্দিন বলেন, ‘নদী ভাঙন বা বেড়িবাঁধগুলো স্থায়ীভাবে সংস্কার করার জন্য ইতোপূর্বে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে একাধিকবার জানানো হয়েছে।

পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন