১৭ নভেম্বর ‘নান্দাইল শহীদ দিবস’মুক্তিযুদ্ধে নান্দাইলের শহীদদের বীরত্বপূর্ণ আত্মত্যাগের দিন

  16-11-2018 09:43PM

পিএনএস, ময়মনসিংহ প্রতিনিধি : ১৯৭১ সালের ১৭ নভেম্বর রক্তঝরা এই উত্তাল দিনগুলোতে ময়মনসিংহের নান্দাইল থানাকে শত্রুমুক্ত করার শপথ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা প্রায় তিন মাস আগে থেকে বিভিন্ন কোম্পানী কমান্ডারগণের সাথে একাধিকবার একত্রিত হয়ে প্রস্তুতি নিতে থাকেন। ‘৭১ এর ১৭ নভেম্বর শব-ই-ক্বদরকে সামনে রেখে মুক্তিযোদ্ধারা নান্দাইল থানাকে শত্রু মুক্ত করতে প্রায় সাড়ে চার ঘণ্টা তুমুল যুদ্ধের পর হানাদারদের ভারী অস্ত্রের সামনে টিকতে না পেরে পিছু হটতে বাধ্য হয়। এ সময় মুক্তিযোদ্ধা ইলিয়াস উদ্দিন ও শামছুল হক শহীদ হন। পরে হানাদাররা তৎকালীন থানা আওয়ামীলীগ সভাপতি শাহনেওয়াজ ভূঁইয়া, ছুবেদ আলী, রইছ উদ্দিন ভূঁইয়া এবং মিয়া চাঁনকে গুলি করে নির্মম ভাবে হত্যা করে নারকীয়তায় মেতে উঠে।

‘৭১ এর ১৭ নভেম্বর নান্দাইল থানা আক্রমণ ও প্রতিরোধ যুদ্ধ-
নান্দাইল থানার দেওয়ানগঞ্জ এবং হোসেনপুর থানার উত্তর এলাকা নিরাপদ ভেবে প্রায়ই মুক্তিযোদ্ধারা একত্রিত হয়ে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহন করতো। মুক্তিযোদ্ধারা হাই কমান্ডের নির্দেশে পরবর্তী অপারেশন চালানোর প্রত্যয় নিয়ে হালিউড়া গ্রামের সফর আলী ভূইয়া চেয়ারম্যানের বাড়িতে গোপন বৈঠকে মিলিত হয়ে সিদ্ধান্ত নেয়,তাদের পুরো দলটি তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে পাক হানাদারদের ঘাঁটি নান্দাইল থানা আক্রমন করবে। প্রথম গ্রুপটির প্লাটুন কমান্ডার আব্দুল কাদির,এবি ছিদ্দিক (পাছপাড়া গ্রামের) ও মাজহারুল হক ফকির (পাছপাড়া গ্রামের) নেতৃত্বে ১৪ জনের দল নদীর পূর্ব পাশে আচারগাঁও পুরনো ডাকবাংলো এলাকায়, দ্বিতীয় গ্রুপটির কোম্পানি কমান্ডার সিরাজুল ইসলাম(ঈশ্বরগঞ্জ বাড়ি) ও নজরুল ইসলামের নেতৃত্বে গার্লস স্কুলের সামনে প্রায় ৭০ জনের এবং তৃতীয় গ্রুপটি মুক্তিযোদ্ধা হাছেন আলীর নেতৃত্বে ছাত্রলীগ নেতা সরাফ উদ্দিন ভূঁইয়া(পুরহরি-আচারগাঁও)ও আব্দুল হেকিম (পরবর্তীতে শিক্ষক,নাট্যকার,পুরহরি-আচারগাঁও)সহ প্রায় ১২ জনের একটি দল।

পরিকল্পনা ছিল প্রথম গ্রুপটি ফাঁকা আওয়াজ করার সাথে সাথে ত্রিমুখী আক্রমণ শুরু করা হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্য মুক্তিযোদ্ধাদের, প্রথম গ্রুপটি নির্দিষ্ট সময়ে মধ্যে অ্যাম্বুশ করতে না পারায় এবং মুক্তিযোদ্ধাদের পরিকল্পনা নান্দাইলের জনৈক শান্তি কমিটির নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিকে জানিয়ে দেয়ায়, হানাদার বাহিনী বিষয়টি জেনেই সতর্ক হয়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অবস্থান শক্তিশালী করার পাশাপাশি আক্রমণ চালানোর নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বেই নান্দাইল থানা থেকে অনবরত ফাঁকা গুলি শুরু করলে মুক্তিযোদ্ধারা বিভ্রান্ত হয়ে যায়। সমন্বয়ের অভাবে তাদের মাঝে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। ফলে সাড়ে চার ঘন্টা তুমুল যুদ্ধের পর গোলাবারুদের অভাবে তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়।

হানদার বাহিনীর সাথে এ তুমুল যুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধা ইলিয়াস উদ্দিন (মেরাকোনা গ্রাম, সেরপুর) নান্দাইল সাবরেজিষ্ট্রারী অফিসের পাশে নদীর ধারে পাকবাহিনীর গুলিতে মারাত্মক আহত হন এবং শামছুল হক (রসুলপুর গ্রাম) ভূমি অফিসের(এসি ল্যান্ড) পাশে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারাত্মক আহত হন। গুরুতর আহত ওই দুই সহযোদ্ধাকে সে সময় সাথী মুক্তিযোদ্ধারা কাঁধে বহন করে পিছু হটার সময় চাঁনপুর এলাকায় যেতেই মুক্তিযোদ্ধা শামছুল হক না ফেরার দেশে এবং পুরহরি এলাকায় মুক্তিযোদ্ধা ইলিয়াস উদ্দিন সকলকে কাঁদিয়ে পরপারে চলে গিয়ে শহীদের খাতায় স্বর্ণাক্ষরে নিজেদের নাম রেখে যান। পরে এলাকার লোকজনের সহায়তার কোন রকমে দ্রুতই চাঁনপুর রাস্তার পাশে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা শামছুল হককে দাফন করা হয় এবং শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ইলিয়াস উদ্দিনকে মেরাকোনা গ্রামের নিজের বাড়িতে কোনক্রমে দ্রুতই দাফনের কাজ সম্পন্ন করা হয়।

এদিকে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটার পর পরই ওই দিন সকালেই ময়মনসিংহ ও কিশোরগঞ্জ থেকে আরো কয়েকশ’হানাদার পাক সেনা নান্দাইলে এসে ব্যাপক ধ্বংস যজ্ঞে মেতে উঠে। এসময় নান্দাইল থানা সদরে হানাদার ও তার দোসরদের গুলিতে নির্মমভাবে শহীদ হন তৎকালীন থানা আওয়ামীলীগের সভাপতি শাহনেওয়াজ ভূঁইয়া(চারিআনিপাড়া),রইছ উদ্দিন ভূঁইয়া ও মিয়া চাঁন (চারিআনিপাড়া), নান্দাইল বাজার এলাকায় ছুবেদ আলী(পুরহরি)। হানাদার ও তাদের দোসররা এসময় নিরপরাধ মানুষের বাড়ি ঘর জ্বালিয়ে ও ধন-সম্পদ লুট করে পৈশাচিক আনন্দ উল্লাসে মেতে উঠে।

আওয়ামীলীগ নেতা ও মুক্তিযুদ্ধের আঞ্চলিক কমান্ডার (বেসামরিক) রফিক উদ্দিন ভূঁইয়া’র বাড়িতে (মেরেঙ্গা গ্রাম) আগুন জ¦ালিয়ে দেয়। সেইসাথে নান্দাইলের শত শত ঘর-বাড়ি পুড়িয়ে দেয়,লুট করে নিরপরাধ অসহায় মানুষের সহায় সম্পদ।

যেভাবে আলাচনায় আসে ১৭ নভেম্বর স্মরণীয় এ দিনটি ‘নান্দাইল শহীদ দিবস’ হিসেবে-
স্বাধীনতার পর থেকে নান্দাইলের বীর শহীদদের আত্মত্যাগকে স্মরণ করে ১৭ নভেম্বর স্মরণীয় এ দিনটি ‘নান্দাইল শহীদ দিবস’ হিসেবে পালন করার প্রত্যয়ে ওই দিন নান্দাইলের বিভিন্ন-শ্রেণি পেশার মানুষ এক কাতারে সামিল হয়ে শহীদ বীরদের আত্মত্যাগকে সামনে রেখে বিভিন্ন কর্মসূচীর মাধ্যমে দিনটি পালন করার পাশাপাশি আগামী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরে ‘বীর শহীদদের জীবন গাঁথা।’

এবারও শনিবার (১৭ নভেম্বর) সকাল ১১টার নান্দাইল উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে ‘নান্দাইল সামাজিক উদ্যোগে’র আয়োজনে এ উপলক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহন করা হয়েছে।

পিএনএস/মোঃ শ্যামল ইসলাম রাসেল

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন