নামের মিল থাকায় ‘ভুল’ রফিককে থানায় এনে পা ভাঙল পুলিশ

  23-04-2019 03:26PM

পিএনএস ডেস্ক : ছিল না কোনো অপরাধ। এরপরও দেখলেন থানা হাজতের চৌদ্দ শিক। পুলিশকে চিনলেন খুব কাছ থেকে। বুঝলেন, পুলিশের নির্মমতা কেমন। ‘পুলিশে ছুঁলে আঠারো ঘা’! এ যে শুধু প্রবাদ নয়, তা ‘ভাঙা পায়ে’ টের পাচ্ছেন মালয়েশিয়াপ্রবাসী রফিকুল ইসলাম (৪০)। পুলিশের ভুলে ব্যান্ডেজ পায়ে এখন যন্ত্রণায় কাঁদতে হচ্ছে তাঁকে। আসামি ধরতে গিয়ে পুলিশ শুধু নামের মিলটাই খুঁজে পেয়েছিল। আর তাতেই এক দল করিতকর্মা পুলিশ রফিকুল ইসলামকে থানায় তুলে নিয়ে পিটিয়ে ডান পা ভেঙে দিল।

মর্মস্পর্শী এ কাণ্ড ঘটিয়েছে কুড়িগ্রামের রাজীবপুর থানার পুলিশ। গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় রাজীবপুর বাজারের একটি দোকান থেকে পুলিশ রফিককে টেনে বের করে পেটাতে পেটাতে থানায় নিয়ে যায়। থানা হাজতে নিরপরাধ ব্যক্তির ওপর এমন অমানুষিক নির্যাতনের খবরে এলাকায় তোলপাড় চলছে।

ওই দিন সন্ধ্যায় রাজীবপুর থানা থেকে মাত্র ৫০ গজ দূরে একটি মোটরসাইকেল মেকারের দোকানে সাদা পোশাকে থাকা শফিক আহমেদ নামের এক পুলিশ সদস্যকে পিটিয়ে রক্তাক্ত করে উপজেলার করাতিপাড়া গ্রামের লোকজন। এ ঘটনায় থানায় মামলা হয়। ওই মামলায় করাতিপাড়া গ্রামের আজগর আলীর ছেলে রফিকুল ইসলামকে আসামি করা হয়। অভিযুক্ত রফিকুল ইসলামের নামের সঙ্গে মিল থাকায় নিরপরাধ অন্য রফিকুল ইসলামকে ধরে থানায় নিয়ে পুলিশ। পিটিয়ে নিরপরাধ রফিকুলের

ডান পা ভেঙে দেওয়ার পর যখন পুলিশ জানতে পারে ‘ভুল হয়ে গেছে’, তখন তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়।

গতকাল সোমবার সকালে পুলিশের ভুলে নির্যাতিত নিরপরাধ রফিকুল ইসলামের জহিরমণ্ডলপাড়া গ্রামের বাড়িতে গিয়ে তাঁর বাবা ইসমাইল হোসেনের সঙ্গে কথা হয়। তিনি জানান, রফিকুল ১০ বছর ধরে মালয়েশিয়ায় কাজ করেন। দুই মাসের ছুটিতে বাড়িতে আসেন তিনি। ঘটনার দিন ঢেউটিন কেনার জন্য রাজীবপুর বাজারে যান। কেনাকাটা শেষে বাজারের একটি ওষুধের দোকানে বসে ছিলেন। হঠাৎ পুলিশ তাঁকে ধরে নিয়ে যায়। ইসমাইল হোসেন আরো বলেন, ‘পুলিশ বলেছে ভুলে আপনার ছেলেকে আটক করা হয়েছিল। নামের মিল থাকার কারণে এ ভুলটা হয়েছে। এ সময় পুলিশ সাদা কাগজে আমার সই রাখে।’

আহত রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমি অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছি; কিন্তু পুলিশ কোনোভাবেই আমার কথা শোনেনি। থানা হাজতে নিয়ে আমার পায়ে ও শরীরে পেটাতে থাকে। গভীর রাতে আমি চেতনা হারালে তারা মাথায় পানি ঢালে। জ্ঞান ফিরে পাওয়ার পর রাত আড়াইটার দিকে আমিসহ আরো চারজনকে তড়িঘড়ি করে হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা দেয় পুলিশ। আমার ডান পায়ের হাড় ফেটে গেছে।’

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে রাজীবপুর থানার ওসি রবিউল ইসলাম বলেন, ‘পুলিশ চিনতে না পেরে তাঁকে ধরে নিয়ে এসেছিল, পরে সকালে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।’ নির্যাতন করা হয়েছে কেন—এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমার এক কনস্টেবলকে মেরে রক্তাক্ত করা হয়েছে। এ কারণে আটক ব্যক্তিদের দু-একটা ডাং দেওয়া হয়েছে।’

এদিকে এ ঘটনার পর পুলিশের ভয়ে উপজেলার করাতিপাড়া ও করাতিমণ্ডলপাড়া দুই গ্রামের ৪০০ পরিবারের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। পুলিশের ভয়ে ওই দুই গ্রাম এখন পুরুষশূন্য। গত বৃহস্পতিবার থেকে পাঁচ দিন দুই গ্রামের মানুষ পালিয়ে বেড়াচ্ছে। মামলায় অভিযুক্ত ছাড়াও নিরপরাধ মানুষও পুলিশের ভয়ে বাড়িতে থাকতে পারছে না। গতকাল সোমবার ওই দুই গ্রামে গিয়ে কোনো পুরুষ মানুষকে বাড়িতে পাওয়া যায়নি।

করাতিমণ্ডলপাড়া গ্রামের আলমগীর হোসেন ওই ঘটনার সঙ্গে জড়িত নন। এরপরও তিনি পুলিশের ভয়ে বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছেন। তাঁর স্ত্রী লাভলী বেগম বলেন, ‘আমার স্বামী ওই মারামারির সঙ্গে জড়িত নয়। মাইনসে কয়, নাম ছাড়া আসামি রয়েছে। ফলে পুলিশ গেরামের যাকে পাবে, তাকে ধইরা নিয়া নাম ঢুকিয়ে দিবে। এই ভয়ে পোলার বাপে বাড়ি ছাড়ছে।’ গৃহবধূ শহর বানু বলেন, ‘আমার স্বামী (আব্দুর করিম) কোনো ঝামেলায় যায়নি, কামলা দিয়া খায়। পুলিশের ভয়ে পাঁচ দিন থিকা বাড়িছাড়া। আয়-রোজগার বন্ধ। ধারকর্জ করে ছেলে-মেয়েদের খাওন জোগাইছি। আরো কত দিন যে এভাবে পালাইয়া থাকিবে।’

রাজীবপুর সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও জেলা পরিষদের সদস্য আলহাজ আজিম উদ্দিন বলেন, ‘ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত, যারা অভিযুক্ত পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করুক। তা না করে নিরীহদের পুলিশ হয়রানি করছে।’

নিরীহ মানুষকে হয়রানি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রাজীবপুর থানার ওসি রবিউল ইসলাম বলেন, ‘কোনো নিরীহ মানুষকে হয়রানি করা হয়নি। মামলায় যারা অভিযুক্ত এবং যারা ঘটনার সঙ্গে জড়িত মূলত তাদেরই গ্রেপ্তারের জন্য পুলিশ তৎপরতা চালাচ্ছে। এখন যারা জড়িত নয়, তারা যদি পুলিশের ভয়ে বাড়ি ছাড়ে তাহলে আমরা কী করব।’

উল্লেখ্য, গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় তুচ্ছ ঘটনার জের ধরে রাজীবপুর থানার মোড় চত্বরে মোটরসাইকেল মেকার হযরত আলীর দোকানে হামলা চালায় করাতিপাড়া গ্রামের মানুষ। এ সময় মেকার হযরত আলীকে দোকান থেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়। একপর্যায়ে সাদা পোশাকে থাকা পুলিশ সদস্য শফিক আহমেদ বাধা দিলে তাঁকে পেটানো হয়। পরে থানা থেকে আরো পুলিশ উপস্থিত হলে সংঘর্ষ বাধে। এ ঘটনায় মোটরসাইকেল মেকার হযরত আলী ও পুলিশের দুটি মামলায় ৫০ জনকে আসামি করা হয়। মামলায় ১৯ জনের নাম উল্লেখ করা হয়।

পিএনএস/জে এ

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন