পরিবারকে মিন্নি বললেন ‘কী নির্যাতন করেছে বুঝে নেও’

  21-07-2019 06:53PM

পিএনএস ডেস্ক : আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি। রিফাত শরীফের স্ত্রী। রিফাতকে কুপিয়ে খুনের প্রধান প্রত্যক্ষদর্শী। মামলায় ছিলেন সাক্ষী। এখন আসামি হিসেবে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। নেওয়া হয়েছিল রিমান্ডে। পাঁচ দিনের রিমান্ডের দুই দিন পর আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন তিনি। এরপর তাঁকে পাঠানো হয় কারাগারে। এ পুরো প্রক্রিয়ার প্রতিবাদ জানিয়েছেন মিন্নির বাবা মোজাম্মেল হোসেন কিশোর। তিনি বলেছেন, পুলিশের তদন্তে আস্থা রাখতে পারছেন না তিনি। এ অবস্থায় গতকাল শনিবার মিন্নির সঙ্গে কারাগারে সাক্ষাৎ করতে যান তিনি ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা। দুই কারারক্ষীর সাহায্যে কোনোমতে দাঁড়িয়ে থাকা মিন্নিকে দেখে পরিবারের নারী সদস্যরা কেঁদে ফেলেন। পুরুষ সদস্যরা তাঁকে নানা কথা জিজ্ঞেস করেন। কিন্তু ঠিকমতো সোজা হয়ে দাঁড়াতেই পারছিলেন না। এদিক-ওদিক ঢলে পড়ছিলেন। তাঁকে দুই পাশ থেকে ধরে রাখছিলেন দুই নারী কারারক্ষী।

মিন্নি তাঁর বাবাকে শুধু একবারই বলছিলেন, ‘কী নির্যাতন করেছে বুঝে নেও।’

মোজাম্মেল হোসেন কিশোর মেয়ের সঙ্গে দেখা করে আসার পর কালের কণ্ঠ’র কাছে এমন বর্ণনাই দিয়েছেন। তাঁর বর্ণনা অনুযায়ী, দুই কারারক্ষী তাঁর মেয়েকে অনেকটা টেনেই তাঁদের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য নিয়ে আসেন। মিন্নি হাঁটতে পারছিলেন না। এমনকি দাঁড়াতেও পারছিলেন না।

গতকাল সকালে বরগুনা জেলা কারাগারে মিন্নির সঙ্গে দেখা করেন তাঁর মা-বাবা, তিন ভাই-বোন, চাচা আর ফুফু।

মোজাম্মেল হোসেন দাবি করেন, তাঁর মেয়ের ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো হয়েছে। তিনি বলেন, “আমরা তাকে অনেক প্রশ্ন করেছি। মিন্নি দু-একটার উত্তর দিয়েছে। নির্যাতনের বিষয়ে শুধু বলেছে, ‘বাবা, আমায় দেখে বুঝে নেও কী নির্যাতন ওরা চালিয়েছে। আমি যদি পুলিশের শেখানো কথা আদালতে না বলি, তাহলে আরো ১০ দিন রিমান্ডে এনে ওরা আমার ওপর নির্যাতন চালাত। তাই নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা পেতে বলেছি খুনের ঘটনার পরিকল্পনার সঙ্গে আমি জড়িত।’”

মোজাম্মেল আরো বলেন, ‘আমার মেয়ের ওপর যে ধরনের নির্যাতন চালানো হয়েছে, তা মেয়েই খুলে বলছে না। আমার দাবি, এই ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত করা হোক। যারা মিন্নিকে দিয়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদায় করিয়ে নিয়েছে তারা যেন আইনের আওতায় আসে।’ তিনি আরো বলেন, ‘আপনারা দেখেছেন মিন্নি তার স্বামীকে বাঁচাতে জীবন বাজি রেখে লড়েছিল। কিন্তু খুনিদের বাঁচাতে আমার মেয়েকে সাক্ষী থেকে আসামি বানানো হলো। জেলা পুলিশ প্রশাসনের ওপর আমার কোনো আস্থা নেই। আমি এই ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি করছি।’

পুলিশের তদন্তে তিনি আস্থা রাখতে পারছেন না—এমন মন্তব্য করে মিন্নির বাবা বলেন, ‘রিফাতকে কুপিয়ে হত্যা মামলার প্রধান সাক্ষী মিন্নি। কিন্তু সাক্ষী হিসেবে তথ্য নেওয়ার কথা বলে ১২ ঘণ্টা জেরা করার পর যেভাবে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তা অবিশ্বাস্য। এখানেই শেষ নয়। ক্ষমতাসীন দলের যাঁরা স্থানীয় রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করেন তাঁরা এই মামলার তদন্তকে প্রভাবান্বিত করার জন্য উঠে পড়ে লাগলেন, মেয়েকে রিমান্ডের নামে নির্যাতন করে জোর করে স্বীকারোক্তি আদায় করলেন।’

মোজাম্মেল বলেন, ‘তাই আদালত চত্বরে দাঁড়িয়ে প্রকাশ্যে আমি বলেছিলাম, এসপি সাহেব আমাকে গ্রেপ্তার করুন। আমি এখানে গ্রেপ্তার হতে কিংবা মারা যাওয়ার জন্য এসেছি। এত নির্মমতার শিকার কোনো মানুষ হবে? কী অন্যায় আমার মেয়ের? সে জীবন বাজি রেখে স্বামীকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছে। সেই চেষ্টা করাই কি তার অপরাধ? তালাবদ্ধ রুমে হুমকি দিয়ে তার স্টেটমেন্ট নেওয়া হচ্ছে। এ তো শম্ভু (বরগুনার সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু) বাবুর খেলা, শম্ভু বাবুর খেলা।’ তিনি আরো বলেন, ‘তাঁর (শম্ভু) ছেলে সুনাম দেবনাথ (জেলা আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক) মাদকের সম্রাট। এগুলো তাঁদের খেলা। তাঁর ছেলেকে সেভ করার জন্য আমরা বলি হয়ে যাচ্ছি। এসব করাচ্ছেন শম্ভু আর তাঁর ছেলে। আর খুনের সঙ্গে জড়িত খুনিরা একত্র হয়ে এ কাজ করছে। নির্মমভাবে মেয়েটাকে নির্যাতন করা হয়েছে।’

গত শুক্রবার দুপুরে মিন্নিকে গোপনে আদালতে জবানবন্দি দিতে নিয়ে যায় পুলিশ। বিকেলে এ খবর জানতে পেরে মোজাম্মেল হোসেন আদালত প্রাঙ্গণে ছুটে যান। সেখানেও তিনি চিৎকার করে ওই সব কথা বলেছিলেন। সন্ধ্যা ৭টার দিকে আদালত থেকে বের করার পর মিন্নি সাংবাদিকদের কিছু বলতে উদ্যত হলে পাশে থাকা নারী পুলিশ তাঁর মুখ চেপে ধরে। সাংবাদিকরা এগিয়ে গেলে অন্য পুলিশ সদস্যরা তাঁদের সরিয়ে দেন।

এদিকে আদালত চত্বরের ওই ঘটনার পর মিন্নির বাবাকে রাজনৈতিক একটি পক্ষ চাপ প্রয়োগের পাশাপাশি বিভিন্নভাবে হুমকি দিতে শুরু করেছে বলে তিনি অভিযোগ করেছেন। মোজাম্মেল হোসেন বলেন, ‘শম্ভু বাবুর লোকজন আমাকে হুমকি দিচ্ছে। এ ঘটনায় আমি থানায় সাধারণ ডায়েরি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আগামীকাল (রবিবার) ঢাকা থেকে আইনজীবীরা আসবেন। তাঁদের সঙ্গে পরামর্শ করে ব্যবস্থা নেব।’ তিনি আরো বলেন, ‘ঘটনার পর থেকেই আমার পরিবারের সদস্যরা গৃহবন্দি। দুই সন্তান স্কুলে যেতে পারছে না। আমিও বাইরে বের হতে ভয় পাই। সব সময় আমার আশপাশে অপরিচিত লোকজন দেখতে পাই।’

গত ২৬ জুন সকাল সাড়ে ১০টার দিকে রিফাতকে স্ত্রীর সামনে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ওই দিন রাতে রিফাত শরীফের বাবা আবদুল দুলাল শরীফ ১২ জনকে আসামি করে যে মামলাটি করেন, তাতে প্রধান সাক্ষী করা হয়েছিল মিন্নিকেই।

গত ১৩ জুলাই মিন্নির শ্বশুর তাঁর ছেলের হত্যাকাণ্ডে পুত্রবধূর জড়িত থাকার অভিযোগ তুলে সংবাদ সম্মেলন করেন। তিনি মিন্নির গ্রেপ্তার দাবি করেন। পরদিন ‘বরগুনার সর্বস্তরের জনগণ’ ব্যানারে মানববন্ধন হয়, যেখানে স্থানীয় সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর ছেলে আওয়ামী লীগ নেতা সুনাম দেবনাথও ছিলেন।

শ্বশুর অভিযোগ তোলার পরদিন মিন্নি তা অস্বীকার করে পাল্টা বলেছিলেন, দুলাল শরীফ ষড়যন্ত্রকারীদের প্ররোচনায় পড়ে তাঁকে জড়িয়ে বানোয়াট কথা বলছেন।

এরপর গত মঙ্গলবার সকাল পৌনে ১০টার দিকে মিন্নিকে তাঁর বাবার বাসা থেকে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের কথা বলে পুলিশ লাইনসে নিয়ে যায়। প্রায় ১২ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদের পর রাত ৯টার দিকে তাঁকে রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়। পরদিন বুধবার পুলিশ মিন্নিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাত দিনের হেফাজত (রিমান্ড) চেয়ে আদালতে আবেদন করে। বিচারক শুনানি শেষে পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। দুই দিন পর শুক্রবার ১৬৪ ধারায় তিনি জবানবন্দি দেন। পুলিশ বলেছে, জবানবন্দিতে মিন্নি কী বলেছেন, সেটি তারা জানে না।

পিএনএস/জে এ

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন