আদালতের রায়ের পর দালাল বাজার জমিদার বাড়িতে পর্যটকের ঢল!

  14-10-2019 04:29PM

পিএনএস, লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি : লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার দালাল বাজার জমিদার বাড়ি। জেলার প্রাচীন ঐতিহ্যের একটি অনন্য নিদর্শন। শত বছরের পুরনো এই বাড়িতে ঘুরে বিনোদনের খোরাক যোগাতেন এখানকার পর্যটকগণ। জানতেন ইতিহাস আর ঐতিহ্য সম্পর্কে।

অন্যদিকে বিপুল রাজস্ব আয় করতে পারতেন সরকার। অথচ একটি স্বার্থন্বেষী মহল বাড়িটি অবৈধভাবে দখল করে রেখেছিল দীর্ঘদিন। ফলে অযত্নে আর অবহেলায় প্রায় ধ্বংস হয়ে গিয়েছে বাড়িটি। চুরি হয়ে গিয়েছে মহা মূল্যবান বহু জিনিসপত্র।

দেওয়ালগুলো শ্যাওলায় পরিপূর্ণ ও ধ্বসে পড়েছে কয়েকটি যায়গা। লতাপাতা আর জঙ্গলে ভরা এই স্থাপনাটি স্থানীয় পর্যটকদের কাছে ভুতুড়ে বাড়ি হিসাবে পরিচিতি লাভ করে। পাশাপাশি অন্ধকারাচ্ছন্ন হওয়ায় মাদক সেবনসহ বিভিন্ন অনৈতিক কাজ হতো এখানে।

সম্প্রতি প্রাচীন এই নিদর্শনটিকে ভ্রমণ পিপাসুদের নিকট আরও আকর্ষণীয় করতে সংস্কার ও সৌন্দর্য বর্ধনের উদ্যোগ নেয় লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসন। এর পর থেকেই প্রতিদিনই শত-শত পর্যটক বাড়িটি দেখতে ভীড় করছেন সেখানে। ইতিমধ্যে জমিদার বাড়ির আশপাশে ব্যাপক সংস্কার ও মেরামত কাজ করা হয়েছে।

পাশাপাশি খোয়াসাগর দিঘীর পাড় সৌন্দর্য বর্ধনের কাজ করা হয়েছে । জেলা প্রশাসক অঞ্জন চন্দ্র পাল অফিসের কাজের পাশাপাশি দালাল জমিদার বাড়িতে ছুটে যান এবং পর্যটকদের জন্য আরও কি করা যায় সেই লক্ষ্যে বিভিন্ন দিক নির্দেশনা প্রদান করেন প্রশাসনের অন্যান্য কর্মকর্তাদের।

জানা গেছে, দেশ বিভক্তির পূর্বে ১৯৪৬ সালে লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার দালাল বাজারের জমিদার নবীন কিশোর রায় ও নরেন্দ কিশোর রায় প্রায় ৩৬ একর সম্পত্তি রেখে ভারতে চলে যান। সেই সম্পত্তির ২২ একরে দৃষ্টি নন্দন খোয়া সাগরদিঘী। অন্য ১৪ একরে রয়েছে পরিত্যক্ত রাজ গেইট, জমিদারি প্রাসাদ, অন্দরমহল, শান বাঁধানো ঘাট, জমিদার বাড়ির প্রাচির, নৃত্যশালা, বহিরাঙ্গন ও তিনটি পুকুর। ১৯৫০ সালে তৎকালীন পাক সরকার জমিদার প্রথা বিলুপ্ত করে এ সম্পত্তি শত্রু সম্পত্তি ঘোষণা করায় সরকারি সম্পদ হিসেবে পরিণত হয়।

এই সুবাধে ১৯৬৫ সালে আব্দুল মোমেন চৌধুরী সরকারের কাছ থেকে ৭ একর ৮৬ শতক জমি লিজ নেন। পরবর্তীতে চার একর ৮৬ শতক জমি আরও দুই বছরের জন্য লিজ নিয়ে ২০১৫ সালের ২০ জুন অর্থাৎ প্রায় ৫০ বছর পর্যন্ত ঘরবাড়ি নির্মাণ করে দখলে থেকে বসবাস করছেন। এছাড়া এসব সম্পত্তির কিছু অংশ প্রভাবশালীরা স্থানীয় তহসিলদার ও উপজেলা ভূমি কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে ভোগ দখল করেছেন।

আরো জানা যায়, ২০১৫ সালে ওই লিজ বাতিলের পাশাপাশি অবৈধ দখল উচ্ছেদ করে বাড়িটি সংস্কারের উদ্যোগ নেয় লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসক। জেলা প্রশাসনের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে একটি রিট করেন ওই মহলটি।

দীর্ঘ শুনানির পর গত ৯ আগস্ট তা খারিজ করে দেয় আদালত। আদালতের রায়ের পরেই এই স্থাপনাটি সংস্কার ও সৌন্দর্য বর্ধনের উদ্যোগ নেয় জেলা প্রশাসক। এদিকে ২০১৮ সালের ৪ জানুয়ারি ঐতিহাসিক নিদর্শন বিবেচনা করে প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তরের স্থাপনাটিকে সংরক্ষণযোগ্য ভূমি হিসাবে গেজেট প্রকাশিত হয়।

সরেজমিনে গেলে ওই এলাকার আবদুল কাদের মিয়া, হোসেন আহমদসহ কয়েকজন বৃদ্ধ জানান, লক্ষ্মীনারায়ন নামে জনৈক ব্যক্তি কাপড়ের ব্যবসা করার উদ্দেশ্যে দালাল বাজারে আসেন। তার পুত্র ব্রজবল্লভ স্বীয় দক্ষতা গুণে ব্যবসার প্রসার ঘটান।

ব্রজবল্লভের পুত্র গৌরকিশোর রায় কলকাতায় পড়ালেখার সুবাদে ইষ্টইন্ডিয়া কোম্পানির সাহচর্যে আসেন এবং জমিদারি খরিদ করেন। তিনি ১৭৬৫ খ্রিষ্টাব্দে রাজা উপাধী লাভ করেন। গৌরকিশোর রায় ও রাণী লক্ষ্মী প্রিয়া ছিলেন নি:সন্তান। তারা ঢাকার বিক্রমপুর থেকে গোবিন্দ কিশোরকে পোষ্যপুত্র হিসাবে গ্রহন করে। গোবিন্দ কিশোর রায়ের পুত্র নবীন কিশোর রায় তাদের জমিদারির খাজনা আদায় ও তদারকি করতেন। পরবর্তীতে জমিদার ও তাদের উত্তসূরীরা ১৮৫০ খ্রিষ্টাব্দে এ বাড়িটি নির্মাণ করেন।

ময়না ও আছমা আক্তার নামে দু’জন পর্যটক প্রতিবেদককে বলেন, ভুতুড়ে বাড়ি হিসাবে পরিচিত এই জমিদার বাড়িটি সৌন্দর্য বর্ধনের কাজ হয়েছে শুনে দেখতে এসেছি। এমন উদ্যোগ আরো আগেই নেওয়া উচিত ছিল সংশ্লিষ্টদের। কারন অযত্নে পড়ে থাকার কারনে এখানকার বহু মূল্যবান জিনিসপত্র চুরি হয়ে গিয়েছে। ধ্বসে পড়েছে কয়েকটি দেওয়ালের অধিকাংশ অংশ।

তারা আরো বলেন, ইতিহাস-ঐতিহ্য একটি জাতি, দেশ ও অঞ্চলের অহংকার। নতুন প্রজন্মের সৃজনশীল চিন্তা-ভাবনার পরিপূর্ণ বিকাশ সাধনেও ইতিহাস ও ঐতিহ্যের গুরুত্ব অপরিসীম। এজন্য জেলার এই প্রাচিন স্থাপনাটির শতভাগ সংস্কারের দাবি করেন তারা।

এ বিষয়ে লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসক অঞ্জন চন্দ্র পাল সাংবাদিকদের জানান, প্রাচীন এই নিদর্শনকে পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় করতে সংস্কারের কাজ চলছে।

ইতিমধ্যে খোয়াসাগর দিঘীর পাড় সৌন্দর্য বর্ধনের কাজ করা হয়েছে। এই জমিদার বাড়িটি সংস্কার কাজ শেষ হলে জেলার পর্যটন বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে । তাছাড়া এই ঐতিহ্য থেকে বিপুল পরিমান রাজস্ব আয় করতে পারবে সরকার বলেও জানান তিনি।

(সাবেক) বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রী ও লক্ষ্মীপুর-৩ আসনের সাংসদ এ কে এম শাহজাহান কামাল বলেন, দীর্ঘ অপেক্ষার পর কুচক্রীদের থেকে এই স্থাপনাটি উদ্ধার হয়েছে আদালতের রায়ের মাধ্যমে। ইতিমধ্যে শত-শত লোকজন স্থাপনাটি দেখতে প্রতিদিনই এখানে আসছেন। জেলার এই ঐতিহ্যকে ভ্রমণ পিপাসুদের কাছে আকর্ষণীয় করতে সকল পদক্ষেপ গ্রহন করা হবে বলেও জানান সাবেক এই পর্যটন মন্ত্রী।

পিএনএস/মো. শ্যামল ইসলাম রাসেল

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন