জলবায়ু পরিবর্তন: সবজি বাগানের মাধ্যমে যেভাবে লড়াই করছে সিলেটের নারীরা

  15-12-2019 07:26PM

পিএনএস ডেস্ক : ঘরোয়া বাগানে ফলমূল এবং সবজি উৎপাদন সবসময়েই পরিবেশ বান্ধব বলে মনে করা হয়, কিন্তু এখন ধারণা করা হচ্ছে, এটি জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে লড়াইয়েও একটি অস্ত্র হয়ে উঠতে পারে।

ঠিক এই অভিজ্ঞতা হয়েছে বাংলাদেশের একটি এলাকার বাসিন্দাদের, যখন তাদের খাবার ও আয় রোজগারের প্রধান ফসল ধান মৌসুমি বৃষ্টিতে নষ্ট হয়ে যায়।

বাংলাদেশের সিলেট বিভাগে ২০১৭ সালের এপ্রিলে আগাম অতিবৃষ্টির কারণে তাদের ক্ষেতের সব ধান নষ্ট হয়ে যায়। অথচ ওই বছর বৃষ্টি শুরু হওয়ার কথা ছিল আরো দুই মাস পরে।

কৃষকদের বেশিরভাগ ফসলই বৃষ্টিতে নষ্ট হয়ে যায়। যার অর্থ হলো - বছরের বাকি সময়ের জন্য তাদের আর কোন আয় ছিল না, পরিবারের জন্য যথেষ্ট খাবারও ছিল না।

বিজ্ঞানীরা বরাবরই সতর্ক করে দিয়ে আসছেন যে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে মানুষের ফসলের চাষাবাদের ওপর এবং খাবারে থাকা পুষ্টিগুণের ওপরেও প্রভাব পড়ছে।

বার্লিনের চারিটি-ইউনিভার্সিটি মেডিসিনের জলবায়ু ও স্বাস্থ্য বিভাগের অধ্যাপক এবং পটসড্যাম ইন্সটিটিউট ফর ক্লাইমেট ইমপ্যাক্ট রিসার্চের গবেষক সাবিনে গাব্রিয়চ বলছেন, ''জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে এসব মানুষের আসলে কোন ভূমিকাই নেই, কিন্তু তবু তারা এর শিকার হচ্ছে।''

নোবেল ফাউন্ডেশন আয়োজিত স্বাস্থ্য ও জলবায়ু বিষয়ক একটি সম্মেলনে অংশ নেয়ার সময় তিনি বলেন, ''তারা ভিন্নভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার হচ্ছে, কারণ তারা তাদের জীবিকার উপায় এবং খাদ্য-পুষ্টির উৎস হারিয়ে ফেলছে।"

"তাদের সন্তানরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হচ্ছে, কারণ তারা দ্রুত বড় হচ্ছে বলেই তাদের পুষ্টিরও বেশি দরকার।''

এমনকি এক-তৃতীয়াংশ নারীর ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে কম বলে দেখা গেছে, আর ৪০ শতাংশ শিশুই মারাত্মকভাবে অপুষ্টির শিকার।

''অনেক মানুষ আসলে এর মধ্যেই কোনমতে টিকে রয়েছে, তারা অনেক ধরণের রোগে ভুগছে,'' বলছেন অধ্যাপক গাব্রিয়চ। ''তাদের কোন বীমাও নেই।''

বাংলাদেশের সিলেট বিভাগে বন্যার প্রভাব নিয়ে তিনি একটি গবেষণার নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ওই এলাকার বিভিন্ন গ্রামের ২ হাজারের বেশি নারীর সঙ্গে তিনি কাজ করছেন।

এই নারীদের অর্ধেকেরও বেশি বলেছেন যে, বন্যার কারণে তাদের পরিবার মারাত্মকভাবে ক্ষতির শিকার হয়।

সেই ক্ষতি কাটাতে বেশিরভাগ পরিবার যা করেছে, তা হলো অন্যের কাছ থেকে টাকাপয়সা ধার করা। বিশেষ করে সেই সব ব্যক্তির কাছ থেকে - যারা চড়া সুদে টাকা ধার দিয়ে থাকে। তাদের কাছ থেকে টাকা এনে পরিবারটি ঋণের জালে আটকে পড়ে।

এই গবেষক দলটি এসব মানুষকে তাদের বাড়ির আঙ্গিনার উঁচু জমিতে বাগান করতে শিখিয়েছে। এসব জায়গায় তারা পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ ফলমূল এবং সবজি চাষ করতে এবং মুরগি পালন করতে পারছে।

অধ্যাপক গাব্রিয়চ বলছেন, ''আমি মনে করি না এর ফলে তাদের ধান নষ্ট হয়ে যাওয়ার ক্ষতি পূরণ হচ্ছে - কারণ ওটা হচ্ছে তাদের জীবিকার প্রধান ফসল। কিন্তু এটা তাদেরকে অন্তত কিছুটা সহায়তা করতে পারছে।''

উন্নয়নশীল দেশগুলোয় ধানের মতো যেসব খাবারের ওপর বাসিন্দারা নির্ভর করেন, সেখানে যখন এসব ফসলের ভালো ফলন হলেও, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এসব খাদ্যে ততটা পুষ্টি থাকে না।

ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনের গ্লোবাল হেলথ বিভাগের অধ্যাপক ক্রিস্ট্রি ইবি পুষ্টিমান নিয়ে গবেষণা করেছেন।

তিনি দেখতে পেয়েছেন যে, চাল, গম, আলু আর সাবুর মতো খাবারে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। এর মানে হলো, এগুলো জন্মাতে কম পানি লাগে। এটা শুনতে ইতিবাচক শোনালেও ব্যাপারটা তা নয়। কারণ এসব ফসল মাটি থেকে কম পুষ্টি টেনে নিচ্ছে।

রোগব্যাধি বেড়ে যাওয়া
অধ্যাপক ইবির গবেষণা দল দেখতে পেয়েছে যে, তারা যেসব ধান নিয়ে গবেষণা করেছেন, সেখানে গতে ৩০ শতাংশ হারে ভিটামিন বি কমে গেছে। এতে গর্ভবতী নারীদের জন্য জরুরি ফলিক অ্যাসিডের পরিমাণও স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে কমে যাচ্ছে।

তিনি বলছেন, ''বর্তমানে বাংলাদেশ যখন সম্পদশালী হয়ে উঠছে, এখনো দেশটির প্রতি চারজনের তিনজনের দরকারি ক্যালরি আসে চাল থেকে।''

''কিন্তু অন্য অনেক দেশের বাসিন্দারা তাদের প্রধান খাবার হিসাবে চাল ছাড়াও অন্যান্য অনেক ধরণের খাদ্য গ্রহণ করে থাকে। সুতরাং চালে পুষ্টি কম থাকলেও তা তাদের ক্ষেত্রে খুব সামান্যই প্রভাব ফেলে।''

তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলছেন, বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধির মানে হলো রোগব্যাধির প্রকোপও বেড়ে যাওয়া।

''মশাবাহিত রোগের প্রকোপ বেড়ে যাওয়ার বড় ঝুঁকি রয়েছে। এর পাশাপাশি ডায়রিয়া ও সংক্রমণ রোগের প্রকোপও বাড়ছে।''

''আমাদের পৃথিবী যত বেশি উষ্ণ হয়ে উঠছে, ততই রোগব্যাধি বিস্তারের এলাকা বাড়ছে, দীর্ঘসময় ধরে এসব রোগ থাকছে। এসব রোগের বিস্তার অনেক বেশি হচ্ছে।''

''আর অনেক ক্ষেত্রেই এসব রোগের প্রাথমিক শিকার হচ্ছে শিশুরা। এ কারণেই আমরা মা ও শিশুদের স্বাস্থ্য নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন কারণ তারা ঝুঁকির দিক থেকে সামনের কাতারে রয়েছে। তাদের ওপরেই এসব পরিবর্তনের প্রভাব বেশি পড়ছে।''

যেসব রোগব্যাধি সাধারণত গ্রীষ্মপ্রধান এলাকায় দেখা যেত, এখন সেসব রোগ উত্তরের এলাকাতেও ছড়িয়ে পড়ছে।

এ বছর প্রথমবারের মতো জার্মানিতে ওয়েস্ট নিল ভাইরাসের রোগীর দেখা পাওয়া গেছে, যা একটি মশাবাহিত রোগ।

সাবিনে গাব্রিয়চ বলছেন, ''এসব সংক্রমণ রোগের বিস্তারের ফলে মানুষ উপলব্ধি করতে শুরু করেছে যে, জলবায়ু পরিবর্তন আমাদের ওপরেও আসতে শুরু করেছে।''

নোবেল বিজয়ী পিটার অ্যাগর সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন যে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে রোগব্যাধি ছড়িয়ে পড়ছে। এমন সব এলাকায় এমন রোগ দেখা যাচ্ছে যা আগে দেখা যায় নি এবং নতুন নতুন এলাকায় রোগের বিস্তার দেখা যাচ্ছে। দক্ষিণ আমেরিকা ও আফ্রিকায় দেখা যাওয়া কিছু রোগ উঁচু এলাকার দিকেও এখন দেখা যেতে শুরু করেছে।

এটা গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে, গ্রীষ্মপ্রধান এলাকার মানুষজন সাধারণত রোগ থেকে নিজেদের রক্ষা করতে উঁচু এলাকায় বসবাস করেন।

২০০৩ সালে রসায়নে নোবেল পাওয়া অধ্যাপক অ্যাগর বলছেন, ''উষ্ণতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে যেহেতু রোগব্যাধি ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে, ফলে কারোই আর আরামে বসে থাকার সুযোগ নেই।''

''একটা জনপ্রিয় প্রবাদ ছিল যে, 'এখানে এটা ঘটবে না'। কিন্তু এখন, সেটা ঘটতে পারে।''

সূত্র: নোবেল মিডিয়া এবি এবং বিবিসির যৌথ উদ্যোগে এই নিবন্ধ লেখা হয়েছে।

পিএনএস/জে এ

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন