বৈদেশিক লেনদেনে ঘাটতি বাড়ছে অস্বাভাবিক হারে

  11-05-2022 09:39AM


পিএনএস ডেস্ক: চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় বৈদেশিক লেনদেনের ঘাটতি বেড়ে যাচ্ছে। এক দিকে আমদানি ব্যয় অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে; বিপরীতে কাক্সিক্ষত হারে রফতানি আয় ও রেমিট্যান্স-প্রবাহ বাড়ছে না। এর ফলে ডলারের বিনিময় হারের সাথে চাপ বেড়ে যাচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে বৈদেশিক বাণিজ্যে ঘাটতি বেড়েছে ৬৪ শতাংশ। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, যে হারে আমদানি ব্যয় বাড়ছে এটা অব্যাহত থাকলে আর্থিক বছর শেষে বৈদেশিক লেনদেনের ঘাটতি আরো বেড়ে যাবে। এতে ডলারের দাম টাকার বিপরীতে আরো বেড়ে যাবে, যাতে মূল্যস্ফীতিসহ সামগ্রিক অবস্থায় অস্থিরতা দেখা দিতে পারে।

বাংলাদেশ ব্যাংক ও রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্য মতে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ঋণাত্মক ১৬ দশমিক ২৫ শতাংশ; অপর দিকে একই সময়ে রফতানি আয়ের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩৫ শতাংশ। কিন্তু ৯ মাসের হিসাবে আমদানি ব্যয়ের প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ৪৪ শতাংশ। যে হারে আমদানি ব্যয়ে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, এটা এপ্রিলেও অব্যাহত রয়েছে। আমদানি ব্যয়ের এপ্রিলের হিসেব এখনো চূড়ান্ত না হওয়ায় সুনির্দিষ্ট হার বলা যাচ্ছে না। এ অবস্থা থাকলে আর্থিক বছর শেষে চাপের মুখে পড়ে যাবে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। ইতোমধ্যে রিজার্ভ কমতে শুরু করেছে। গত সপ্তাহেও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৪৪ বিলিয়ন ডলার। এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) মার্চ-এপ্রিল মেয়াদের রেকর্ড ২ দশমিক ২৪ বিলিয়ন (২২৪ কোটি) ডলারের আমদানি বিল পরিশোধ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর ফলে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ রিজার্ভ ৪১ দশমিক ৯০ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। এর আগে ২০২০ সালের নভেম্বরে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৪১.২৬ বিলিয়ন ডলার। বর্তমানের আমদানির খরচ হিসাবে এই রিজার্ভ দিয়ে পাঁচ মাসের কিছু বেশি সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব হবে। অথচ সাত-আট মাস আগেও ১০ থেকে ১১ মাসের আমদানি খরচ মেটানোর রিজার্ভ ছিল বাংলাদেশ ব্যাংকে।

এ দিকে অস্বাভাবিক হারে আমদানি দায় বেড়ে যাওয়ায় বৈদেশিক লেনদেনের ঘাটতি বেড়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যানে থেকে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ৪৯০ কোটি ডলারে। যেখানে আগের বছরের একই সময়ে ছিল এক হাজার ৫২১ কোটি ডলার। আলোচ্য সময়ে বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে প্রায় ৬৪ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী চলতি অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে ছয় হাজার ১৫২ কোটি ৪০ লাখ (৬১ দশমিক ৫২ বিলিয়ন) ডলারের বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ। এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৪৩ দশমিক ৮৬ শতাংশ বেশি। ২০২০-২১ অর্থবছরের এই ৯ মাসে ৪২ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছিল। অন্য দিকে চলতি অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে বিভিন্ন পণ্য রফতানি করে ৩৬ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার আয় করেছেন রফতানিকারকরা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৩২ দশমিক ৯২ শতাংশ বেশি। আমদানি ব্যয় থেকে রফতানি আয় বাদ দিলে বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়ায় দুই হাজার ৪৯০ কোটি ডলার।

আলোচিত ৯ মাসে সেবা খাতের বাণিজ্য ঘাটতিও বেড়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে সেবা খাতে বাংলাদেশ আয় করেছে ৭০৮ কোটি ডলার। অন্য দিকে সেবা খাতে দেশের ব্যয় হয়েছে ৯৯৮ কোটি ডলার। সেই হিসাবে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২৮০ কোটি ডলার। আগের অর্থবছরের একই সময়ে ঘাটতি ছিল ১৯৯ কোটি ডলার।

জানা গেছে, চলতি হিসাবের ভারসাম্যে (কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যালেন্স) বড় ঘাটতিতে পড়েছে বাংলাদেশ। চলতি অর্থবছরের ৯ মাসে এ ঘাটতির (ঋণাত্মক) পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৪০৭ কোটি ৭২ লাখ ডলার। আগের অর্থবছরে একই সময়ে ঘাটতির অঙ্ক ছিল ৫৫৫ কোটি ডলার। সামগ্রিক লেনেদেনে ঘাটতি ৩ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার। অথচ গত অর্থবছরের একই সময়ে এই সূচকে সাত বিলিয়ন ডলার উদ্বৃত্ত ছিল। সামগ্রিক লেনেদেনে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩০৯ কোটি ৭০ লাখ ডলার, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে এ সূচকে ৬৯৯ কোটি ডলারের উদ্বৃত্ত ছিল।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বৈদেশিক মুদ্রার আন্তঃপ্রবাহ কমে যাওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে চাপ বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময়েও চাপ বেড়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে ১২ দিনের ব্যবধানে টাকার মান কমানো হয়েছে। গত ২৭ এপ্রিল প্রতি ডলারে কমানো হয়েছিল ২৫ পয়সা। গত সোমবার আরেক দফা কমানো হয়েছে ২৫ পয়সা। এর ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ধারিত দর উঠে গেছে ৮৬ টাকা ৭০ পয়সা, যা এক বছর আগেও ছিল ৮৪ টাকা। তবে ব্যাংকগুলো এর চেয়ে বেশি দরে লেনদেন করছে। ইতোমধ্যে ব্যাংকগুলোর ডলার সঙ্কট দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক তার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে পাঁচ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে সঙ্কটে পড়া ব্যাংকগুলোর কাছে।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, টাকার মান কমে গেলে বহুমুখী চাপে পড়ে যাবে দেশ। কারণ আমাদের অর্থনীতি আমদানি নির্ভরতা বেশি। টাকার মান কমে গেলে আমদানিকৃত পণ্যের দাম আরো বেড়ে যাবে। এতে বেড়ে যাবে স্থানীয় শিল্পের উৎপাদন ব্যয়। ফলে দেশীয় বাজারে পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। এক দিকে পণ্যের দাম বেড়ে গেলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার কারণে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাবে, অপর দিকে মানুষের আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের মূল্যের প্রতিযোগিতার সক্ষমতা কমে যাবে। সবমিলেই চাপে পড়ে যাবে সামগ্রিক অর্থনীতি। তাদের মতে, অনুৎপাদনশীল পণ্যের আমদানি কমানোর ব্যবস্থা করতে হবে। একই সাথে মূলধনী যন্ত্রপাতিসহ অন্যান্য পণ্যের আমদানির আড়ালে মুদ্রাপাচার হচ্ছে কি না তা খতিয়ে দেখতে হবে। পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রার আন্তঃপ্রবাহ বাড়ানোর জন্য বাংলাদেশী শ্রমের নতুন নতুন বাজার সৃষ্টি করতে হবে। সূত্র : নয়া দিগন্ত


পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন