গৌরব ও ঐতিহ্যের ১৮২ বছরে ঢাকা কলেজ

  20-11-2022 02:02AM

পিএনএস ডেস্ক: ‘নিজেকে জানো’ মূলমন্ত্রে ১৮৪১ সালের ২০ নভেম্বরে গোড়াপত্তন হয় দেশের প্রথম বিদ্যাপীঠ ঢাকা কলেজের। নানান চড়াই-উৎরাই আর প্রতিবন্ধকতার দেয়াল পেরিয়ে আজ (২০ নভেম্বর) ১৮২ বছরে পা রাখল ঢাকা কলেজ। শত কণ্টকাকীর্ণ পথ পাড়ি দিয়ে এই প্রতিষ্ঠানের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত সমৃদ্ধি আর সম্ভাবনার জাল বুনছেন হাজার হাজার বিদ্যার্থী। দেশ-বিদেশের অনেক মেধাবী সন্তান ধন্য হয়েছেন এই প্রতিষ্ঠানের ছাত্র হয়ে। ঐতিহ্য-গৌরবের এই দীর্ঘ পথচলায় ভাষা আন্দোলন ও স্বাধিকার আন্দোলন থেকে শুরু করে অসংখ্য গণতান্ত্রিক আন্দোলনের রাজসাক্ষী এই কলেজ। শুধু এই দেশেই নয় বরং উপ-মহাদেশের বিদ্যারণ্য প্রবীণ এক বটবৃক্ষের নাম ঢাকা কলেজ।

ঢাকা কলেজের প্রতিষ্ঠার ইতিহাস নিয়ে ১৮৬৬ সালে ঢাকায় কর্মরত ইংরেজ জয়েন্ট কালেক্টর আর্থার লয়েড ক্লে’র লেখা ‘প্রিনসিপাল হেডস অব দ্য হিস্টোরি অ্যান্ড স্ট্যাটিসটিকস অব দ্য ডাক্কা ডিভিশন’ নামক এক প্রতিবেদনে চমৎকার তথ্য পাওয়া যায়। তার লেখা এই প্রতিবেদনটি পরবর্তীতে ১৮৬৮ সালে প্রকাশিত হয়।

প্রতিবেদনটিতে বলা হয়—‘দ্য কলেজ অব ডাক্কা ফাউনডেড বায় দ্য ব্রিটিশ গভমেন্ট অব ইন্ডিয়া, ফর দ্য ইন্সট্রাকশন অব দ্য নেটিভ ইউথস অব দ্য ইস্টার্ন ডিসট্রিক্টস অব দ্য বেঙ্গল ইন ইউরোপিয়ান লিটেরেচার অ্যান্ড সায়েন্স। দ্য ফার্স্ট স্টোন অব দ্য এডিফিস ইজ লেইড বায় দ্য রাইট রেভেরেন্ড ড্যানিয়েল, লর্ড বিশপ অব কলকাতা, অ্যান্ড মেট্রোপলিটন অব ইন্ডিয়া। অন দ্য ২০ ডে নভেম্বর, এ.ডি. ১৮৪১, ইন দ্য রেইজন অব হার মোস্ট ম্যাজেস্টি।’
এছাড়াও ১৮৪১ সালের ২০ নভেম্বর কলকাতার বিশপ রেভারেন্ড ড্যানিয়েল ঢাকা কলেজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। আর ওই ভবনের নকশা করেছিলেন কর্নেল গ্যাসটিন। খাঁটি ব্রিটিশ ঢঙ আর বিলাতি ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির আদলে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানটি পালন করা হয়।

ইতিহাস পর্যালোচনা করলে ঢাকা কলেজ প্রতিষ্ঠার চমৎকার পটভূমি দেখা যায়। ইংরেজরা ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধে বিজয়ী হয়। এতে ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানি লাভ করে এতে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। এসব অঞ্চলের শাসকে পরিণত হয় তারা। ইংরেজরা নিজেদেরকে শাসক হিসেবে পরিচয় না দিলেও ১৭৭২ সালে গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিংস এই মুখোশ খুলে দিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হয়ে সরাসরি এ দেশের শাসনভার গ্রহণ করেন। পরবর্তী ৬২ বছর পর্যন্ত তারা এই অঞ্চলের অধিবাসীদের জন্য কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থাগ্রহণ করেননি। এত দীর্ঘ সময়ে এই অঞ্চলের শিক্ষাব্যবস্থা ঐতিহ্যগত ভাবেই চলছিল।

এরপর ১৮২৮ সালের ২০ আগস্ট রাজা রামমোহন রায় ব্রাহ্ম ধর্ম প্রতিষ্ঠা করেন। রামমোহন রায়ের ধর্ম প্রচারে অনেকেই এতে আকৃষ্ট হয়। মানুষের এই আগ্রহ দেখে ১৮৩০ সালে সরকার এক শিক্ষানীতি গ্রহণ করে। পরবর্তীকালে ১৮৩৫ সালে ২০ এপ্রিল দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কিত দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ ‘জেনারেল কমিটি অব পাবলিক ইনস্ট্রাকশন’ লর্ড বেন্টিকের কাচে একটি প্রতিবেদন পেশ করে। প্রতিবেদনটিতে ইংরেজি সাহিত্য ও বিজ্ঞান শিক্ষার জন্য যতগুলো সম্ভব বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করে। এই প্রতিবেদনের হাত ধরেই ১৮৩৫ সালের ১৫ জুলাই থেকে বুড়িগঙ্গার তীরে আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হয় ‘ঢাকা ইংলিশ সেমিনারি’ যেটি বর্তমানে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল নামে পরিচিত।

শিক্ষা-দীক্ষায় তুলনামূলক ভাবে পিছিয়ে থাকা এই অঞ্চলের মানুষের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে তৎকালীন সিভিল সার্জন ড. জেমস টেইলর ও ঢাকা জেলার ম্যাজিস্ট্রেট মি.গ্রান্টের ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। দীর্ঘ প্রচেষ্টায় এই বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ফলে সমাজের সামগ্রিক চিত্র বদলে যেতে থাকে৷ পাশ্চাত্যের কলাবিদ্যা, বিজ্ঞান এবং দর্শন বিষয়ে জ্ঞান লাভের পথ উন্মুক্ত হয় এদেশের মানুষের মাঝে। মানুষের ব্যাপক আগ্রহ আর সাড়া দেখে এরই পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা ইংলিশ সেমিনারী স্কুলকে একটি কলেজে বা একটি আঞ্চলিক উচ্চতর ইংরেজি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করা হয়। যার নাম দেওয়া হয়—ঢাকা সেন্ট্রাল কলেজ বা সংক্ষেপে ঢাকা কলেজ।

এরপর ঢাকা কলেজের জন্য নির্মাণ করা হয় কার্জন হল। ভিক্টোরীয় স্থাপত্যরীতি, মুঘল স্থাপত্যশৈলী আর বাংলার স্বতন্ত্র সংবেদনশীল বৈশিষ্ট্য নিয়ে তৈরি এই ভবনটি ১৯০৪ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সম্রাজ্যের প্রতিনিধি ভাইসর লর্ড কার্জন ঢাকায় এসে এর উদ্বোধন করেন।

১৯০৮ সালে এর নির্মাণ কাজ শেষ হয়। ওই বছরই ঢাকা কলেজ কার্জন হলে অভিবাসিত হয়। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার পর ঢাকা কলেজ তার সর্বস্ব দিয়ে ঠাঁই করে নেয় পুরাতন হাইকোর্টের লাট ভবনে (বর্তমান সুপ্রিমকোর্ট)৷

১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে সশস্ত্র সেনারা হাইকোর্ট ভবন দখল করে তাঁবু হিসেবে ব্যবহার শুরু করে। ১৯৪৩ সালে ইসলামিয়া ইন্টারমিডিয়েট কলেজের (বর্তমান কবি নজরুল কলেজের মূল ভবনে) কিছুদিন অস্থায়ীভাবে শিক্ষাদান কার্যক্রম চালায়। এর অল্পদিন পরেই ফুলবাড়িয়া স্টেশন সংলগ্ন সিদ্দিকবাজারে খান বাহাদুর আবদুল হাইয়ের মরিচা ধরা পুরনো দালানে কার্যক্রম শুরু করে।

এরপর ১৯৫৫ সালে তার আপন গৃহের সন্ধান পায় ঢাকা কলেজ। স্থায়ী ঠিকানা হয় মিরপুর রোড, ধানমন্ডি ঢাকা-১২০৫ এ। সে সময়ে ঢাকা কলেজের আয়তন ছিল ২৪ একর। তবে স্বৈরশাসক এরশাদ সরকারের সময় ৬ একর জমি ছেড়ে দিতে বাধ্য করা হয় ঢাকা কলেজকে। বর্তমানে ঢাকা কলেজের মোট জমির পরিমাণ ১৮.৫ একর।

১৮৪১ সালে ঢাকা কলেজ প্রতিষ্ঠার পর ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং হিন্দু কলেজের শিক্ষক জে.আয়ারল্যান্ডকে ঢাকা কলেজের প্রথম অধ্যক্ষ নিযুক্ত করা হয়। তিনি ১৮৪১ থেকে ১৮৪৩ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন।

দেশের সবচেয়ে প্রাচীন ও এই উপমহাদেশের প্রথম প্রতিষ্ঠানের দীর্ঘ পথচলায় মেধাবী তরুণদের স্বপ্নের ক্যাম্পাসের নাম ঢাকা কলেজ। তারা এখানে স্বপ্ন নিয়ে আসেন মেধার বিচ্ছুরণ ঘটাতে, সে আলোক বর্তিকায় আজও আলোকিত ঢাকা কলেজ। বর্তমানে মাধ্যমিক, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে প্রায় ২০ হাজার শিক্ষার্থী এখানে অধ্যয়নরত।

স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ১৯টি বিষয়ে শিক্ষাদান কার্যক্রম চালু রয়েছে। সেগুলো হলো—বাংলা, ইংরেজি, প্রাণিবিজ্ঞান, রসায়ন, গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, ইতিহাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি, সমাজবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, ভূগোল ও পরিবেশবিজ্ঞান, ব্যবস্থাপনা, পরিসংখ্যান, হিসাববিজ্ঞান, উদ্ভিদবিজ্ঞান, অর্থনীতি, আরবি ও ইসলামিক স্টাডিজ এবং দর্শন।
শিক্ষার্থীদের আবাসন সুবিধায় রয়েছে আটটি ছাত্রাবাস। সেগুলো হলো—উত্তর ছাত্রাবাস, দক্ষিণ ছাত্রাবাস, পশ্চিম ছাত্রাবাস, আন্তর্জাতিক ছাত্রাবাস, আক্তারুজ্জামান ইলিয়াস ছাত্রাবাস, শহীদ ফরহাদ হোসেন ছাত্রাবাস, দক্ষিণায়ন ছাত্রাবাস ও শহীদ শেখ কামাল ছাত্রাবাস।

উন্নত নতুন বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে ২০১০ সালের ১ আগস্ট থেকে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ে স্নাতকোত্তর ছাত্রদের জন্য নন-ক্রেডিট কোর্স চালু করা হয়। বর্তমানে ঢাকা কলেজে অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষসহ বিভিন্ন বিভাগে ২২০ জনের বেশি শিক্ষক রয়েছেন। কর্মরত শিক্ষকদের মধ্যে অনেকেই পিএইচডি ও এমফিলসহ অন্যান্য উচ্চতর ডিগ্রিধারী। ঢাকা কলেজে অনেক খ্যাতিমান পণ্ডিত ও শিক্ষাবিদ অধ্যায়ন করেছেন। ঢাকা কলেজের অনেক শিক্ষার্থী স্ব স্ব ক্ষেত্রে অবদানের জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবেও খ্যাতি অর্জন করেছেন।

ভাষা আন্দোলন এবং মহান মুক্তিযুদ্ধসহ জাতীয় ও ছাত্র আন্দোলনসমূহে ঢাকা কলেজের অবদান অপরিসীম। ১৯৬২ সালের গণবিরোধী শিক্ষানীতি বাতিল আন্দোলন এবং ১৯৬৯ ও ১৯৯০-এর গণঅভ্যুত্থানে এ কলেজের ছাত্র-শিক্ষকরা স্মরণীয় ভূমিকা পালন করে নজির স্থাপন করেন। উচ্চ মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে একটি সফল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে ঢাকা কলেজ নিরন্তর অবদানে সগৌরবে সমুজ্জ্বল ।

পিএনএস/এএ

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন