১৭ রমজান ঐতিহাসিক বদর দিবস : এক সোনালীতম অধ্যায়

  19-04-2022 03:03PM

পিএনএস ডেস্ক : ১৭ রমজান ঐতিহাসিক বদর দিবস। আজকের এই দিনে ইতিহাস বিখ্যাত ‘বদর যুদ্ধ’ সংঘটিত হয়েছিল। হিজরতের পর মদিনায় ইসলামের দৃঢ় প্রতিষ্ঠা ও প্রসার, হজরত মোহাম্মদ সা:-র প্রভাব প্রতিপত্তি বৃদ্ধি ও কর্মকাণ্ডে সাফল্য লাভ এবং মদিনা নগরীর শাসন-শৃঙ্খলা উন্নতি বিধানে মক্কার কুরাইশদের মনে তীব্র অসন্তোষ ও ক্ষোভের সঞ্চার হয়। এই ঈর্ষা ও শত্রুতা থেকেই পৌত্তলিক মক্কাবাসী মহানবী সা:-র সাথে প্রথম যে সংঘর্ষের সূত্রপাত ঘটায় ইসলামের ইতিহাসে তা ’গাজওয়ায়ে বদর’ বা বদর যুদ্ধ নামে পরিচিত।

বদর যুদ্ধের কারণসমূহ :

মক্কার কুরাইশদের শত্রুতা; আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের ষড়যন্ত্র, মদিনার ইহুদিদের ষড়যন্ত্র, আর্থিক কারণ, নাখলার খণ্ডযুদ্ধ, আবু সুফিয়ানের কাফেলা আক্রমণের মিথ্যা গুজব।

বদর যুদ্ধের ঘটনা :

উপরোক্ত প্রেক্ষাপটের ভিত্তিতে নবী মোহাম্মদ সা: কর্তৃক আনসার এবং মুহাজির নিয়ে গঠিত মাত্র ৩১৩ জনের একটি মুসলিম বাহিনী কুরাইশ বাহিনীর মোকাবেলা করার জন্য প্রেরিত হযন। মদিনা থেকে ৮০ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে বদর উপত্যকায় দ্বিতীয় হিজরির ১৭ রমজান (৬২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১৩ মার্চ) মুসলিম বাহিনীর সাথে বিধর্মী কুরাইশদের সংঘর্ষ হয়। হজরত মোহাম্মদ (সা:) স্বয়ং নিজে এ যুদ্ধ পরিচালনা করেন।

হজরত মোহাম্মদ সা: মুসলিম সৈন্য সমাবেশের জন্য এমন একটি স্থান বেছে নেন যেখানে সূর্যোদয়ের পর যুদ্ধ শুরু হলে কোনো মুসলমান সৈন্যের চোখে সূর্য-কিরণ পড়বে না।

প্রথমে প্রাচীন আরব রেওয়াজ অনুসারে মল্লযুদ্ধ হয়। মহানবীর নির্দেশে হজরত আমির হামজা, হজরত আলী ও আবু ওবায়দা কুরাইশ পক্ষের নেতা উতবা, শায়বা এবং ওয়ালিদ বিন উতবার সাথে মল্লযুদ্ধে অবতীর্ণ হন। এতে শত্রুপক্ষীয় নেতৃবৃন্দ শোচনীয়ভাবে পরাজিত ও নিহত হয়।

উপায়ান্তর না দেখে আবু জেহেলের নেতৃত্বে কুরাইশগণ মুসলমানদের পর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারা মুসলমানদের ওেপর প্রচণ্ডভাবে আক্রমণ চালাতে লাগলো, কিন্তু প্রতিকূল অবস্থায়ও সংঘবদ্ধ ও সুশৃঙ্খল মুসলিম বাহিনীর মোকাবেলা করা কুরাইশদের পক্ষে সম্ভব হয়নি।

১৭, ১৯ এবং ২১ রমজান এই তিন দিনই অসামান্য রণ-নৈপুণ্য অপূর্ব বিক্রম ও অপরিসীম নিয়মানুবর্তিতার সাথে যুদ্ধ করে মুসলমানগণ বদরের গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধে বিধর্মী কুরাইশগণকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে। যুদ্ধে ৭০জন কুরাইশ সৈন্য নিহত হয় ও সমসংখ্যক সৈন্য বন্দী হয়। অপরদিকে মাত্র ১৪জন মুসলিম সৈন্য শাহাদাত বরণ করেন।

উল্লেখ্য, এ যুদ্ধে আবু জেহেল নিহত হয়। যুদ্ধবন্দীদের প্রতি মহানবী হজরত মোহাম্মদ সা: মহানুভবতার পরিচয় দেন। হজরত মোহাম্মদ সা: বন্দীদের সাথে কোনো প্রকার নির্দয় ব্যবহার করা নিষিদ্ধ করেছিলেন। মুক্তিপণ গ্রহণ করে কুরাইশ বন্দীদেরকে মুক্তি প্রদান করা হয়।

মাত্র ৪০০০ দিরহাম মুক্তিপণ নির্ধারিত হয়। যারা মুক্তিপণ দিতে অক্ষম তারা মুসলমানদের বিরোধিতা না করার প্রতিশ্রুতি প্রদান করে ও মুসলমান বালককে শিক্ষাদান করার অঙ্গীকার করে মুক্তি লাভ করে।

উল্লেখ্য, উকবা ও আরেকজনকে মোহাম্মদ সা:-এর বিরুদ্ধে শত্রুতা এবং ইসলামের অমর্যাদা করার জন্য প্রাণদণ্ড দেয়া হয়।

বদর যুদ্ধের গুরুত্ব :

বদরের যুদ্ধ ইসলামের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় এবং বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাসে বদরের যুদ্ধ অনন্য অবস্থান দখল করে রেখেছে। এই যুদ্ধে সত্যের সাথে মিথ্যার, ন্যায়ের সাথে অন্যায়ের, মুসলিম-মুমিনদের সাথে কাফির-মুশরিকদের পার্থক্য সূচিত হয়।

এ যুদ্ধ ছিল ইসলামের সর্বপ্রথম সামরিক বিজয়ের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। এতদিন কুরাইশগণ ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়ে মনে করত যে, মোহাম্মদ সা:-কে সামরিক শক্তি পরীক্ষার জন্য আহ্বান করলেই তার সমস্ত ক্ষমতার অবসান ঘটবে। তারা এখন নিজেদের ভুল বুঝতে পারল।

বদরের প্রান্তরে মোহাম্মদ সা:-এর রাজনৈতিক সূক্ষ্মদর্শিতা এবং সামরিক বিচক্ষণতার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হলো। হজরত মোহাম্মদ সা: যে শুধুমাত্র আধ্যাত্মিক সুপ্তিতেই অচেতন নয়, পার্থিব ঘটনাবলীর বিচারে তিনি যে একজন যোগ্যতম জননেতা, তা প্রমাণ হলো।

বদর বিজয়ের ফলে মুসলিম রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপিত হলো। এ যুদ্ধে মাত্র ৩১৩ জন মুসলমান মক্কার প্রায় এক সহস্র বীর সেনাদেরকে পর্যুদস্ত করে ইসলামের জয়যাত্রার পথ পরিষ্কার করেছিল। জিহাদে অংশগ্রহণ যে ধর্মীয় কার্য তা মুসলমানেরা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করল। তারা নিশ্চিত হলো যে, মোহাম্মদ সা:-এর বাণী অক্ষরে অক্ষরে সত্য। বিধর্মীদের আক্রমণ প্রতিহত করতে গিয়ে তারা উপলব্ধি করতে পেরেছিল যে, আল্লাহ স্বয়ং তাদেরকে সহায়তা করেন।

বদরের যুদ্ধ মুসলমানদের হৃদয়ে অচল-অটল আত্মবিশ্বাসের সৃষ্টি করলো। এই আত্মবিশ্বাসের ফলে মুসলমানগণ পরবর্তী অভিযানসমূহে জয়ী হয়েছিলেন। জিহাদে শহীদ হওয়ার প্রেরণা এবং পারোলৌকিক পুরস্কার লাভের বাসনা তাদের পরবর্তীসময়ে বিজয়গুলোকে ত্বরান্বিত করেছিল। বদর যুদ্ধের মাধ্যমে ইসলাম ধর্ম বিস্তারের পথ প্রসারিত হয়েছিল। এই সময় হতে ইসলামের অভাবিতপূর্ব সম্প্রসারণ ঘটে।

বদর যুদ্ধের শিক্ষা :

বদর যুদ্ধ মুসলমানকে সর্বাবস্থায় আল্লাহর সাহায্য কামনা করতে শেখায়। বদরের যুদ্ধ স্মরণ করিয়ে দেয় যে, আল্লাহর ওপর দৃঢ় ঈমান ও নির্ভরতাই মুসলমানদের বিজয়ের মূল হাতিয়ার।

বদরের যুদ্ধ ইসলামকে সমুন্নত রাখার জন্য কাফির-মুশরিকদের বিরুদ্ধে জিহাদ করার নির্দেশ দেয়।

বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে মুসলিমরা ইসলামবিদ্বেষীদের কর্তৃক জুলুম নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন এবং ইসলাম বিদ্বেষীরা ইসলামের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে। আর মুসলমানরা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে নীরবে বসে আছে। তা মোটেও ইসলামের শিক্ষা নয়।

বরং আমাদের উচিত বদর যুদ্ধের ন্যায় জুলুমের মোকাবেলায় আল্লাহর সাহায্য চাওয়ার পাশাপাশি ধৈর্য, হেকমত অবলম্বনসহ ইসলামের সৌন্দর্যকে গোটা বিশ্বের সামনে তুলে ধরা এবং দ্বীন প্রচারের নিমিত্তে সহাবস্থান করা। তাহলে ইসলাম বিদ্বেষীরা একসময় ইসলামের ছায়াতলে আসবে নতুবা পিছু হটতে বাধ্য হবে। সুতরাং বলা যায় যে, সব যুগে বদর যুদ্ধ থেকে শিক্ষা নেয়ার প্রয়োজন থাকবে।

আল্লাহ মুসলিমদেরকে বদর যুদ্ধের শিক্ষা গ্রহণ করে বাস্তব জীবনে তা প্রয়োগ করার তাওফিক দান করুন। আমীন।

পিএনএস/আলাউদ্দিন

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন