রাসূল সা: সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর বক্তব্য

  30-12-2022 09:22AM


পিএনএস ডেস্ক : বিশ্বের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব কে? এই প্রশ্নের জবাবে মুসলমানরা অবশ্যই বলবেন- হজরত মুহাম্মদ সা:। বিশ্বের বাদবাকি ৬০০ কোটি মানুষ কার নাম উল্লেখ করবেন? আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই, তারাও বলবেন- হজরত মুহাম্মদ সা:। কথাটি সত্য কি না তা পরীক্ষা করার জন্য এবার আসুন ইন্টারনেটের সবচেয়ে শক্তিশালী সার্চ ইঞ্জিন গুগুল কী বলে। গুগুল মাত্র ০.৫৪ সেকেন্ডে ৩০২ কোটি ডাটা উপাত্ত থেকে বেছে মাত্র ১০টি জগদ্বিখ্যাত নাম হাজির করল, যার প্রথম নামটি হলো বিশ্বের প্রায় ২০০ কোটি মুসলমানের প্রাণস্পন্দন, আখেরি নবী, দু’জাহানের বাদশাহ, যাঁকে মহান আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জত ‘রাহমাতাল্লিল আলামিন’ বলে ঘোষণা দিয়েছেন, সেই আরবের মক্কার কুরাইশ বংশের আব্দুল্লাহর পুত্র মুহাম্মদ সা:।

কিছু অজ্ঞ, জ্ঞানপাপী, ধর্মান্ধ ও নাস্তিক ছাড়া জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে প্রাচ্য ও প্রতিচ্যের সব জ্ঞানী, গুণী ও মহাজন একবাক্যে হজরত মুহাম্মদ সা:-কে সর্বকালের সর্বশেষ্ঠ মহামানব বলে অভিহিত করে তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছেন। তারা তাঁর প্রচারিত ধর্মকে শ্রেষ্ঠ ধর্ম তথা জীবন বিধান বলে শুধু স্বীকৃতিই দেননি, সামর্থ্য থাকলে কার্যকর করার বাসনাও ব্যক্ত করেছেন। বিশ^বিখ্যাত এসব ব্যক্তির নামের তালিকা দিয়ে আমি পাঠকদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটাতে চাই না।


প্রিয় পাঠক, সারা বিশ্ব যাকে একবাক্যে সর্বকালের সর্ব শ্রেষ্ঠ মহামানব বলে স্বীকার করে এবং মহান আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জত যাকে ‘রাহমাতাল্লিল আলামিন’ ও ‘ইন্নাকা লাআলা খুলুকিল আজিম’, ‘ওয়া রাফাআনা লাকা জিকরাক’ ও ‘ইয়া আইউহাল্লাজিনা আমানু সাল্লুআলাইহি ওয়া-সাল্লিমু তাসলিমা’ বলেছেন, সেই আল্লাহর আরশচুম্বী মর্যাদার অধিকারী মহামানবকে বাংলাদেশেরই মুসলমান নামধারী তথাকথিত এক উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তি কিভাবে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, এমনকি বছরের পর বছর ধরে অতি নোঙরা ভাষায় গালাগাল করে পার পেয়ে যেতে পারে তা আমার বোধগম্য নয়। তার নোঙরা কথাগুলো বলার মতো নয়। কিন্তু লেখার খাতিরে তা আমি আর উল্লেখ না করে পারলাম না।


এতক্ষণ আমি যার কথা বলছিলাম তিনি হলেন ডক্টর এ কিউ এম মাহবুবুল্লা যশোরী। তিনি (তার কথা অনুযায়ী) একজন কুরআনে হাফেজ, মাওলানা, মুহাদ্দিস ও মুফাসসির। লেখাপড়া করেছেন দারুল উলুম দেওবন্দ, করাচি বিশ^বিদ্যালয় ও আল-আজহার বিশ^বিদ্যালয়ে। আহলে কুরআন দাবিদার লোকটি তার ইউটিউব চ্যানেলে বলেছেন, ‘আরব্য ইবলিশ মুহম্মদ, শয়তান মুহম্মদ, কুরআনবিরোধী মুহম্মদ, ইতিহাসের মুহম্মদ, হাদিসের মুহম্মদ, পয়দাই হয়েছে কুরআনের মোহাম্মাদুর রাসূলূল্লাহর নামে মিথ্যাচার করার জন্য। তার হাদিসের পাতায় পাতায় কুরআনের সাথে সাংঘর্ষিক বিষয় দেখতে পাই। তার ইতিহাসের পাতায় তার ফলসাফার পাতায় কুরআনের সাথে সাংঘর্ষিক সব সময় দেখতে পাই।’


শুধু তাই নয়, তিনি উম্মাহাতুল মুমিনিন হজরত আয়েশা রা: ও নবীজীর পালিত পুত্র জায়েদের স্ত্রীকে আল্লাহর নির্দেশে বিয়ে করার প্রসঙ্গ টেনে তার কোমল ও পূতপবিত্র চরিত্রের ওপর কালিমা লেপনের যে ভয়াবহ দুঃসাহস দেখাচ্ছেন ও নিজেকে কুরআনের ধারক-বাহক এমনকি প্রকারান্তরে নিজেকে কুরআনের মুহাম্মদ বলে দাবি করে কুরআনের অপব্যাখ্যা দিয়ে রাষ্ট্র ও সমাজে যেভাবে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির প্রয়াস পাচ্ছেন তা দেশ ও জাতির জন্য একটি অশনি সঙ্কেত বলে আমি মনে করি।

আমি বহুদিন থেকে কুরআনুল কারিমের সূরা-বাকারার ২৬ নম্বর আয়াতের ‘ইউদিললুবিহি কাছিরান ওয়া ইয়াহদিবিহি কাছিরান, ওয়ামা ইউদিললুবিহি ইল্লাল ফাসিকিন’ অর্থাৎ- (এর (কুরআন) দ্বারা তিনি কাউকে গোমরাহ করেন আর কাউকে হিদায়াত দান করেন এবং ফাসিক ব্যতীত কাউকে তিনি গোমরাহ করেন না) এ ব্যাপারে চিন্তাফিকির করছিলাম। কিন্তু তার মর্মার্থ কিছুতেই উপলব্ধি করতে পারছিলাম না। কুরআন পড়ে মানুষ হিদায়াতপ্রাপ্ত হবে এটিই স্বাভাবিক, কিন্তু কিভাবে গোমরাহ হবে তা আমার বোধগম্য হচ্ছিল না। মাহবুবুল্লাহ যশোরীর বক্তব্য শোনার পর বিষয়টি আমার কাছে পরিষ্কার হলো।

তিনি কতটা বিভ্রান্ত তার একটি নমুনা তার কথা থেকেই আমি পাঠকের সামনে তুলে ধরছি। তিনি বলেন- লোকে তাকে প্রশ্ন করে ‘আপনি দাড়ি রাখেন না কেন?’ জবাবে তিনি বলেন, ‘কুরআনের কোথাও দাড়ি রাখার কথা নেই।’ তাই তিনি দাড়ি রাখেন না। তার বিভ্রান্তির মাত্রা বোঝার জন্য আমি একটি প্রসঙ্গের অবতারণা না করে পারছি না। তিনি ইতিহাসের মুহাম্মদ আর কুরআনের মুহাম্মদের মধ্যে চীনের বা বার্লিন প্রাচীরের মতো একটি মস্ত দেয়াল তুলেছেন। তুলেছেন এ কারণে যে, পবিত্র কুরআনে মুহাম্মদের ঠিকানা বলা হয়নি কেন এ কারণে। তাই তিনি মুহাম্মদকে প্রপার নাউন হিসেবে না ধরে অ্যাডজেক্টিভ হিসেবে নিয়েছেন। আর সেই অ্যাডজেক্টিভ মোতাবেক তিনি মুহাম্মদকে সেই প্রশংসিত ব্যক্তি বা সত্তাকে মনে করেন যিনি লৌহে মাহফুজে সংরক্ষিত কুরআনের প্রচার ও প্রসারের কাজে নিয়োজিত হবেন। অতএব যে বা যিনিই অর্থাৎ ‘ক’, ‘খ’, ‘গ’ যিনিই এই পবিত্র গ্রন্থের প্রচার ও প্রসার ঘটাবেন এবং মেনে চলবেন তিনিই হবেন সেই প্রশংসিত ব্যক্তি তথা মুহাম্মদ। এটি আমার কথা নয়, এটি তার মনগড়া ব্যাখ্যা। এর দ্বারা প্রকারান্তরে সে নিজেকেই মুহাম্মদ রাসূল বলে দাবি করছেন বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। অথচ, সারা দুনিয়ার মুসলমান অমুসলমান নির্বিশেষে সবাই একবাক্যে স্বীকার করবেন, এই কুরআন নাজিল হয়েছিল মক্কার কুরাইশ বংশের আব্দুল মুত্তালিবের পুত্র আব্দুল্লাহর ঔরসজাত ও মা আমিনার গর্ভজাত পুত্র, নবী-রাসূলদের সর্দার, দু’জাহানের বাদশাহ, মক্কার জনপদে আল-আমিন তথা সত্যবাদী খ্যাত ‘রাহমাতাল্লিল আলামিন’ মুহাম্মদ সা:-এর ওপর।


পবিত্র কুরআন যদি তথাকথিত প্রশংসিত ব্যক্তির ওপরই নাজিল হয়ে থাকে তাহলে সূরা আহজাবের ২৮, ২৯, ৩০, ৩৭, ৫০ ও ৫১ নম্বর আয়াতে যাদের প্রসঙ্গ আনা হয়েছে সেই তথাকথিত প্রশংসিত ব্যক্তিরা কোনোভাবেই কি সেগুলোর বিষয়বস্তুর সাথে সম্পৃক্ত হতে পারেন? ২৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- ‘হে নবী, তুমি তোমাদের স্ত্রীদের বলো, তোমরা যদি পার্থিব জীবন ও তার ভোগ-বিলাস কামনা করো তাহলে এসো, আমি তোমাদের (তার কিছু অংশ) দিয়ে দেই এবং সৌজন্যের সাথে তোমাদের বিদায় করে দেই।’ ২৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- ‘আর যদি তোমরা আল্লাহ তায়ালা, তাঁর রাসূল ও পরকাল কামনা করো তাহলে (জেনে রাখো), তোমাদের মধ্যে যারা সৎকর্মশীল, আল্লাহ তায়ালা তাদের জন্য মহাপুরস্কার রেখেছেন।’ ৩০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- ‘হে নবীপতœীরা, তোমাদের মধ্যে যারা খোলাখুলি কোনো অশ্লীল কাজ করবে, তার শাস্তি দ্বিগুণ করে দেয়া হবে; আর এ কাজ আল্লাহ তায়ালার জন্য অত্যন্ত সহজ।’

পালিত পুত্র জায়েদের তালাক দেয়া স্ত্রীকে বিয়ে করার ক্ষেত্রে লোকলজ্জার ভয় করছিলেন বিধায় আল্লাহ ৩৭ নম্বর আয়াতে তাঁর নবীকে উদ্দেশ করে বলেন- ‘তুমি মানুষদের কথাকেই ভয় করছিলে, অথচ (তুমি জানো) আল্লাহ তায়ালাই হচ্ছেন ভয় পাওয়ার আসল হকদার...।’ এ ছাড়া ৫০ ও ৫১ নম্বর আয়াতে বিয়ের ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা নবীজিকে কতগুলো স্পেশাল সুযোগ-সুবিধা দেয়ার কথা বলেছেন। এ আয়াতগুলো একমাত্র ইতিহাসের মুহাম্মদ তথা মক্কার আব্দুল্লাহ আর মা আমিনার পুত্র মুহাম্মদের ব্যাপারেই খাটে। অন্য কাউকে এ স্থানে বসালে এ আয়াতগুলো কোনো অর্থই বহন করবে না, অর্থাৎ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়বে।
তার এ বক্তব্য যে বিভ্রান্তিকর ও অন্তঃসারশূন্য তা প্রমাণ করতে আমি আরো ডজন ডজন আয়াত তুলে ধরতে পারি। কিন্তু লেখার কলেবর বৃদ্ধি পেয়ে পাঠকের ধৈর্যচ্যুতির আশঙ্কায় আমি তা থেকে বিরত রইলাম।


পরিশেষে আমি লোকটির এ ধরনের জঘন্য বিভ্রান্তিকর বক্তব্য পরিহার করার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। পাশাপাশি আলেম সম্প্রদায়কে তার মনগড়া কুরআনের ব্যাখ্যার পাল্টা সমুচিত জবাব দেয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। তদুপরি রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষার এবং ধর্মীয় সঙ্ঘাত সহিংসতা উসকে দেয়া থেকে তাকে বিরত রাখার জন্য তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ২৯৫ (ক) ধারা ও ২০১৮ সালের ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের ২৮ ও ৩১ ধারা মোতাবেক যথাবিহিত আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সরকারে প্রতি জোর দাবি জানাচ্ছি। এই ব্যক্তি মূলত তার একটি ইউটিউব চ্যানেলের (অন দ্যা ওয়ে টু কুরআন অ্যান্ড কাবা) মাধ্যমে বক্তব্যগুলো প্রচার করে আসছেন।
ড. এ কিউ এম মাহবুবুল্লাহ নিজের দেয়া পরিচয় থেকেই জানা যায়, তার পিতা-আল্লামা নুরুল ইসলাম ফারুকী গ্রাম-বুড়িহাটি (বুড়িহাটি ফারুকীপল্লী), কেশবপুর, যশোর। জন্ম ১৯৬৮ সাল। (শেখপাড়া জামে মসজিদের কাছে)। লেখাপড়া-ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ, পাকিস্তানের ইউনিভার্সিটি অব করাচি ও মিসরের আল-আজহার ইউনিভার্সিটি।

পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন