আল্লাহর ভালোবাসার অভিজ্ঞান

  25-08-2023 01:04PM




পিএনএস ডেস্ক: আল্লাহ তায়ালা আপনাকে ভালোবাসেন কি না, তা বুঝবেন কিভাবে? নিচের চারটি নিদর্শন যদি আপনার মধ্যে পাওয়া যায়, তাহলে বুঝবেন আল্লাহ আপনাকে ভালোবাসেন। কারো মধ্যে এই লক্ষণগুলো যদি না-ই পাওয়া যায়, তার হতাশ হওয়ার কোনো কারণ নেই। আপনি আল্লাহর ভালোবাসা পাওয়ার জন্য এগুলো অর্জন করার চেষ্টা করুন। কুরআন ও রাসূল সা:-এর সুন্নাহ অনুযায়ী জীবন গঠন করুন, দেখবেন আপনার মধ্যে লক্ষণগুলো পরিস্ফুট হচ্ছে। আরেকটি প্রাসঙ্গিক বিষয় বলে রাখি, এই লক্ষণগুলো আল্লাহর যে-ই বান্দার মধ্যে পাবেন, আপনি তার সাথে সঙ্ঘবদ্ধ হোন। ইনশাআল্লাহ আপনিও সেই চরিত্রে প্রতিফলিত হতে পারবেন।

লক্ষণগুলো হচ্ছে নিম্নরূপ :
মানুষ তাকে ভালোবাসে : আল্লাহ যখন তার কোনো বান্দাকে ভালোবাসেন তখন তিনি জিবরাঈল আ:-কে ডেকে বলেন, ‘হে জিবরাঈল! আমি অমুক ব্যক্তিকে ভালোবাসি, সুতরাং তুমিও তাকে ভালোবাসো।’ হজরত জিবরাঈল আমিন তখন আকাশবাসীকে ডেকে বলেন, হে আকাশবাসী! আল্লাহ অমুক ব্যক্তিকে ভালোবাসেন; সুতরাং তোমরাও তাকে ভালোবাসো। তখন আকাশবাসীরাও তাকে ভালোবাসেন। এর ফলে জমিনবাসীও তাকে ভালোবাসতে থাকে।

আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসূলল্লাহ সা: বলেছেন, ‘আল্লাহ তায়ালা যদি কোনো বান্দাকে পছন্দ করেন তখন জিবরাঈল আ:-কে ডেকে বলেন- ‘নিশ্চয়ই আমি অমুক লোককে পছন্দ করি, তুমিও তাকে পছন্দ করো।’ তিনি বলেন, তখন জিবরাঈল আ: তাকে পছন্দ করেন। অতঃপর তিনি আকাশমণ্ডলীতে ঘোষণা দিয়ে বলেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ অমুক লোককে পছন্দ করেন, সুতরাং আপনারাও তাকে পছন্দ করুন। তখন আকাশবাসীরা তাকে পছন্দ করেন। তিন বলেন, এরপর দুনিয়াতে তাকে নন্দিত, সমাদৃত করা হয়। আর আল্লাহ যদি কোনো লোকের ওপর রাগ করেন তখন জিবরাঈল আ:-কে ডেকে বলেন- ‘আমি অমুক বান্দার ওপর রাগ করেছি, তুমিও তার প্রতি নারাজ হও।’ তিনি বলেন, তখন জিবরাঈল আ: তার ওপর রাগান্বিত হন। তারপর তিনি আকাশবাসীদের ডেকে বলেন, নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা অমুকের ওপর রাগান্বিত। কাজেই আপনারাও তার ওপর ক্রোধান্বিত হোন। তিনি বলেন, তখন লোকেরা তার ওপর দুশমনি পোষণ করে। তারপর তার জন্য পৃথিবীতে শত্রু বানিয়ে দেয়া হয়।’ (মুসলিম-৬৫৯৮, বুখারি-৩২০৯, ৬০৪০,৭৪৮৫)

প্রশ্ন জাগতে পারে, অন্যান্য ব্যক্তিরাও তো জনপ্রিয় হতে দেখা যায়। তাহলে হাদিসে কোন ভালোবাসার কথা বলা হয়েছে? প্রকৃতপক্ষে এই ভালোবাসা হচ্ছে নেককার ও মু’মিনদের ভালোবাসা। যাদের ভালোবাসার মানদণ্ড হচ্ছে আল্লাহ তায়ালা। অর্থাৎ তারা আল্লাহর জন্য ভালোবাসে আবার আল্লাহর জন্যই কাউকে ঘৃণা করে।

বিপদ-আপদ লেগে থাকবে : আল্লাহর ভালোবাসার দ্বিতীয় লক্ষণ হচ্ছে- তিনি তাঁর ভালোবাসার লোকটিকে বিপদ-আপদ দিয়ে পরীক্ষা করতে থাকেন। আল্লাহর খলিল হজরত ইবরাহিম আ:-কে একটির পর একটি পরীক্ষায় নিক্ষেপ করে আল্লাহ তাঁর ভালোবাসার নিদর্শন সুস্পষ্ট করেছেন। আর ইবরাহিম আ: সবকিছু থেকে তাঁর আল্লাহকে বেশি ভালোবাসেন কি না তারও পরীক্ষা নেয়া হয়েছে। সব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ভালোবাসার প্রমাণ তিনি দিয়েছেন। পৃথিবীর যেসব বস্তুকে মানুষ ভালোবাসতে পারে এমন প্রতিটি বস্তুকে হজরত ইবরাহিম আ: সত্যের জন্য কোরবানি করেছিলেন। দুনিয়ার যেসব বিপদকে মানুষ ভয় করে সত্যের খাতিরে তার প্রত্যেকটিকে তিনি বরণ করে নিয়েছিলেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘স্মরণ করো যখন ইবরাহিমকে তার রব কয়েকটি ব্যাপারে পরীক্ষা করলেন এবং সেসব পরীক্ষায় সে পুরোপুরি উতরে গেল, তখন তিনি বললেন- ‘আমি তোমাকে সব মানুষের নেতার পদে অধিষ্ঠিত করব।’

ইবরাহিম বলল, ‘আর আমার সন্তানদের সাথেও কি এই অঙ্গীকার? জবাব দিলেন- ‘আমার এ অঙ্গীকার জালেমদের ব্যাপারে প্রযোজ্য নয়।’ (সূরা বাকারাহ-১২৪) আল্লাহর ভালোবাসায় আপ্লুত নবীকে আল্লাহ কত কঠিন পরীক্ষায় ফেলেছেন, তা কমবেশি আমরা সবাই জানি। সুতরাং মু’মিনদের আল্লাহ বিপদ দেন পরীক্ষাস্বরূপ। আল্লাহর ভালোবাসাকে প্রমাণ করার জন্য মু’মিনরা এই বিপদ-আপদকে পরীক্ষা হিসেবেই গ্রহণ করেন। আর নাফরমানদের ওপর কোনো বিপদ-আপদ এলে, সেটি আল্লাহ গজব হিসেবেই দেন।

ধনসম্পদের প্রতি অনীহা :আল্লাহ যাকে ভালোবাসেন তার তৃতীয় বৈশিষ্ট্য হলো- তিনি দুনিয়ার মোহে বিভোর হন না। পদ-পদবি, বিত্ত-বৈভব, প্রভাব-প্রতিপত্তির প্রতি তার কোনো লোভ-লালসা থাকবে না। নিজেকে পুরোপুরি আল্লাহর কাছে সোপর্দ করে দেয়। আল্লাহই হন তার ভরসার মূল কেন্দ্রবিন্দু। তাই বলে তিনি বৈরাগ্য জীবন যাপন করেন না; বরং বৈধভাবে যতটুকু সম্পদ হাতে আসে তাতেই তিনি সন্তুষ্ট থাকেন। অবৈধভাবে দুনিয়া উপার্জনের হাজার সুযোগ-সুবিধাকে তিনি পায়ে ঠেলে দেন। মনের দিক থেকে তিনি ঐশর্যশালী। আল্লাহর ভালোবাসার জন্য দুনিয়ার সব অভাব-অনটন ও দুঃখ-কষ্টকে হাসিমুখে বরণ করে নেন। আল্লাহ তাঁর এই প্রিয় বান্দার জন্য দুনিয়াকে তিক্ত করে দেন এবং সব অবৈধ কাজ থেকে তাকে বিরত রাখেন।

যাদেরকে আল্লাহ ভালোবাসেন তারা ভালো করেই জানে যে, পার্থিব জীবন আখিরাতকে ভুলিয়ে দেয়, তাই তারা সে দিকে পা বাড়ায় না। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘এ কথা সত্য, যারা আমার সাক্ষাতের আশা পোষণ করে না এবং পার্থিব জীবনেই পরিতৃপ্ত ও নিশ্চিন্তে থাকে আর আমার নিদর্শনগুলো থেকে গাফেল, তাদের শেষ আবাস হবে জাহান্নাম এমন সব অসৎকাজের কর্মফল হিসেবে যেগুলো তারা ক্রমাগতভাবে আহরণ করত।’ (সূরা ইউনুস : ৭-৮) অর্থাৎ যারা কখনো নিজেদের সারা জীবনের সব কাজের শেষে একদিন আল্লাহর কাছে তার হিসাব পেশ করার ভয় করে না, যারা এ ধারণার বশবর্তী হয়ে কাজ করে যায় যে, দুনিয়ার সব কাজকারবার ও তার হিসাব-নিকাশ এ দুনিয়ার জীবনেই শেষ, যাদের দৃষ্টিতে দুনিয়ায় মানুষ যে পরিমাণ সমৃদ্ধি, সুখ ঐশর্য, খ্যাতি ও শক্তিমত্তা লাভ করতে সক্ষম হয়েছে শুধু তারই ভিত্তিতে তার সাফল্য ও ব্যর্থতা বিচার্য এবং যারা নিজেদের বস্তুবাদী ধ্যানধারণার কারণে আল্লাহর আয়াতের প্রতি দৃষ্টি দেয়ার প্রয়োজন বোধ করে না, তাদের সারা জীবন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন, (সে দিন দুনিয়াপূজারিরা বলবে) ‘আজ আমার অর্থসম্পদ কোনো কাজে এলো না। আমার সব ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি বিনাশপ্রাপ্ত হয়েছে। (আদেশ দেয়া হবে) পাকড়াও করো ওকে আর ওর গলায় বেড়ি পরিয়ে দাও।’ (সূরা হাক্বাহ : ২৮-৩০) এ জন্য আল্লাহ যাদেরকে ভালোবাসেন, তার মধ্যে দুনিয়ার অর্থ-যশ, ক্ষমতা ও প্রতিপত্তির লোভ সংবরণ করার ক্ষমতা দান করেন। নিজের প্রয়োজন পূরণের পর সে আর আগে বাড়ে না।

দ্বীনি জ্ঞানের অধিকারী এবং সেই অনুযায়ী আমলকারী : আল্লাহ যাকে ভালোবাসেন তার চতুর্থ নিদর্শন হচ্ছে তিনি ইলমে দ্বীনে পরিপক্বতা লাভ করবেন এবং ইলমের সাথে সাথে সর্বোচ্চ আমলদারও হবেন। হুমায়েদ ইবনে আব্দুর রহমান রহ: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, আমি মুয়াবিয়া রা:-কে খুতবায় বলতে শুনেছি, তিনি বলেন, আমি নবী সা:-কে বলতে শুনেছি, আল্লাহ যার কল্যাণ চান তাকে দ্বীনের ইলম দান করেন। আমি তো বিতরণকারী মাত্র, আল্লাহই (জ্ঞান) দাতা। সর্বদাই এ উম্মত কিয়ামত পর্যন্ত আল্লাহর হুকুমের ওপর কায়েম থাকবে, বিরোধিতাকারীরা তাদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।’ (বুখারি-৭১, কিতাবুল ইলম, বাবু মাই ইয়ুরিতিল্লাহ...মুসলিম-১০৩৭, আহমাদ) মানুষের জ্ঞানের পরিধি যত বিস্তৃতি লাভ করে, আল্লাহভীতি তত বেশি বৃদ্ধি পায়। আর সেই জ্ঞান হলো- তাওহিদ, আল্লাহর ক্ষমতা, আল্লাহর গুণাবলি, রিসালাত ও আখিরাতের জ্ঞান। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘আসল ব্যাপার হচ্ছে, আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে একমাত্র জ্ঞানসম্পন্নরাই তাকে বেশি ভয় করে। নিঃসন্দেহে আল্লাহ পরাক্রমশালী এবং ক্ষমাশীল।’ (সূরা ফাতির-২৮) আল্লাহর শক্তিমত্তা, জ্ঞান-প্রজ্ঞা ও বিজ্ঞানময়তা, ক্রোধ, পরাক্রম সার্বভৌম কর্তৃত্ব ক্ষমতা ও অন্যান্য গুণ সম্পর্কে যে ব্যক্তি যত বেশি জানবে সে তত বেশি তার নাফরমানি করতে ভয় পাবে। তাই জ্ঞানবানরা বেশি আমলদার হন। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘সাচ্চা ঈমানদার তো তারাই আল্লাহকে স্মরণ করা হলে যাদের হৃদয় কেঁপে ওঠে। আর আল্লাহর আয়াত যখন তাদের সামনে পড়া হয়, তাদের ঈমান বেড়ে যায় এবং তারা নিজেদের রবের ওপর ভরসা করে।’ (সূরা আনফাল-২)

যখনই আল্লাহর কিতাব ও তাঁর রাসূলের হেদায়াত সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করে তখন তার ইচ্ছা আশা-আকাক্সক্ষা, চিন্তাচেতনা, মতবাদ, পরিচিত আচার-আচরণ, স্বার্থ, আরাম-আয়েশ, ভালোবাসা ও বন্ধুত্ব বিরোধী হলেও সেগুলো মেনে নিয়ে আল্লাহ ও রাসূলের বিধান পরিবর্তন করার পরিবর্তে নিজেকে বদলে নেয় এবং তা গ্রহণ করতে গিয়ে কষ্ট স্বীকার করে নেয়; তখন তার ঈমান তরতাজা ও পরিপুষ্ট হয়। আল্লাহর ভয় তাকে তাড়া করে ফেরে।লেখক : শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট


পিএনএস/আনোয়ার



@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন