পরকীয়া ও গ্যাসলাইটিং এর সম্পর্ক

  18-12-2021 05:03PM

পিএনএস ডেস্ক: মিসেস সুমি (ছদ্ম নাম) ডিপ্রেশন বা বিষন্নতা নিয়ে চেম্বারে এসছেন। তার বিষন্নতার কারণ আছে। তার স্বামী অন্য এক নারীর সঙ্গে দীর্ঘদিন যাবৎ পরকীয়াতে লিপ্ত। আগে জানতে পারেন নি। ইদানীং তার স্বামীর কিছু রহস্যময় আচরণে সেটা কাছে ধরা পড়েছে। তবে তিনি শতভাগ নিশ্চিত নন। অকাট্য প্রমাণ তার কাছে নেই। যা আছে সেটাকে কেবল নিছক সন্দেহ বলে চালিয়ে দিচ্ছেন স্বামী'।

আকাশ সাহেব ভদ্র এবং দুর্দান্ত স্মার্ট। তিনি হেসে হেসে বললেন, ভিন্ন এক কথা। তার স্ত্রী মানসিক রোগে আক্রান্ত। তিনি ভীষণ সন্দেহবাতিকগ্রস্ত। তিনি ইদানীং কেমন আনমনা অগোছালো। তিনি প্রায়ই ভুলে যান কোথায় কী রেখেছেন, কখন কী বলেছেন। বেড়াতে যাবার বায়না ধরেন, শখের জিনিস কেনার আবদার করেন।

কিন্তু এনে দিলে তা বেমালুম অস্বীকার করেন, বলেন তিনি বায়না ধরেননি, আবদার করেননি। এমনকি অনেক সময় উল্টোপাল্টা কথাও বলেন। ঘরে কারো ছায়া দেখছেন, কে যেনো জানালা দিয়ে ইশারা করলো ইত্যাদি ইত্যাদি'।

আকাশ ও সুমি দম্পতি আলাদা আলাদাভাবে পরস্পরকে এভাবেই দোষারোপ করলেন। কী এর সমাধান? কে সত্য বলছেন? এখানে কি কেউ গ্যাসলাইটিং করছেন? করলে কে করছেন গ্যাসলাইটিং? মিসেস সুমি না ড্যাম স্মার্ট আকাশ?

গ্যাসলাইটিং কি?
'গ্যাসলাইটিং' শব্দ শুনে কারো মনে হতে পারে, আনমনে একটা সিগারেট হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ নাড়াচড়া করে তারপর একে ঠোঁটে চেপে ধরে দপ করে লাইটারটা অন করা অতঃপর এর অগ্রভাগকে প্রজ্জ্বলিত করে লম্বা একটা দম নেয়া ফুসস...করে বাতাসে ধুয়ো ছেড়ে দেয়া। অনেকটা ইট ভাটার চিমনি দিয়ে বের হওয়া কালো ধুয়োর কুন্ডলীর মত বিষাক্ত কালো ধুয়ো।

আসলে 'গ্যাসলাইটিং' তেমনই কিছু নয়। শব্দটি আমদের জন্যে সম্পূর্ণ নতুন হলেও বাস্তবে এটি 'অতি প্রচলিত' কিন্তু 'নিষিদ্ধ' একটা সামাজিক সম্পর্ক 'পরকীয়া' বা 'অসামাজিক সম্পর্ক' কেন্দ্রিক।

পরকীয়া আসক্ত ইদানীং একটি পারিবারিক ও সামাজিক সমস্যা। ইদানীং এর শিকার হয়ে স্ত্রী হত্যা, স্বামী হত্যা বা সন্তান হত্যা ইত্যাদি অনেক দূর্ঘটনার খবরও পত্র পত্রিকায় দেখা যায়। পরকীয়া এক ধরনের পার্সোনালিটি ডিসওর্ডার।

পরকীয়া আসক্তদের মধ্যে গ্যাসলাইটিং আচরণ দেখা যায়। গ্যাসলাইটিং হলো মিথ্যেভঅভিনয়, মিথ্যে গল্প বা ছল ছাতুরী বা নাটকের মাধ্যমে নিজের পরকীয়া' রিলেশন'কে ঢেকে প্রিয়জনকে বিভ্রান্ত করার একটা সুক্ষ কুট-কৌশল।

একটু গুছিয়ে বলি-ধরুন আপনার স্বামী বা স্ত্রী পরকীয়াতে লিপ্ত দীর্ঘদিন থেকে। ইদানীং আপনি ধীরে ধীরে এর কিছু প্রমাণ পাচ্ছেন। কিন্তু আপনি কনফার্ম হতে পারছেন না কিছুতেই, যথেষ্ট সাক্ষ্য প্রমাণের অভাব। সত্য কথা হলো আপনি কখনই নিশ্চিত হতে পারবেন না, প্রতি মুহূর্ত দ্বিধায় বা গোলক ধাধায় ঘুরবেন কারণ যিনি পরকীয়া করছেন তিনি আপনার সঙ্গে গ্যাসলাইটিং করবেন।

তিনি ছলছাতুরী, মিথ্যে গল্প, অভিনয় নাটক এর আশ্রয় নিবেন এবং এর মুখ্য উদ্দেশ্য হবে তার পরকীয়া সম্পর্কটিকে আড়াল করা। আপনাকে টেনশনে রাখা বা আপনার মনকে অন্য কিছুতে ব্যাস্ত রাখা। শুধু তাই নয়, তিনি প্রমাণ করতে চাইবেন তিনি নির্দোষ।

আপনি বিভ্রান্ত বা আপনিই হচ্ছেন 'সন্দেহবাতিকগ্রস্ত' বা 'মানসিক বিকারগ্রস্ত' একজন মানুষ। আপনি তাকে অযথা সন্দেহ করছেন। তার অভিনয়, পরিকল্পনা, নাটক এতো নিখুঁত হবে যে এক সময় আপনি সত্যি সত্যিই বিভ্রান্ত হয়ে পড়বেন। গলে প্রতি মুহূর্তে আপনার মনের ভেতর একটা উদ্বিগ্নতা, হতাশা কাজ করবে। আপনি কনফিউজড থাকবেন সব কিছুতে।

গ্যাসলাইটারের চমৎকার অভিনয়, সাজিয়ে গুছিয়ে মিথ্যা বলা, গল্প ফাঁদা এসবে বিভ্রান্ত হয়ে শেষমেশ আপনি নিজেই নিজেকে একজন 'মানসিক রোগী' ভাবতে থাকবেন।

ধরুন গ্যাসলাইটার আপনার প্রয়োজনীয় জিনিস লুকিয়ে রাখবেন অতঃপর খুঁজে বের করতে সহায়তা করবেন এবং 'নিজে রেখে নিজেই ভুলে যাও' এমন বলে আপনাকে বিভ্রান্ত করবেন। বলবেন আপনার ভুলে যাওয়া রোগ আছে।

অথবা বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ আদর করে বুকে টেনে নিয়ে বলবেন, 'চলো রেস্টুরেন্ট এ খেতে যাই'। আপনি অবাক হয়ে বলবেন, 'হঠাৎ রেস্টুরেন্টে কেনো'? তিনি তখন মিথ্যে কাহিনী ফাঁদবেন, 'কাল রাতে না বার বার বায়না ধরেছিলে রেস্টুরেন্টে যাবার। আপনি বিভ্রান্ত হয়ে যাবেন। মনে করার চেষ্টা করবেন রাতে কবে, কখন এমন আবদার করলেন। আসলে তা আপনাকে বিভ্রান্ত করার উদ্যেশ্য।

আর এদিকে পরকীয়া আসক্ত আপনার চতুর স্ত্রী বা স্বামী আপনার বিভ্রান্ত মনের অবস্থাকেই কাজে লাগাবেন। আপনার প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে আপনাকে মানসিক রোগী সাজিয়ে হয়তো এক সময় নিয়ে যাবেন চিকিৎসক এর কাছে।

কিভাবে এই অসামাজিক সিচুয়েশন হ্যান্ডেল করবেন?
এরকম কিছু হলে আপনার প্রথম প্রধান কাজ হলো, নিজেকে শান্ত রাখা। গ্যাসলাইটিং যারা করেন তাদের হাতেনাতে ধরাটা বেশ কঠিন কাজ। এরা খুবই ধুরন্ধর প্রকৃতির। সুতরাং কোন ঝগড়া বা হাতাহাতিতে না গিয়ে প্রথমে আপনি খোলামেলাভাবেই তাকে বলে ফেলুন আপনার সন্দেহের কথাটি। প্রমাণগুলো তুলে ধরুন তার সামনে।

এতে কাজ নাও হতে পারে। ঘাবড়াবেন না। আপনি আপনার স্ত্রী বা স্বামীর গ্যাসলাইটিং আচরণ আপনার 'নিকট-আপন' কাউকে খুলে বলুন। মনের মধ্যে এনজাইটি, সন্দেহ, দ্বিধাহীনতা চেপে রাখা ঠিক নয়। এতে আপনার যন্ত্রণা বাড়তে থাকবে।

গ্যাসলাইটার আপনাকে যে ভয়াবহ এনজাইটি ও গোলক ধাধায় ফেলবেন, আপনি যদি বিষয়টি কাউকে শেয়ার না করেন তাহলে হয়তো সত্যি সত্যি আপনার মধ্যে মানসিক রোগের কিছু লক্ষণ আসবে।

গ্যাসলাইটার যদি আপনাকে মানসিক রোগী প্রমাণ করে সাইকিয়াট্রিস্ট এর কাছে নিয়ে যেতে ব্যতিব্যস্ত হন, আপনি না করবেন না নির্দ্বিধায় যাবেন। এটা আপনার জন্যে একটা সুযোগ।

এতে আপনি যেমন অন্তর্দন্দ্ব থেকে মুক্তি পাবেন তেমনি বিষয়টির একটা সুরাহা হবে। সাইকিয়াট্রিস্ট 'কাপল থেরাপি' বা একান্তে আলাপের মাধ্যমে স্ব-স্ব প্রাইভেসি বজায় রেখেই একটা চমৎকার সমাধান দিবেন।

সাইকিয়াট্রিস্টরা 'গ্যাসলাইটিং', 'সন্দেহবাতিক রোগ', 'ডিলিউসনাল ডিসওর্ডার', 'ওথেলো সিনড্রোম' 'মেলিংগারিং বা ভং', 'কনভারসন ডিসওর্ডার' এসব খুব সহজেই আলাদা করতে পারেন। যদিও সাধারণ মানুষের কাছে প্রতিটি একই মনে হবে। গ্যাসলাইটিং বিহেভ কেবল বিবাহিতদের মধ্যে নয়। এটা 'প্রেমিক-প্রেমিকা', বা 'ইনগেজড' দের মধ্যেও দেখা যায়।

লেখক: ডা. সাঈদ এনাম
সহকারী অধ্যাপক, সাইকিয়াট্রি, ফেলো, আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক এসোসিয়েশন

পিএনএস/আইএইচ

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন