বগুড়ার ঐতিহাসিক বধ্যভূমি ‘বিমূর্ত পাজর’- ১৪ শহীদের হত্যা দিবস

  11-11-2014 06:37PM

পিএনএস,(আশরাফুল ইসলাম রতন), বগুড়া : ‘৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত এক বিদগ্ধ জনপদের নাম বগুড়ার বাবুর পুকুর’। বগুড়া থেকে ১২ কিলোমিটার দক্ষিনে ইতিহাসের স্বাক্ষী হিসেবে অবস্থান করছে এই ঐতিহাসিক বধ্যভূমি। ১৯৭১ সালের ১১ নভেম্বর পাক হানাদার বাহিনী এখানেই রচনা করেছিল ইতিহাসের এক ন্যাক্কার জনক ঘটনা।
মুক্তিযুদ্ধে পাক হানাদার বাহিনীর হাতে বাবুর পুকুরে নির্মম ভাবে খুন হওয়া শহীদদের নিজ হাতে কবর দিয়েছিলেন আলাউদ্দিন মাষ্টার। তিনি জানালেন, বর্বর হানাদার বাহিনী এই দিনে বগুড়া শহরের ঠনঠনিয়া, শাহপাড়া, তেঁতুলতলা, হাজিপাড়া ও পশারীপাড়ায় রেডএলার্ট জারি করেছিল। এদেশীয় পাকবাহিনীর দোসর শান্তি কমিটি নামে গড়ে উঠা সংঘবদ্ধ চক্রের তালিকা মোতাবেক ওই এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের পর্যায়ক্রমে গ্রেপ্তার করা হয়। তারপর তাদের সেনা কনভয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার খরনা ইউনিয়নের বাবুর পুকুর এর এক নির্জন খেজুর তলায়। ফজরের আযানের পূর্বেই বীর বাঙ্গালীর গর্বিত সন্তানদের সারিবদ্ধ ভাবে ব্রাশ ফায়ার করা হয়। তারপর বায়োনেট দিয়ে খুচিয়ে খুচিয়ে নিথর শহীদদের শরীরের উপর চালানো হয় নির্মম নিষ্ঠুরতা। পাক হানাদার বাহিনীর পাশবিক হত্যাযজ্ঞে মাতৃভুমির কোলে নুয়ে পড়ে বীর মুক্তিযোদ্ধারা। বগুড়ার সোনার ছেলেদের মধ্যে যারা সেই সময় বাবুর পুকুরে শহীদ হন তারা হচ্ছেন মাহফুজুর রহমান, আঃ মান্নান পশারী, আঃ হান্নান পশারী, ওয়াজেদ রহমান টুকু, জালাল মন্ডল, মন্টু মন্ডল, আব্দুল সবুর, সাইফুল ইসলাম, আলতাফ আলী, ফজলুল হক খান, বাদশা মিয়া, আবুল হোসেন, টেলিফোন অপারেটর নুরজাহান লক্ষ্মী ও অজ্ঞাত পরিচয় একজন।
স্থানীয় তিতখুর গ্রামের মহানুভব ব্যক্তি আলতাফ হোসেন, এ্যাড. আফতাব উদ্দিন, এ্যাড. রাশেদুর রহমান মরিস, আলাউদ্দিন মাষ্টার ১৫ শতাংশ জমি শহীদদের স্মরনীয় করে রাখার জন্য স্মৃতিস্তম্ভের নামে দান করেছেন। তিতখুর মৌজার ৫৮০ দাগের ৩ শতক জায়গার উপরে ১৪টি কবর এবং ১২ শতকের উপর স্মৃতিস্তম্ভের বেদি নির্মান করা হয়েছে। রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর অব্যাহত দাবীর প্রেক্ষিতে বগুড়ার বাবুর পুকুরে আত্মদানকারী ১৪ শহীদদের স্মৃতি রক্ষায় স্বাধীনতার দীর্ঘ বছর পর অবশেষে নির্মান হয়েছে বধ্যভূমি স্মৃতিস্তম্ভ “বিমূর্ত পাজর”।
স্বাধীনতার ৪০ বছর পর বগুড়ায় সরকারী ভাবে বাবুর পুকুর বধ্যভূমিতে স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করা হলেও সঠিক সংরক্ষনের অভাবে তা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বগুড়া শাজাহানপুর উপজেলার এই বধ্যভুমিতে চারিদিকে প্রাচীর দিয়ে ঘিরে দেয়ার পর প্রধান ফটক বন্ধ থাকলেও মানুষের যাতায়াতের ছোট দরজাটি সারাবছরই খোলা থাকায় মানুষ, কুকুর, ছাগল অবাধে চলাফেরা করে। আর এই অবাধ চলাফেরায় বধ্যভুমির বেদি সব সময়ের জন্য থাকে অপরিচ্ছন্ন। খরনা ইউনিয়নের ৩টি গ্রামের লোকজন এই বেদির উপর দিয়ে প্রতিনিয়ত জুতা স্যান্ডেল পরে যাতায়াত করে থাকে। আশপাশের জমি থেকে গরু, ছাগল মূল বেদির উপর উঠে বধ্যভূমির পরিবেশ একেবারেই নষ্ট করছে। তিতখুর গ্রামের ছোট শিশুদের খেলার নিরাপদ স্থান হিসেবে এই বধ্যভূমির মূল বেদিটি তাদের কাছে এখন অতি প্রিয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বধ্যভূমিতে স্থাপিত স্মৃতিস্তম্ভের উত্তর পার্শে একটি নন্দন লেক তৈরির কথা থাকলেও আজও সেই কাজে হাত পরেনি। পবিত্র এই ভূমিতে নানান দৈন্যদশা দেখে শঙ্কিত সচেতন বগুড়াবাসী।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বধ্যভূমিটি সংরক্ষনের জন্য চারদিকে গ্রীল দিয়ে ঘিরে নিরাপদ রাখলেও শুধু মাত্র ছোট দুইটি দরজা খোলা থাকায় বধ্যভূমিটি এখন যুবক যুবতীদের প্রেমকুঞ্জে পরিনত হয়েছে। মাদক সেবীদের অভয়রান্য হিসেবে এবং অসামাজিক কাজকর্মের স্থান হিসেবে বধ্যভূমিটি এখন চিহ্নিত হয়ে গেছে। বধ্যভূমির মূল অংশের পিছনে মাদক সেবীদের নিরাপদ স্থান হওয়ায় সেখানে দিন রাত অবাধে চলে মাদক সেবীদের জমজমাট আডডা।
জানা গেছে, বগুড়ার ১৪ জন বীর মুক্তিযোদ্ধার স্মৃতির প্রতি সম্মান রেখে বগুড়া জেলা পরিষদে ২০০৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে ৩২ লক্ষ টাকার একটি প্রকল্প হাতে নেয়। উক্ত প্রকল্পের আওতায় প্রথম পর্যায়ে ২২ লক্ষ ৯৫ হাজার টাকার একটি পরিকল্পনা প্রাথমিক ভাবে বাস্তবায়ন করছে বগুড়া জেলা পরিষদ। শহীদ স্মৃতি স্তম্ভের স্মারক ভাস্কর্যটির নকশা অংকন করেছেন রংপুরের শিল্পী অনিক রেজা। উক্ত স্মৃতি স্তম্ভটিতে শিল্পী দেখিয়েছেন, শহীদদের বুকের পাজরের আদলে নির্মান করা সুউচ্চ বেদির গায়ে মেশিনগানের গুলির ২৮টি ছিদ্র চিহ্নসহ একটি বিমূর্ত শিল্পকর্ম হিসেবে। যেখানে ১৪ জন শহীদদের জন্য দু’টি করে ছিদ্র এবং তাদের বক্ষে দেশাত্ব বোধের চেতনায় লেখা- বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাটি, চিনে নিক দুর্বৃত্ত, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, আবার আসিব ফিরে ধান সিড়িরটির তীরে এই বাংলায়, কোনঠে বাহে জাগো সবায়, জয়বাংলা বাংলার জয়, মোদের গরব মোদের আশা আ-মরি বাংলা ভাষা, ও আমার দেশের মাটি তোমার তরে ঠেকায় মাথা, আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি ইত্যাদি শ্লোগান। ১৪ জন শহীদের পুর্ব পশ্চিম দিকের সারিবদ্ধ কবরকে সম্পৃক্ত করে মূল অবকাঠামো নির্মান করা হয়েছে। মোট ৭৫ফুট প্লাটফর্মের পুর্বাংশে ২৫ ফুট উচুঁ বেদী রাখা হয়েছে। স্মৃতি স্তম্ভের পশ্চিমাংশ দিয়ে বগুড়া- নাটোর মহাসড়ক প্রবাহিত। স্মৃতিস্তম্ভটি এমন ভাবে নির্মান করা হয়েছে যেন রাস্তা দিয়ে যাতায়াতকারীরা খুব সহজেই এটি দেখতে পায়। সারিবদ্ধ কবরের উত্তর পার্শে লাল রং এর টাইলস বসানোর পরিকল্পনা রয়েছে।
বগুড়া জেলা পরিষদ সচিব জানিয়েছেন, লাল টাইলস না পাওয়ার কারনে বর্তমানে লাল রং দিয়ে এ কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। পরিকল্পনা রয়েছে উত্তর পার্শে লেক থেকে পানির প্রতিফলন লাল টাইলসে এসে পড়লে রক্ত আভা দৃশমান হবে। এতে দূর থেকে মনে হবে শহীদদের কবর থেকে লাল রক্ত লেকে প্রবাহিত হচ্ছে। পুরো বেদির প্লাটফর্মে সাদা ও লাল টাইলস বসানো হয়েছে। বেদির দক্ষিনে পুকুরের ৩ পার্শে ৫ ফুট প্রস্থ সরু লেন জেলা পরিষদরে প্রাস্তবিত বাজেটের মধ্যেই তৈরি হয়েছে। স্মৃতিস্তম্ভের দর্শনার্থীরা যেন কিছুটা আয়াশের সাথে সাথে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে পারে তার ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। পুকুরের জলের স্পর্শ অনুভব করার জন্য প্লাটফর্ম থেকে পুকুরের জলসীমা পর্যন্ত সিড়ি বাঁধানো হয়েছে। সেই সাথে বগুড়া-নাটোর প্রধান সড়ক থেকে একটি লেন প্লাটফর্মের মাধ্যমে বেদী মূলের সংগে সংযোগ করা হয়েছে। স্থানীয় ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান মেসার্স নুরুন্নবী মোল্লা হারকুলেছ এই স্মৃতি স্তম্ভের কাজ করছেন বলে জানা যায়।
এত কিছুর পরেও নকশা অনুযায়ী কাজ না হওয়ায় এবং সঠিক পরিমানের নির্মান উপকরন না দিয়ে কাজ করায় এরই মধ্যে টাইলস এবং প্লাষ্টারসহ দেয়াল এর ইট উঠে ভাঙ্গনের সৃষ্টি হয়েছে। বধ্যভুমিটির জায়গা দানকারীদের কোন বিষয়ে অবগত না করায় তাদের মধ্যে চাপা ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।


পিএনএস/সামির/শাহাদাৎ

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন