বিশ্ব ইতিহাসে মাইলফলক পদ্মা সেতু

  25-06-2022 09:26AM


পিএনএস ডেস্ক : সব বাধা পেরিয়ে বিশ্ব ইতিহাসের নতুন মাইলফলক স্পর্শ করল বাংলাদেশ। এখন দিগন্তবিসারী দুরন্ত নদীর সগৌরবে দৃশ্যমান স্বপ্নের পদ্মা সেতু, যা আমাদের সাহসিকতা ও সক্ষমতার মূর্ত প্রতীক। এটি শুধু একটি সেতুই নয়; এটি বাঙালি জাতির একটি আবেগও বটে। কোনো এক দুঃস্বপ্নকে হাতের মুঠোয় এনে বিশ্ববাসীকে নিজের সামর্থ্য দেখিয়ে দেওয়া। শত ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে এই সেতু নিজেকে জানান দিচ্ছে এখন। দেখে মনে হচ্ছে, এটা যেন আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায় বিশ্ববাসীকে বলছে, ‘উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ববিধাতৃর! মম ললাটে রুদ্র ভগবান জ্বলে রাজ-রাজটীকা দীপ্ত জয়শ্রীর! বল বীর-আমি চির উন্নত শির!’

পদ্মা সেতু তৈরির পেছনে যার অবদান অনস্বীকার্য, তিনি হচ্ছেন দৃঢ়চেতা, বলিষ্ঠ সাহসী একজন ‘শেখ হাসিনা’, যিনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা। স্বপ্নের এই সেতু নিয়ে নানা ষড়যন্ত্র, বিতর্ক, দুর্নীতির অভিযোগ সবকিছু মিথ্যা প্রমাণ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসী ও দৃপ্ত পদক্ষেপে একটি অবাস্তবকে বাস্তবে রূপ দিয়েছে বাঙালি জাতি। যা সত্যিই বিশ্বের অনেক দেশের জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, দূরদর্শী এক রাষ্ট্রনায়কের অসীম সাহসিকতা ও দৃঢ় আত্মবিশ্বাসের অবিশ্বাস্য এক রূপকথার নাম পদ্মা সেতু। যিনি দেশি-বিদেশি নানা ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করে বাংলাদেশ ও বাঙালির সক্ষমতাকে আরও একবার জানান দিলেন বিশ্ববাসীকে। পদ্মা সেতু শুধু একটি সেতুই নয়, এটি আমাদের আবেগ, ভালোবাসা, অনন্য গৌরব, মর্যাদা আর অহংকারের প্রতীক। বাঙালির স্বপ্নপূরণের অনবদ্য উপাখ্যান। বাঙালি জাতিকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না জাতির পিতার সেই সাহসী উচ্চারণকে আবারও অসীম সাহসিকতায় প্রমাণ করে বিশ্ববাসীকে তাক লাগিয়ে দিলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। সবকিছু ঠিক থাকলে আজ (২৫ জুন) সকাল ১০টায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাঙালির গর্বের এই সেতু উদ্বোধন করবেন। এ জন্য পদ্মার দুই পাড়েই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের ব্যাপক প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশের স্বপ্ন, সমৃদ্ধির প্রতীক, অন্যতম স্থাপনা পদ্মা সেতু। এই সেতুর মাধ্যমে দেশের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হবে ২১ জেলা। দেশের সর্ববৃহৎ ও প্রথম দ্বিতল এই সেতু চালু হলে দেশের যোগাযোগ ক্ষেত্রে নতুন এক দিগন্তের উন্মোচন হবে। দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে আসবে ব্যাপক পরিবর্তন। বৃহৎ এই প্রকল্প নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়ন করে উন্নত বিশ্বকে নিজেদের সামর্থ্যরে ব্যাপারে একটি ইতিবাচক বার্তা দিয়েছে বাংলাদেশ। এই সেতুর ফলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বাসিন্দাদের চলাচলের অনেক বঞ্চনা ও যাতনার শেষ হতে যাচ্ছে। এ অঞ্চলের উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে দ্রুতগতিতে। পদ্মা সেতুর ওপারে কৃষিনির্ভর শিল্প গড়ে উঠবে। হবে কৃষিবিপ্লব। জাতীয়ভাবে অন্তত ১ দশমিক ২ শতাংশ জিডিপি বাড়বে পদ্মা সেতুর বাস্তবায়নের ফলে। আর ওপারের ২১ জেলার ক্ষেত্রে জিডিপি বাড়বে অন্তত ২ দশমিক ৩ শতাংশ। এতে দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন ঘটবে। এ সেতুর কাজ শেষ হতে সময় লাগল সাড়ে সাত বছর। এতে ব্যয় হয়েছে ৩০ হাজার কোটি টাকারও বেশি। তবে মূল সেতু নির্মাণে খরচ হয়েছে ১২ হাজার ১০০ কোটি টাকা। এই সেতুর ওপর দিয়ে প্রতিদিন বিভিন্ন রকমের অন্তত ২৪ হাজার গাড়ি চলবে। যা থেকে টোল আদায় হবে সাড়ে ৪ কোটি টাকার মতো। আনুষ্ঠানিকভাবে সেতুর কাজ শুরু হয় ২০১৪ সালের ৭ ডিসেম্বর আর উদ্বোধন হতে যাচ্ছে ২৫ জুন-২০২২। গত ২২ জুন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সেতুটি নির্মাণ শেষে সরকারের কাছে হস্তান্তর করে। সেতুর ওপর দিয়ে চলবে বিভিন্ন রকমের যানবাহন। আর নিচ দিয়ে রেললাইন স্থাপন করা হচ্ছে। যদিও তা পিছিয়ে গেছে নানা জটিলতায়। কথা ছিল সেতুর ওপর দিয়ে একই দিনে যান ও ট্রেন চলবে। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। রেললাইন স্থাপনের কাজ চলছে। ২০২৩ সালের জুনের মধ্যে রেল চলাচলও চালু হবে বলে আশা করা হচ্ছে। ২৬ জুন থেকেই যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হচ্ছে পদ্মা সেতু। তবে রেললাইন স্থাপনের কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত চলবে না ভারী কোনো যানবাহন। এমনকি রেলের স্লিপার স্থাপনের কাজ নির্বিঘ্ন করতে রাতে ৬ থেকে ৮ ঘণ্টা সেতুতে ধীরগতিতে যান চলাচলের নির্দেশনা দেওয়া হতে পারে।

জানা গেছে, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী জোরেশোরে শুরু হয় পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রক্রিয়া। প্রথম দিকে বিশ্বব্যাংক, জাইকা ও এডিবি ও আইডিবি এ প্রকল্পে অর্থায়নে আগ্রহী হয়। এ প্রকল্পে ১২০ কোটি ডলার ঋণ দেওয়ার কথা ছিল বিশ্বব্যাংকের। কিন্তু হঠাৎ করেই দুর্নীতির চেষ্টার অভিযোগ এনে ২০১২ সালে প্রকল্প থেকে সরে দাঁড়ায় বিশ্বব্যাংক। অভিযোগ ছিল, কানাডীয় কোম্পানি এসএনসি-লাভালিনকে কাজ পাইয়ে দিতে দুর্নীতির চেষ্টা হচ্ছে। এতে সরকারি, বেসরকারি কর্মকর্তা ও এসএনসি-লাভালিনের কর্মকর্তারা জড়িত। এ নিয়ে কানাডার আদালতে মামলা হয়। পরবর্তীতে দুর্নীতি চেষ্টার অভিযোগকে ২০১৪ সালে দুদক ও ২০১৭ সালে কানাডার আদালত মিথ্যা আখ্যা দিয়ে রায় দেন। এরপর বিশ্বব্যাংক অর্থায়নে ফিরে আসতে চাইলেও সংস্থাটির সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে সরকার। সেই বছরের ডিসেম্বরেই এ প্রকল্পের আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ শুরু হয় নিজস্ব অর্থায়নে। ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ৩৭ ও ৩৮ নম্বর খুঁটিতে প্রথম স্প্যান বসানোর মধ্য দিয়ে দৃশ্যমান হয় পদ্মা সেতু। এরপর একে একে ৪২টি পিলারে ১৫০ মিটার দৈর্ঘ্যরে ৪১টি স্প্যান বসিয়ে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ সেতুটি পুরোপুরি দৃশ্যমান হয় ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর। সেতুটি ঢাকা থেকে ৪০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ের সঙ্গে শরীয়তপুর ও মাদারীপুরে অবস্থিত। এর প্রস্থ ২২ মিটার। সেতুর সংযোগ উড়াল সড়ক (ভায়াডাক্ট) ৩.১৮ কিলোমিটার। সংযোগ সড়ক দুই প্রান্তে মোট ১২ কিলোমিটার। সেতু প্রকল্পে নদীশাসন হয়েছে দুই পাড়ে ১৪ কিলোমিটার পর্যন্ত। সেতুর ভায়াডাক্ট পিলার ৮১টি। পানির স্তর থেকে সেতুর উচ্চতা ৬০ ফুট। পাইলিংয়ের গভীরতা ৩৮৩ ফুট। স্প্যান বসেছে ৪১টি। প্রতিটি স্প্যানের ওজন ৩১৪০ টন ও দৈর্ঘ্য ১৫০ মিটার। সেতুতে ৪২টি পিলার রয়েছে। প্রতি পিলারের জন্য পাইলিং ৬টি। সেতুতে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও অপটিক্যাল ফাইবার লাইন পরিবহনের সুবিধা রয়েছে। সেতুর ভূমিকম্প সহনীয় মাত্রা রিখটার স্কেলে ৮। দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয় বৃহত্তম এ সেতুর তত্ত্বাবধানে ছিল বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও বুয়েট এবং কোরিয়া এক্সপ্রেসওয়ে করপোরেশন (কেইসি)। সেতুর জন্য ২৭০০ হেক্টর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। মূল সেতু নির্মাণের জন্য কাজ করছে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি (এমবিইসি) আর নদীশাসনের কাজ করছে দেশটির আরেকটি প্রতিষ্ঠান সিনো হাইড্রো করপোরেশন। দুটি সংযোগ সড়ক ও অবকাঠামো নির্মাণ করেছে বাংলাদেশের আবদুল মোনেম লিমিটেড। এ প্রকল্পে কাজ করেছেন প্রায় ৪ হাজার শ্রমিক।

পদ্মা সেতু নির্মাণে মোট খরচ হয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ দশমিক ৩৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে রয়েছে সেতুর অবকাঠামো তৈরি, নদীশাসন, সংযোগ সড়ক, ভূমি অধিগ্রহণ, পুনর্বাসন ও পরিবেশ, বেতন-ভাতা ইত্যাদি। অর্থ বিভাগের সঙ্গে সেতু বিভাগের চুক্তি অনুযায়ী সেতু নির্মাণে ২৯ হাজার ৮৯৩ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে সরকার। ১ শতাংশ সুদহারে ৩৫ বছরের মধ্যে সেটি পরিশোধ করবে সেতু কর্তৃপক্ষ। এর আগে ২০০৫-এ পদ্মা সেতু নির্মাণের প্রাথমিক ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছিল ১২ হাজার কোটি টাকা। ২০০৭-এর আগস্টে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে একনেক সভায় পদ্মা সেতুর চূড়ান্ত প্রাক্কলন করা হয় ১০ হাজার ১৬১ কোটি টাকা। পরবর্তীতে ২০১১ সালের ১১ জানুয়ারিতে ব্যয় সংশোধন করে ধরা হয়েছিল ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। সময়ের পরিক্রমায় তা ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।


পিএনএস/আনোয়ার






@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন