সাড়ে তিন মিনিটে কর্ণফুলী পার হওয়া যাবে বঙ্গবন্ধু টানেলে

  26-11-2022 09:59AM





পিএনএস ডেস্ক: চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর দুই পার এবার যুক্ত হলো ভিন্ন রূপে। নদীর ওপরে পানির ঢেউ আর তলদেশে চলবে যানবাহন। সেই লক্ষ্যে নির্মিত হচ্ছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল। যান চলাচলের জন্য প্রায় প্রস্তুত এই টানেল।

নদীর তলদেশে নির্মিত দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম এই টানেলের ভেতর দিয়ে গাড়িতে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যেতে লাগে মাত্র সাড়ে তিন মিনিট।

এই টানেলের দক্ষিণ টিউবের নির্মাণকাজ সমাপ্তি উপলক্ষে আজ শনিবার আয়োজিত অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পতেঙ্গা প্রান্তে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। অনুষ্ঠানে সকাল ১০টায় গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি যোগ দেবেন প্রধানমন্ত্রী।

টানেল চট্টগ্রামের পতেঙ্গা ও আনোয়ারা এলাকাকে যুক্ত করেছে। টানেল দিয়ে গাড়িতে ঘণ্টায় ৫৫ থেকে ৬০ কিলোমিটার গতিতে আনোয়ারা থেকে পতেঙ্গা প্রান্তে যেতে সময় লাগছে প্রায় সাড়ে তিন মিনিট। টানেলটি উদ্বোধনের পর এই অল্প সময়েই কর্ণফুলী নদী পার হতে পারবে এই অঞ্চলের মানুষ। এতে বাঁচবে সময়, বাড়বে অর্থনৈতিক চাকার গতি।

টানেলে দুটি টিউব রয়েছে। দক্ষিণ পাশের টিউব দিয়ে আনোয়ারা থেকে পতেঙ্গামুখী যান চলাচল করবে। এই টিউবের অবকাঠামোগত নির্মাণকাজ শতভাগ শেষ হয়েছে। ঠিক পাশের উত্তর টিউবটি দিয়ে পতেঙ্গা থেকে আনোয়ারামুখী যান চলাচল করবে। এই টিউবের সার্বিক নির্মাণকাজের অগ্রগতি ৯৮ শতাংশ। আর পুরো প্রকল্পের কাজ এগিয়েছে ৯৪ শতাংশ।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, টানেল টিউবের দৈর্ঘ্য ২.৪৫ কিলোমিটার। টানেলের এই অংশ নদীর তলদেশে অবস্থিত। টিউবের ভেতরের ব্যাস ১০.৮০ মিটার। আর টিউবসহ মূল টানেলের দৈর্ঘ্য ৩.৩২ কিলোমিটার। এই দুই টিউব তিনটি সংযোগ পথের মাধ্যমে যুক্ত হয়েছে। আপৎকালে এক টিউব থেকে অন্য টিউবে যাওয়ার জায়গা রাখা হয়েছে। মূল টানেলের সঙ্গে পতেঙ্গা প্রান্তে ০.৫৫ কিলোমিটার এবং আনোয়ারা প্রান্তে ৪.৮ কিলোমিটারসহ মোট ৫.৩৫ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক রয়েছে। এ ছাড়া আনোয়ারা প্রান্তে সংযোগ সড়কের সঙ্গে ৭২৭ মিটার উড়ালসেতু (ভায়াডাক্ট) রয়েছে। সব মিলিয়ে প্রকল্পে ৯.৩৯ কিলোমিটার নতুন পথ তৈরি হচ্ছে। ৩.৩২ কিলোমিটার দীর্ঘ টানেলটি কর্ণফুলী নদীর মোহনার কাছে পশ্চিম প্রান্তে পতেঙ্গা নেভাল একাডেমির কাছ থেকে শুরু হয়ে পূর্ব প্রান্তে চট্টগ্রাম ইউরিয়া সার কারখানা (সিইউএফএল) ও কর্ণফুলী সার কারখানার (কাফকো) মাঝখান দিয়ে আনোয়ারা প্রান্তে পৌঁছেছে।

গতকাল শুক্রবার টানেলসহ পুরো প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখা যায়, সংযোগ উড়ালসেতু ও সংযোগ সড়কের কাজ পুরোপুরি শেষ হয়ে গেছে। দুই প্রান্তে বসেছে টোল প্লাজা। আনোয়ারা প্রান্তে সড়কের দৈর্ঘ্য ও টোল প্লাজার সংখ্যা বেশি। টানেলে দক্ষিণ টিউবের অবকাঠামো নির্মাণকাজ শেষ হলেও চলছে উত্তর টিউবের নির্মাণকাজ। তবে দুই টিউবেই বর্তমানে একসঙ্গে চলছে বিদ্যুৎ সংযোগের কাজ। এ ছাড়া বাতাস নির্গমন ব্যবস্থা সচল রাখা, অগ্নিনির্বাপণ, পানি নিষ্কাশনে ড্রেনেজ ব্যবস্থা, কমিউনিকেশন ও মনিটরিং ব্যবস্থাপনা স্থাপনের কাজ চলছে। এই কাজগুলো শেষ হলে টানেল গাড়ি চলাচলের উপযোগী হবে।

টানেল ঘুরে দেখার সময় এক প্রশ্নের জবাবে প্রকল্প পরিচালক মো. হারুনুর রশীদ চৌধুরী বলেন, ‘প্রকল্পের সব কাজ শেষ হওয়ার পরে টানেলের প্রতিটি ব্যবস্থাপনা একসঙ্গে কাজ করছে কি না, সেটা পরীক্ষা করে দেখে কাজ শেষের ঘোষণা দেওয়া হবে। তবে আশা করছি, এসব কাজ আগামী বছরের জানুয়ারি মাসের শেষে বা ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুতে শেষ করতে পারব। ’

টানেলের ভেতর দেখা যায়, একমুখী গাড়ি চলাচলের জন্য দুই লেনের সড়ক তৈরি করা হয়েছে। সড়কের দুই পাশেই হাঁটার জায়গা রয়েছে। জরুরি প্রয়োজনে সেখানে দাঁড়ানো ও হাঁটা যাবে। টানেলের ভেতর দুই পাশে ফাইবার বোর্ড লাগানো হয়েছে, যা দেখতে অনেকটা দেওয়ালের মতো। এই ফাইবার বোর্ড আগুন প্রতিরোধক। টানেলের ভেতরের ছাদেও কালো রঙের আগুন প্রতিরোধক ফাইবার বোর্ড লাগানো হয়েছে। ভেতরে হাঁটার জন্য যে জায়গা রাখা হয়েছে সেই জায়গায় কিছুদূর পর পর জরুরি বের হওয়ার পথ রয়েছে। এই পথে টানেলের এক টিউব থেকে অন্য টিউবে যাওয়া যাবে।

প্রকল্প পরিচালক হারুনুর রশীদ বলেন, ‘করোনার জন্য নির্মাণকাজ শেষ হতে কিছুটা দেরি হয়েছে। এখন পুরোদমে কাজ চলছে। প্রথম টিউব নির্মাণে ১৭ মাস লাগলেও পরেরটা ১০ মাসে সম্পন্ন হয়েছে। ’

পতেঙ্গায় সেতুর নির্মাণকাজের সমাপ্তি অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি দেখতে এসে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আহমদ কায়কাউস বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশে একটা নতুন দিগন্তের সূচনা করেছি। আমরা খুব আনন্দিত ও উদ্ভাসিত। এটা বাংলাদেশের জাতীয় বীরত্বের কাহিনি। নদী নিয়ে সব সময় দুঃখের গান গাওয়া হতো। এখন সেই নদীর তলদেশ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছি। এই টানেল উদ্বোধন করা হলে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার বাড়বে ০.১৬৬ শতাংশ। ’

এদিকে প্রকল্প নিয়ে ২০১৩ সালে করা এক সমীক্ষা প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, টানেল চালুর বছরে ৬৩ লাখ গাড়ি চলাচল করতে পারে। সে হিসাবে দিনে চলতে পারে ১৭ হাজার ২৬০টি গাড়ি। ২০২৫ সাল নাগাদ টানেল দিয়ে গড়ে প্রতিদিন ২৮ হাজার ৩০৫টি যানবাহন চলবে, যার মধ্যে অর্ধেক থাকবে পণ্যবাহী যানবাহন। ২০৩০ সাল নাগাদ প্রতিদিন গড়ে ৩৭ হাজার ৯৪৬টি এবং ২০৬৭ সালে এক লাখ ৬২ হাজার যানবাহন চলাচলের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা আছে।

সাংহাইয়ের আদলে গড়ে উঠবে শহর
কর্ণফুলী নদীর দুই তীরকে সংযুক্ত করে চীনের সাংহাই শহরের আদলে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ গড়ে তোলার লক্ষ্যে টানেল নির্মাণ প্রকল্প হাতে নিয়েছিল সরকার। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ সেতু বিভাগ। ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং টানেল প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী টানেলের প্রথম টিউবের বোরিংকাজ উদ্বোধন করেন। পরের বছরের ১২ ডিসেম্বর দ্বিতীয় টিউবের বোরিংকাজ উদ্বোধন করেন সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।

চলতি বছরের ডিসেম্বরে প্রকল্পটির নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু এখন সেটা হচ্ছে না। সেতু বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, আগামী বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।

বঙ্গবন্ধু টানেল কবে নাগাদ খুলে দেওয়া হবে, জানতে চাইলে সেতু বিভাগের সচিব মো. মনজুর হোসেন বলেন, ‘টানেল উদ্বোধনের জন্য আমরা এখনো কোনো তারিখ নির্ধারণ করিনি। তবে কাজ শেষের সময় নির্ধারণ করেছি। উদ্বোধনের তারিখ নেওয়ার আগে প্রধানমন্ত্রীর কাছে সামারি পাঠানো হবে। ’

পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন