পোশাক শিল্পাঞ্চলে ফের অস্থিরতা: নারী শ্রমিক নিহত, ৩৪ কারখানা বন্ধ

  18-09-2024 03:00AM

পিএনএস ডেস্ক: দুই দিন কিছুটা স্বাভাবিক থাকার পর সাভার, আশুলিয়া ও গাজীপুরের পোশাক শিল্পাঞ্চল গতকাল মঙ্গলবার আবার অস্থির হয়ে উঠেছে। সকালে আশুলিয়ার জিরাবো এলাকায় শ্রমিকদের দুই পক্ষের সংঘর্ষে একজন নারী শ্রমিক নিহত হয়েছেন। তাঁর নাম রোকেয়া বেগম। তিনি মাসকট গার্মেন্টসের সহকারী সেলাই মেশিন অপারেটর ছিলেন।

শ্রমিক বিক্ষোভের জেরে গতকাল ওই তিন শিল্পাঞ্চলে ৩৪টি কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। আশুলিয়ায় বন্ধ হয়েছে ২৯টি কারখানা। এর মধ্যে ১৫টি অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। গাজীপুরে পাঁচটি কারখানা বন্ধ হয়েছে।

তৈরি পোশাক শিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ'র তথ্য অনুসারে আশুলিয়ায় ২৭২টি কারখানার মধ্যে চালু আছে ২৫৩টি। শ্রম আইনের ১৩(১) ধারায় বন্ধ আছে ১৫টি কারখানা। সেগুলো হচ্ছে- মাসকট গার্মেন্টস, মাসকট নিট, মাসকট ফ্যাশনস, রেডিয়েন্স জিন্স, রেডিয়েন্স ফ্যাশন, স্ক্যানডেক্স, হামজা ক্লোদিং, আরকে নিট, সান অ্যাপারেলস, টেক ম্যাক্স, শিন শিন অ্যাপারেলস, পার্ল গার্মেন্টস, জেনারেশন নেক্সট, ইউরোপিয়া ও সুসুকা নিট। এ ছাড়া রেডিয়েন্স নিটওয়্যারস, এস-২১ অ্যাপারেলস, কমফিট কম্পোজিট (ইউনিট-২) ও সাউদার্ন গার্মেন্টস কারখানা চালু থাকলেও পরে বন্ধ হয়ে যায়।

বিজিএমইএর তথ্য অনুসারে, আশুলিয়ার ২৭২টি কারখানার মধ্যে ২৬০টি আগস্ট মাসের বেতন পরিশোধ করেছে। সংগঠনটির ৯৪.৩১ শতাংশ সদস্য কারখানা আগস্ট মাসের বেতন দিয়েছে।

বিভিন্ন দাবি আদায়ে শ্রমিকদের বিক্ষোভের কারণে ঢাকার সাভার-আশুলিয়া ও গাজীপুর শিল্পাঞ্চলে দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে অস্থিরতা চলছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে গত সপ্তাহে শ্রমিকদের হাজিরা বোনাস অতিরিক্ত ২২৫ টাকা, টিফিন ভাতা বাড়ানো, শ্রমিকদের কালো তালিকাভুক্তি বাতিল এবং নিয়োগের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সম-অধিকার নিশ্চিত করার সিদ্ধান্ত নেয় মালিকপক্ষ। এরপর চলতি সপ্তাহ থেকে পরিস্থিতির বেশ খানিকটা উন্নতি হয়।

বিজিএমইএর পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, আশুলিয়ায় সকালে দুই পক্ষের শ্রমিকদের মধ্যে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার পর আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। কারখানা বন্ধের বিষয়ে তিনি বলেন, শিল্পাঞ্চলে টানা অস্থিরতার সময় অনেক কারখানা বন্ধ ছিল। বর্তমানে যেগুলো বন্ধ আছে, সেগুলোর মালিকরা কারখানা খোলার বিষয়ে আস্থা পাচ্ছেন না। তাঁরা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেই উত্পাদনে ফিরতে চাইছেন।

গাজীপুরে ফের শ্রমিক বিক্ষোভ
গাজীপুর প্রতিনিধি জানান, গাজীপুরে গতকাল ফের পোশাক কারখানায় অস্থিরতা দেখা দেয়। বকেয়া বেতনের দাবিতে নগরীর কাশিমপুর ও টঙ্গীতে আন্দোলনে নামেন শ্রমিকরা। কাশিমপুরে চক্রবর্তী এলাকায় বেক্সিমকো গ্রুপের শ্রমিকরা নবীনগর-চন্দ্রা সড়ক এবং টঙ্গীতে সিজন ড্রেস লিমিটেডের শ্রমিকরা ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। এতে দীর্ঘ সময় যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকে। দুর্ভোগ পোহায় শত শত যাত্রী।

জানা গেছে, সকাল সাড়ে ৮টার দিকে টঙ্গীর খাঁ পাড়া সড়কের সিজন ড্রেস লিমিটেড কারখানার শ্রমিকরা বকেয়া বেতনের দাবিতে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। তাঁদের দাবি, জুলাই ও আগস্ট মাসের বকেয়া বেতন এখনো পরিশোধ করেনি কর্তৃপক্ষ। গত ১৫ সেপ্টেম্বর এক মাসের বকেয়া বেতন পরিশোধের কথা ছিল। গতকাল পর্যন্ত তাঁরা বেতন পাননি। কারখানা কর্তৃপক্ষের খোঁজ নেই।

এর আগে কয়েক দফা আন্দোলন করে জুন মাসের বকেয়া বেতন আদায় করা হয়েছে। বাধ্য হয়ে তাঁরা জুলাই ও আগস্ট মাসের বেতনের জন্য আন্দোলনে নেমেছেন। এছাড়া গত ফেব্রুয়ারি থেকে ওভারটাইমের টাকাও পরিশোধ করেনি কারখানা কর্তৃপক্ষ।

এ বিষয়ে কারখানার মালিক বাহাউদ্দিন চৌধুরী বাকের সাংবাদিকদের জানান, ব্যাংকিং চ্যানেলে সমস্যার কারণে বেতন পরিশোধে দেরি হচ্ছে। সমস্যার বিষয়টি বুঝিয়ে বলার পর দুপুর ১২টার দিকে অবরোধ তুলে নেন শ্রমিকরা।

গাজীপুর শিল্প পুলিশের বেক্সিমকো জোনের সহকারী পুলিশ সুপার মো. গোলাম মোর্শেদ জানান, বকেয়া বেতনের দাবিতে কাশিমপুরের দুটি স্থানে শ্রমিকরা সড়কে বিক্ষোভ করেন। খবর পেয়ে সেনাবাহিনী ও পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।

গাজীপুর শিল্পাঞ্চল-২-এর সহকারী পুলিশ সুপার মোশাররফ হোসেন বলেন, টঙ্গীতে বকেয়া বেতনের দাবিতে সড়ক অবরোধ করেন সিজন ড্রেস কারখানার শ্রমিকরা। তাঁদের বুঝিয়ে সড়ক থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়।

কালিয়াকৈর (গাজীপুর) প্রতিনিধি জানান, কালিয়াকৈরের চন্দ্রা এলাকার নায়াগ্রা নামের পোশাক কারখানার শ্রমিকরা গতকাল বেতনের দাবিতে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক অবরোধের চেষ্টা করেন। দুপুরে শ্রমিকরা কারখানা থেকে বের হয়ে এর পাশে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে এসে ১৫ থেকে ২০ মিনিটের মধ্যে আবার ফিরে যান।

শ্রমিক ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়, কালিয়াকৈরের চন্দ্রা এলাকার নায়গ্রা টেক্সটাইল নামের পোশাক কারখানার শ্রমিকদের গত এক মাসের বেতন গতকাল দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু দুপুরের মধ্যেও কারখানা কর্তৃপক্ষ বেতন না দেওয়ায় শ্রমিকরা উত্তেজিত হয়ে ওঠেন। এ সময় কারখানার ভেতর বেতনের দাবিতে তাঁরা বিক্ষোভ করেন।

গাজীপুর প্রতিনিধি জানান, শ্রমিক আন্দোলনে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক তিন ঘণ্টা বন্ধ থাকার পর স্বাভাবিক হয়।

জানা যায়, সকাল সাড়ে ৯টায় টঙ্গীর খাঁ পাড়া রোডের মোড়ে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করেন সিজন্স ড্রেসেস লিমিটেডের শ্রমিকরা। দুপুর সাড়ে ১২টায় সেনাবাহিনীর মধ্যস্থতায় শ্রমিকরা মহাসড়ক ত্যাগ করেন।

এ বিষয়ে কারখানার মালিক বাহাউদ্দিন চৌধুরী বাকের কালের কণ্ঠকে বলেন, বেতন দেওয়া হয়েছে। ব্যাংকিং চ্যানেলে সমস্যার কারণে তাঁরা বেতন হাতে পাননি। তাই মহাসড়ক অবরোধ করেছেন।

জানা যায়, টঙ্গী বিসিকের মা টাওয়ারে অবস্থিত অ্যামট্রানেট গ্রুপের প্রতিষ্ঠান গার্মেন্টস এক্সপোর্ট ভিলেজ লিমিটেড এবং আলম টাওয়ারে ব্রাভো অ্যাপারেলস ম্যানুফ্যাকচারার লিমিটেডের মোট পাঁচ হাজার ৬২০ জন শ্রমিক বেশ কিছুদিন ধরে ১৩ দফা দাবিতে আন্দোলন করে আসছেন। গতকাল কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের কিছু দাবি পূরণ করার পর তাঁরা বাকি দাবিগুলো আদায়ে কারখানার ভেতর গিয়ে প্রশাসনের কমকর্তাদের বের করে দেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কর্তৃপক্ষ দুটি কারখানা ছুটি ঘোষণা করে। এরপর শ্রমিকরা বাসায় চলে যান।

‘শ্রমিকদের কথা শোনার ধৈর্য নেই মালিকদের’: নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, তৈরি পোশাক খাতের নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব এ এইচ এম শফিকুজ্জামান বলেছেন, ‘শ্রমিকদের কথা শোনার ধৈর্য নেই মালিকদের। আমরা তাঁদের এমন আচরণে হতাশ।’

গতকাল নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়া বিকেএমইএ ভবনে নিট শিল্পের সূতিকাগার নারায়ণগঞ্জ অঞ্চলে শ্রমশৃঙ্খলা বজায় রাখার স্বার্থে সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের নিয়ে আয়োজিত মতবিনিময়সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।

শফিকুজ্জামান বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য বাংলাদেশকে গার্মেন্টসশিল্পে নাম্বার ওয়ান পজিশনে নিয়ে যাওয়া। আমাদের প্রধান উপদেষ্টা মহোদয়ও এমনটি চান। তবে আমি মালিকপক্ষকে নিয়ে হতাশ। আমাদের শ্রমিক প্রতিনিধিদের কথা শোনার ধৈর্য না থাকলে তো এটার সমাধান হবে না।’

শ্রমসচিব আরো বলেন, ‘ক্রেতারা আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। এখন আমাদের ঘুরে দাঁড়ানোর পালা। আমাদের একটি কমিটি রয়েছে। শ্রমিকদের যত আবেদন আছে, সেখানে দিন। আমার কাছে ১৩৮টি অভিযোগ এসেছে। প্রতিটি অভিযোগ আমরা খতিয়ে দেখব।’
বিকেএমইএ সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, শ্রমিকদের যেকোনো ন্যায্য দাবির সঙ্গে বিকেএমইএ ও বিজিএমইএ কাজ করে। শ্রমিক অসন্তোষ অব্যাহত থাকলে বিদেশি কম্পানিগুলো বাংলাদেশে বিনিয়োগ না করে অন্য দেশে চলে যাবে।

বিজিএমইএর সভাপতি খন্দকার রফিকুল ইসলাম বলেন, গত দেড় বছরে অর্ডার কম থাকাসহ নানা কারণে ২৭০টি ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে গেছে। সাভার, আশুলিয়া ও গাজীপুরে শ্রমিক অসন্তোষের কারণে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ অর্ডার অন্য দেশে চলে গেছে। তাই গার্মেন্টস সেক্টরকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে এই খাতে স্থিতিশীলতা জরুরি।

পিএনএস/রাশেদুল আলম

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন