আন্তর্জাতিক মঞ্চে বুয়েটের অক্সিজেট

  07-11-2021 05:04PM

পিএনএস ডেস্ক: গত বছরের মার্চ মাসে করোনার আতঙ্ক যখন শুরু হলো নিজেকে প্রশ্ন করছিলাম, আমি কি কোনোভাবে মানুষের উপকারে আসতে পারি? কিন্তু একা কোনো উদ্যোগ নেওয়া খুব সহজ নয়, এটাও মাথায় ছিল। তাই একদিন রাতে হঠাৎ আমার বিভাগের কয়েকজন ছাত্রকে ই-মেইল করলাম। লম্বা কোনো ই-মেইল নয়, শুধু ওদের জানালাম, এ রকম সংকটময় পরিস্থিতিতে আমাদের কিছু একটা করা উচিত। তাই চলো কিছু করি। কয়েকজন ছাত্র রাজিও হলো।

এরপর আমরা জুমে কয়েক দফা মিটিং করলাম। ঠিক করলাম উন্নত মানের ভেন্টিলেটর বানাব। সেই সময় অনেকেই ভেন্টিলেটর প্রকল্প নিয়ে কাজ করছিল। তাই বলা যায়, অনেকটা অন্যদের দেখে আমরাও ভেন্টিলেটর বানানোর কাজে অনুপ্রাণিত হলাম।

অ্যাসাইনমেন্ট নয়
শুরুতেই আমার ছাত্রদের বলে নিলাম, এটা কিন্তু ক্লাসের কোনো অ্যাসাইনমেন্ট নয়। এখানে কাজ করলে পরীক্ষায় বেশি নম্বর পাওয়া যাবে, সে রকম কোনো সম্ভাবনাও নেই। আবার এ কাজের প্রয়োজনে ঘরের বাইরেও যাওয়ার প্রয়োজন হতে পারে। সবকিছু ভেবে দেখো, তোমরা রাজি কি না।

পাঁচ-ছয়জন ছাত্র অবশেষে রাজি হয়ে গেল। তখন আমাদের খুব ছোট পরিকল্পনা ছিল। শুধু মাথায় ছিল, উন্নত মানের একটা ভেন্টিলেটর তৈরি করতে হবে। মাস দুয়েকের মধ্যে আমরা ভেন্টিলেটর প্রকল্পের কাজে অনেকটা এগিয়ে গেলাম। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের একটি পুরস্কারও জিতে গেলাম।

এর মধ্যে অমি নিয়মিত চিকিৎসক ও গবেষকদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিলাম। করোনার চিকিৎসায় কোন ধরনের মেডিকেল সরঞ্জাম ব্যবহার করা হচ্ছে, সেগুলো জানার চেষ্টা করছিলাম। কয়েক দিনের মধ্যেই বুঝতে পারলাম চিকিৎসকেরা করোনা রোগীদের জন্য ভেন্টিলেটরের চেয়ে হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলার প্রয়োজন বেশি অনুভব করছেন।

কারণ, শ্বাসকষ্টে ভোগা রোগীদের বেশি অক্সিজেনের দরকার হলে হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলা লাগে। কিংবা রোগীকে আইসিইউতে নিতে হয়। কিন্তু দেশের হাসপাতালগুলোতে বিশেষ এ ক্যানুলা ও আইসিইউ দুটোরই সংকট আছে। রোগীদের উচ্চমাত্রায় অক্সিজেন দেওয়ার জন্য বাজারে যেসব সিপ্যাপ যন্ত্র আছে, সেগুলো বেশ ব্যয়বহুল।

এ অবস্থা দেখে আমাদের পরিকল্পনা তখন ইউটার্ন নিল। এবার আমরা ঠিক করলাম অল্প খরচে সিপ্যাপ ডিভাইস বানাব, যেটা বিদ্যুৎ ছাড়াই চলবে। ২০১৯ সালে আমি উগান্ডায় এক সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলাম। সেখানে জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষকের কাছে শিখেছি মাঠে নেমে মূল সমস্যা চিহ্নিত করে পুনরাবৃত্তিমূলকভাবে চিকিৎসকদের পরামর্শ নিয়ে গবেষণা করা সম্ভব।

আমরা এই পন্থাই অবলম্বন করে কাজ শুরু করলাম। আমাদের উদ্ভাবন প্রকল্পের নাম দেওয়া হলো অক্সিজেট। নিজেদের মধ্যে কাজ ভাগ করে নিলাম। মীমনুর রশিদ, কাওসার আহমেদ, ফারহান মুহিব ও কায়সার আহমেদ বুয়েটের বায়োমেডিকেল বিভাগের এই চার শিক্ষার্থী তখন আমার সঙ্গী।

দশে মিলে করি কাজ
কাওসার আহমেদ আমাদের ক্লাসের ফার্স্ট বয়। আমাদের প্রকল্পের নকশা এবং প্রকল্পের বিশ্লেষণমূলক কাজগুলোর দায়িত্ব তাঁর কাঁধেই ছিল। আর কায়সার আহমেদ টিম প্লেয়ার। যন্ত্রপাতি কেনাকাটা থেকে শুরু করে হাসপাতালে যাওয়া-আসা কিংবা চিকিৎসকদের সহায়তা সবকিছুই সমানতালে করেছেন।

এদিকে মীমনুর রশিদের বাসা ছিল আমাদের অস্থায়ী গবেষণাগার। লকডাউন আর করোনা সংক্রমণ ঝুঁকির কারণে সব সময় বুয়েটের ল্যাবে যাওয়া সম্ভব ছিল না। তাই বুয়েটের ল্যাব থেকে বেশ কিছু যন্ত্রপাতি মীমনুরের বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। বুয়েটে কর্তৃপক্ষ আর উপাচার্য সত্য প্রসাদ মজুমদার স্যারের প্রতি এ জন্য আমরা কৃতজ্ঞ।

মীমনুরের বাসায় প্রকল্পের প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষাগুলো করা হতো। এসব কাজের পর সেগুলো ভিডিও করে মীমনুর আমাদের পাঠিয়ে দিত। তারপর সেই ভিডিও দেখে আমরা ফিডব্যাক দিতাম।

তত্ত্বীয় বিষয়, গবেষণা আর লেখালেখি করত ফারহান মুহিব। এভাবেই আমরা একটি দল হয়ে কাজ করেছি। প্রথমে বলেছিলাম এই চার শিক্ষার্থী আমার সঙ্গী। কিন্তু পরে এসে বুঝলাম আসলে আমিই তাদের সঙ্গী। বিভাগের প্রভাষক সাঈদুর রহমান কিছু তত্ত্বীয় বিষয়ে আমাদের সাহায্য করেছেন। কাজ করতে গিয়ে শিক্ষক-ছাত্র এ রকম দেয়াল ছিল না আমাদের মধ্যে। বরং কখনো নতুন কিছু বিষয়ে আমার ছাত্ররা আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছে। আমার মতে, আমাদের গবেষণা কিংবা উদ্ভাবন এ ধাপেই অনেকটা সার্থকতা পেয়েছে।

যেভাবে অনুমোদন
এর আগে গত ডিসেম্বরে যখন প্রথম আলোর স্বপ্ন নিয়ের সঙ্গে কথা হয়েছিল তখন আমাদের অক্সিজেট বাংলাদেশ চিকিৎসা গবেষণা পরিষদের (বিএমআরসি) অনুমোদনক্রমে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের অপেক্ষায় ছিল। এর কিছুদিন পরই আমরা ঢাকা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. টিটু মিয়াহ ও শিক্ষক ডা. রোবেদ আমিন স্যারের সহায়তায় তিন ধাপে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল করেছি।

ট্রায়ালের দ্বিতীয় ধাপে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ইয়েলো জোনে, রোগীদের খুব কাছে কয়েকবার যেতে হয়েছে। ডা. খাইরুল ইসলাম, ডা. মারুফ, ডা. মহিউদ্দিন, ডা. নওসাবাহ, ডা. রাতুল ও ডা. সোহানা সে সময় খুব সাহায্য করেছেন। তিন ধাপের সফলতার পর চলতি বছরের জুলাইয়ে সরকারের ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর (ডিজিডিএ) অক্সিজেটের উৎপাদন ও ব্যবহারের জন্য সীমিত অনুমোদন দেয়।

আসলে অনুমোদনের ধাপগুলোর বর্ণনা দিতে গেলে কয়েক দিস্তা কাগজ লাগবে। শুধু এটুকুই বলব, প্রকল্পের শুরু থেকে ডিজিএর অনুমোদন পাওয়া পর্যন্ত আমরা কখনো হাল ছাড়িনি। ধৈর্য আর ভালো কিছুর প্রত্যাশা নিয়ে আমরা সব সময় অপেক্ষা করেছি।

আমরা শুরু থেকেই কিছুটা প্রচারবিমুখ ছিলাম। কারণ, এ প্রকল্প কতটা সফল হবে—সেটা নিয়ে সংশয় ছিল। তবে প্রথম আলোর স্বপ্ন নিয়েতে আমাদের নিয়ে লেখার পর অনেকেই বিষয়টি জেনে গেল।

এরপর ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে যখন আমরা সফলতা পাচ্ছিলাম। আমাদের আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। সরকারি অনুমোদনের জন্য যে দপ্তরে গিয়েছি, সেখানেই অক্সিজেটকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দিতে হয়নি।

ধৈর্য আর ভালো কিছুর প্রত্যাশা নিয়ে আমরা সব সময় অপেক্ষা করেছি। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদপ্তরের আইডিয়া প্রকল্পের অধীনে অক্সিজেটকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে। এদিকে ট্রায়ালের জন্য ডিভাইস তৈরির খরচ দিয়েছে অংকুর ফাউন্ডেশন ও মানুষ মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন। এছাড়া বুয়েটের প্রাক্তন শিক্ষার্থী সামিউন নবী সার্বিকভাবে আমাদের সহযোগিতা করেছেন।

আন্তর্জাতিক মঞ্চে
বর্তমানে প্রেরণা ফাউন্ডেশন বুয়েটে একটি অত্যাধুনিক ল্যাব তৈরি এবং অক্সিজেট যন্ত্রের উন্নয়নে আর্থিক সহায়তা করছে। সম্প্রতি অক্সিজেট আরও কিছু সাফল্য পেয়েছে। বঙ্গবন্ধু ইনোভেশন গ্রান্টে ফাইনালিস্ট ছিল আমাদের এ প্রকল্প। এদিকে যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংস্থা ইনোভেশন ফোরামের সেরা স্টার্টআপ প্রতিযোগিতার আন্তর্জাতিক পর্বের সেরা ১৫-এর আছে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং সোসাইটির প্রতিযোগিতায়ও বিশ্বে সেরা ৩-এর মধ্যে স্থান পেয়েছে।

জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা পদ্ধতিতে অনুপ্রাণিত হয়ে আমরা যে প্রকল্প নিয়ে কাজ করে সফলতা পেলাম, সেই প্রকল্প নিয়ে কথা বলার জন্যই জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। গত ৫ অক্টোবর ওই বিভাগের সেন্টার ফর বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং ইনোভেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের একটি সেমিনারে আমি অক্সিজেট নিয়ে বক্তব্য দিয়েছি। সেখানে সবাই আমাদের প্রকল্প নিয়ে প্রশংসা করেছেন।

আমাদের এই গবেষণা প্রকল্প ও উদ্ভাবনে কাজ করার অভিজ্ঞতার আলোকে জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান কিছু গবেষণার ব্যাপারেও আমার ফিডব্যাক চাওয়া হয়েছিল। এটা আমার ও বাংলাদেশের জন্য অনেক বড় সম্মানের বিষয় ছিল। অক্সিজেট মৌলিক কোনো আবিষ্কার—সেটি আমি দাবি করছি না, তবে আমাদের প্রকল্প যে বিশ্ব মানের হয়েছে, সেটা দাবি করাই যায়।

জনস হপকিনসে বক্তব্য দিতে গিয়ে বুঝেছি, আমাদের গবেষণা প্রকল্প নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বেশ আগ্রহ আছে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে জনস হপকিনসের মতো বিশ্বের খ্যাতনামা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় যৌথভাবে গবেষণার কাজ করছে। আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভালো মানের গবেষণা হচ্ছে।

তবে আমরা যদি বিশ্বের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে পারি, তাহলে আরও ভালো মানের গবেষণা করতে পারব।

পিএনএস/আইএইচ

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন