‌বগুড়ায় ঘূর্ণিঝড় অশনির প্রভাবে লোকসানের মুখে বোরো চাষিরা

  15-05-2022 01:09PM


পিএনএস ডেস্ক: ঘূর্ণিঝড় অশনির প্রভাব পড়েছে বগুড়ায়। বাম্পার ফলন ঘরে তোলার কথা থাকলেও অশনির কারণে ঝড়ো বাতাস ও টানা কয়েকদিনের বৃষ্টিতে উঠতি বোরোর ফলন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অশনির বৃষ্টিপাতে পানিতে লুটোপুটি খাচ্ছে জমির পাকা বোরা ধান। সেইসঙ্গে ধান কাটা শ্রমিক সংকট থাকায় সময়মত ধান না কাটতে পারায় পানিতে ডুবে থাকা ধানের শীষ ক্ষেতেই পচে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ভালো ফলন না পাওয়ার কারণে প্রতি বিঘায় সাত হাজার থেকে নয়হাজার টাকা লোকসানের মুখে পড়েছে বোরো চাষিরা।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বগুড়ার উপ সহকারী কর্মকর্তা ফরিদ উদ্দিন জানান, চলতি বছরে জেলায় ১ লাখ ৮৭ হাজার ৪১৫ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। সেখানে শেষ পর্যন্ত মোট আবাদ হয়েছিল ১ লাখ ৮৭ হাজার ৭৫৫ হেক্টর জমিতে। এর বিপরীতে চাল আকারে উৎপাদন হওয়ার ৮ লাখ ৭ হাজার ৬২৩ মেট্রিকটন চাল পাওয়ার কথা। গত বছর চাষ হয়েছিল ১ লাখ ৮৮হাজার ৫১০ হেক্টর। আর চাল আকারে উৎপাদন হয়েছিল ৮ লাখ ১০ হাজার ৫৯০ মেট্রিক টন। এবছর প্রতি হেক্টরে ফলন পাওয়া যাবে ৫ থেকে ৬ টন করে। বগুড়ায় লাভজনক হওয়ায় প্রতি বছরই রেকর্ড পরিমান জমিতে বোরো চাষ হয়ে থাকে। এবারও ভালো ফলনে ভালো দামের প্রত্যাশা করছিল চাষীরা। প্রাকৃতিক দুর্যোগ হওয়ায় এবার জেলায় শেষ পর্যন্ত বাম্পার ফলনের আশা করা যাচ্ছে না।

বগুড়ার সোনাতলা উপজেলার বোরো চাষি আবু মুসা জানান, ১০ হাজার টাকা খরচে বিঘাপ্রতি ১৮ থেকে ৩০ মন ধান পাওয়া যায়। জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত ধান রোপন শেষে এপ্রিল মাসের শেষে ধান কেটে ঘরে তুলতে হয়। কিন্তু এবার ঝড়ো বাতাস ও টানা কয়েকদিনের বৃষ্টিতে উঠতি বোরোর ফলন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রতি বিঘায় সাত হাজার থেকে নয়হাজার টাকা লোকসানের মুখে পড়তে হচ্ছে।

বগুড়ার শেরপুর উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এক বিঘা জমিতে ধান লাগানো থেকে শুরু করে কাটা-মাড়াই ও জমির মালিককে বর্গাবাবদ টাকা দেওয়া পর্যন্ত প্রায় ২২ হাজার ২০০ টাকা ব্যয় করতে হয়েছে। আর বর্গাবাবদ ৭ হাজার টাকা বাদ দিয়ে হিসেব কষলে প্রতিবিঘা জমির বিপরীতে একেকজন কৃষকের খরচের পরিমান দাঁড়ায় ১৫ হাজার ২০০ টাকা। অথচ সেই জমি থেকে অশনির বৃষ্টির কারণে সর্বোচ্চ ১৬ থেকে ১৮ মণহারে ধানের ফলন মিলছে। অশনির আগে এই জমি থেকে ২২ মন করে ধান পাওয়ার কথা ছিল। বাজারদর অনুযায়ী প্রতিমণ ভেজা ধান ৬০০ থেকে ৭০০ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে। সেই হিসাবে প্রতিবিঘা জমি থেকে নয় থেকে দশহাজার টাকার ধান বিক্রি করতে পারছেন।

শেরপুর উপজেলা কৃষি অফিস জানায়, চলতি মৌসুমে এই উপজেলায় ২০ হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে বোরো ধান চাষ করা হয়। শুরু থেকে আবহাওয়া মোটামুটি অনুকূলে থাকলেও ফসল ঘরে তোলার সময় আবহাওয়া অনুকূলে নেই। অশনির কারণে প্রায় দুই সপ্তাহধরে বৃষ্টিপাত হয়েছে। বিশেষ করে অশনির প্রভাবে এই উপজেলার ওপর দিয়ে ঝড়-বৃষ্টি বয়ে গেছে। এতে করে ১ হাজার ৬৫০ হেক্টর জমির ফসলের ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে।

তবে বাস্তব চিত্র সম্পূর্ণ উল্টো। অশনির ওই ঝড়-বৃষ্টিতে উপজেলার সিংহভাগ জমির ধান মাটিতে নুয়ে পড়েছে। এমনকি ক্ষেতে জমে থাকা সেই পানিতে ধানের শীষ ডুবে পচে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। শ্রমিক সংকটে জমির পাকা ধান কাটতেও পারছে না।

এদিকে এসব নানা প্রতিকূলতার মাঝেও বসে নেই কৃষক। ক্ষেতের ফসল ঘরে তোলার প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। বৈরী আবহাওয়ার মধ্যেই ধান কাটা-মাড়াই শুরু করেছেন। তবে ধান কাটা শ্রমিক সংকট মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক দিয়েও মিলছে না শ্রমিক। আবার কোথাও মিললেও একদল শ্রমিক পাবার জন্য একাধিক কৃষক টানাটানি করছেন। আর এই সুযোগ নিয়ে শ্রমিকরা তাদের ইচ্ছেমাফিক মজুরি নিচ্ছেন। চুক্তি অনুযায়ী বাড়ি থেকে জমির দুরুত্ব বুঝে একবিঘা জমির ধানকাটা বাবদ ৫ হাজার থেকে ৮ হাজার টাকা পর্যন্ত পারিশ্রমিক গুণতে হচ্ছে। পাশাপাশি প্রত্যেককে তিনবেলা খাবার খরচ দিতে হচ্ছে।

কৃষক গোলাম রব্বানী বলেন, এমনিতেই বৈরী আবহাওয়া। তারপর শ্রমিক সংকট। সেইসঙ্গে ধানের বর্তমান বাজারদর কৃষকের কোমর ভেঙে দিচ্ছে। এই ভাঙা কোমর নিয়ে আগামি মৌসুমের ফসল কি করে চাষ করবেন -এমন ভাবনায় এখন থেকেই ভীষণভাবে শঙ্কিত তারা।

শেরপুর উপজেলার উচরং গ্রামের কৃষক আব্দুল বারিক জানান, তিনি চলতি মৌসুমে প্রায় ২০ বিঘা জমিতে বিভিন্ন জাতের বোরো ধান লাগিয়েছেন। এসব জমির ধান পেকেও গেছে। কিন্তু অব্যাহত বৃষ্টি ও ঝড়ে ধান মাটিতে নুয়ে পড়েছে। সেইসঙ্গে ক্ষেতের মধ্যে জমে থাকা পানিতে ভাসছে ধান। এমন অবস্থায় শ্রমিকরাও ধান কাটতে রাজী হচ্ছে না। দ্বিগুণ দাম দিয়ে দশ বিঘা জমির ধান কাটতে পারলেও বাকি জমির ধান পানির মধ্যেই ভাসছে। ধান দ্রুত কাটতে না পারলে জমিতেই পচে নষ্ট হয়ে যাবে। এছাড়া বৈরী আবহাওয়ার কারণে ক্ষেতের কেটে আনা কাঁচাভেজা ধান কাঙ্খিত দামে বিক্রিও করতে পারছেন না। প্রতিমণ ধান ৫৯০-৭০০টাকায় বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন। এতে করে তাকে লোকসান গুনতে হচ্ছে।

সাধুবাড়ী গ্রামের কৃষক আব্দুস সাত্তার বলেন, নিচু এলাকায় লাগানো প্রায় দশবিঘা জমির ধান পানিতে ডুবে রয়েছে। শ্রমিকরা কাটতেই চাচ্ছে না। এছাড়া কাটার যে মজুরি দাবি করছে, তা জমির উৎপাদিত সব বিক্রি করেও হবে না। তাই ওইসব জমির ধান কাটার চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়েছি। পানিতে ভাসতে থাকা ধানগুলো পচে নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর জমি পরিস্কার করবেন।

বগুড়ার শেরপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জান্নাতুল ফেরদৌস বৈরী আবহাওয়ার কারণে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, মৌসুমের শেষসময়ে এসে আবহাওয়া প্রতিকূল হওয়ায় যেসব জমির ধান আশিভাগ পেকে গেছে তা দ্রুত কেটে ঘরে তোলার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সেই নির্দেশনা অনুযায়ী কৃষকরা ধান কাটছেন। ইতিমধ্যে পঞ্চাশ থেকে ষাটভাগ জমির ধান কেটে ঘরে তুলতে সক্ষম হয়েছেন তারা। তাই চিন্তার তেমন কোনো কারণ নেই।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বগুড়ার উপ-পরিচালক কৃষিবিদ দুলাল হোসেন জানান, ধান ও চালের মুল্য ভালো পাওয়ায় কৃষক ধান চাষে আগ্রহী হচ্ছে। আবহাওয়া না ভালো থাকায় কৃষকরা তাড়াতাড়ি তাদের ফলন কৃত ধান ঘরে তুলতে ব্যস্ত হয়েে পড়েছে। তাছাড়া বগুড়া কৃষি এলাকা। প্রতি বছরই এই বোরোর বাম্পার ফলন পাওয়া যায়। মাঠ পর্যায়ে কৃষি কর্মকর্তাদের নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। নির্দেশনা মোতাবেক তারা কৃষকদের বিভিন্ন পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে পাকা ধান কাটার জন্য। এবার ঈদের আগেই ধান কাটা শুরু হয়েছে।


পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন