রপ্তানি বন্ধ তবু দেশে দেশে মিলছে বাংলাদেশের ইলিশ!

  25-11-2017 12:32PM

পিএনএস ডেস্ক: পূর্ব লন্ডনের হোয়াইট চ্যাপেল এলাকায় প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য পৃথক দোকান চোখে পড়ে। সেগুলোর মধ্যে একটি গ্রোসারি শপের নাম হাট-বাজার।

দোকানটিতে সাজানো রয়েছে ফলমূল, শাকসবজি, মাছসহ নানা পণ্য। আর বিশাল আকারের রেফ্রিজারেটরে অন্য অনেক মাছের সঙ্গে রয়েছে সুস্বাদু ইলিশ। তাও আবার বাংলাদেশের চাঁদপুরের।

ইলিশের একটি প্যাকেটে বড় হরফে বাংলা ও ইংরেজিতে লেখা ‘চাঁদপুরি’। প্যাকেটের গায়ে রপ্তানিকারী প্রতিষ্ঠানের ব্র্যান্ডের নামও রয়েছে—‘ডায়মন্ড ব্র্যান্ড’। মাছের ওজন ৮০০ থেকে এক হাজার গ্রাম। প্রতি কেজি ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ১৫ পাউন্ডে। লন্ডনে বসবাস করা কয়েকজন প্রবাসী বাংলাদেশির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দেশটির বিভিন্ন জায়গায় কমবেশি বাংলাদেশের ইলিশ নিয়মিত পাওয়া যায়।

হোয়াইট চ্যাপেল এলাকার বাসিন্দা বাংলাদেশ সেন্টার লন্ডনের মিডিয়া অ্যান্ড আইসিটি উপকমিটির আহ্বায়ক আলী বেবুল জানান, ‘লন্ডনে বসেও আমরা দেশের ইলিশ পাচ্ছি।

এটা আমাদের জন্য গর্ব ও আনন্দের। তবে রপ্তানি বন্ধ থাকার পরও কিভাবে তা এই সুদূরে চলে আসে তা আমরা জানি না। যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে এসে থাকলে আমাদের দেশ উপকৃত হবে। আর আমরা সেটাই চাই। ’

বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া ইলিশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার বাজারে বিক্রি হয়—এমন অভিযোগ দীর্ঘদিনের। প্রাপ্ত তথ্য বলছে, কলকাতা তো বটেই, ভারতের অন্যান্য জায়গায়ও বাংলাদেশের ইলিশ মাছ পাওয়া যাচ্ছে। দেশটির চেন্নাইয়ের ভেলোরে মেইন বাজার রোডের একটি দোকানে পদ্মার ইলিশ বিক্রি করতে দেখা গেছে। সেখানে চিকিৎসা সুবিধা নিতে যাওয়া এক বাংলাদেশি জানান, এখানকার দোকানগুলোতে প্রতি কেজি ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ৬০০ রুপিতে।

একইভাবে জার্মানির ফ্রাংকফুর্টে ঘুরতে যাওয়া একদল বাংলাদেশি এবং সেখানকার কয়েকজন প্রবাসীও জানিয়েছে যে সেখানে ৮০০ থেকে এক হাজার গ্রাম ওজনের চাঁদপুরের ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে।

২০১০ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত দুই অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে ইলিশ মাছ রপ্তানি হয়েছে। দেশের মানুষ খেতে পায় না, অথচ রপ্তানি হয়—এ ধরনের সমালোচনার মুখে সরকার এই সিদ্ধান্ত নেয়। একই সঙ্গে ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধির দিকে বিশেষভাবে নজর দেওয়া হয়। তাতে ফলও মেলে। উৎপাদন বৃদ্ধির ধারাবাহিকতায় ২০১৫-১৬ সালে দেশে ইলিশের উৎপাদন পৌঁছে যায় তিন লাখ ৯৮ হাজার টনে। মৎস্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা ধারণা করছেন, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ইলিশের উৎপাদন হবে পাঁচ লাখ টন। তবে উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে ইলিশ পাচারের ঝুঁকি।

তথ্য মতে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশের ইলিশের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। একসময় বাংলাদেশ থেকে বছরে পাঁচ হাজার টন ইলিশ আমদানি করত ভারতের পশ্চিমবঙ্গ। নিষেধাজ্ঞা আরোপের আগে চাঁদপুর থেকে সরাসরি ইলিশ যেত ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে। রাজ্যটিতে প্রতিদিন ৩০ টন মাছ যেত, যার বেশির ভাগই ছিল ইলিশ। ২০১২ সালে বাংলাদেশ ইলিশ রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়ার পর থেকে চোরাইপথে পাচারের তৎপরতা বেড়েছে।

বিশেষ প্রতিনিধি ফখরে আলম যশোর থেকে জানিয়েছেন, এবার দেশের বাজারের কাছাকাছি দামেই বাংলাদেশের ইলিশ বিক্রি হয়েছে কলকাতায়। রপ্তানি বন্ধ থাকলেও সেখানে বাংলাদেশের ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে। কারণ জেলের জালে ধরা পড়ার পর সাগর থেকে ইলিশ পাচার হয়ে যাচ্ছে। আবার পাসপোর্টধারী লাগেজ পার্টির সদস্যরাও বিভিন্ন চেকপোস্ট দিয়ে ইলিশ নিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। মাল্টিপল ও বিজনেস ভিসার সুবিধায় ভারত থেকে বিভিন্ন ধরনের মালামাল নিয়ে প্রায় ২০০ লাগেজ পার্টির সদস্য বাংলাদেশে ঢুকে ফেরার পথে ইলিশ নিয়ে যায়। ত্রিপুরাসংলগ্ন কয়েকটি সীমান্তপথেও ইলিশ পাচারের ঘটনা ঘটেছে।

খবর নিয়ে জানা যায়, এবার ভরা মৌসুমে কলকাতার হাওড়া, বারাসাত, বনগাঁ, মোছলোন্দপুর, শিয়ালদহ, বেহালাসহ অন্যান্য মাছের পাইকারি বাজারে ইলিশের আধিক্য ছিল। প্রচুর সরবরাহের কারণে এসব ইলিশ ক্ষেত্রবিশেষে বাংলাদেশের চেয়েও কম দামে বিক্রি হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে পটুয়াখালীর মহিপুর বন্দর মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি ফজলু গাজী বলেন, ‘এবার ভারতের জেলেদের জালেই বেশি ইলিশ ধরা পড়েছে। বড় বড় ফিশিং বোট নিয়ে ওরা আমাদের জলসীমায় ঢুকে শত শত মণ মাছ ধরে নিয়ে গেছে। ’

অনুসন্ধানে জানা যায়, ইলিশ ধরার মৌসুমে বঙ্গোপসাগর থেকে নদীমুখী হয়। বঙ্গোপসাগরের বিষখালী, রাঙ্গাবালি, আন্ধারমানিক নদীর মোহনাসহ বরিশালের বিভিন্ন নদীর মোহনায় জেলেরা এ সময় ইলিশ শিকার করে। ভারতীয় মহাজনরা ‘কন্ট্রাক্ট’ করে স্থানীয় জেলেদের কাছ থেকে ইলিশ কিনে নিয়ে যায়। কোনো কোনো সময় ট্রলারসহ ইলিশ কিনে নিয়ে পরে ট্রলার ফেরত দেয়। এ ক্ষেত্রে ট্রলারের নামও পরিবর্তন করা হয়।

পশ্চিমবঙ্গ ফিশ ইম্পোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, ‘বৈধভাবে বাংলাদেশ থেকে আমদানি বন্ধ থাকায় ইলিশ ধরার পর নৌপথেই তা ভারতে পাচার হয়ে আসছে। আগে যে পরিমাণ মাছ বৈধভাবে আমদানি হতো, এখন প্রায় সমপরিমাণ চোরাইপথে আসছে। ’

মৎস্য অধিদপ্তরের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, ‘ইলিশ পাচার হচ্ছে না এটা বলা যাবে না। বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের ইলিশ পাওয়া যাওয়ার তথ্যও ঠিক আছে। তবে রপ্তানি বন্ধ থাকা সত্ত্বেও কিভাবে বিভিন্ন দেশে ইলিশ পাচার হচ্ছে তা আরো তদন্ত করে দেখার বিষয়। ’

এদিকে মৎস্য অধিদপ্তরও চায় বৈধপথে ইলিশ মাছ রপ্তানি হোক। কিন্তু সে জন্য নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তারা ইলিশের উৎপাদন পর্যবেক্ষণ করতে চায়। মৎস্য অধিদপ্তরের জাটকা সংরক্ষণ, জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থান ও গবেষণা প্রকল্পের পরিচালক এ বি এম জাহিদ হাবিব জানান, ‘আমরা আরেকটি সিজন দেখব। তারপর সিদ্ধান্ত। ’

অধিদপ্তরের মহপরিচালক সৈয়দ আরিফ আজাদও একই কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘রপ্তানির বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। আমরা আগামী জুন-জুলাই পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করব। চাহিদার তুলনায় উৎপাদন ঠিক থাকলে ইলিশ রপ্তানির জন্য মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করব। ’

সূত্র: কালের কণ্ঠ

পিএনএস/আলআমীন

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন