পর্যাপ্ত জামানত ছাড়া ঋণ দিয়ে ডুবছে ব্যাংক

  11-04-2018 09:09AM


পিএনএস ডেস্ক: প্রভাবশালীরা নানা ছলে মোটা অঙ্কের ঋণ হাতিয়ে নিচ্ছে, পরে শোধ না করার ক্ষেত্রেও চাতুরি করছে। ব্যাংকগুলোও কাউকে কাউকে পর্যাপ্ত জামানত ছাড়াই ঋণ দিয়ে যাচ্ছে স্রেফ সুনামের খাতিরে এবং পরে তা আদায় করতে পারছে না। এ ছাড়া সুযোগসন্ধানী ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ নেতিবাচক রাজনৈতিক পরিস্থিতিরও সুযোগ নিচ্ছে। খেলাপি ঋণ শোধ না করার পক্ষে অজুহাত হিসেবে রাজনৈতিক সহিংসতাকে দাঁড় করাচ্ছে। তারপর বিশেষ রেয়াতসহ কিস্তির সময়সীমা বাড়িয়ে নিয়ে এবারও ঋণ শোধ করছে না এবং নতুন কোনো অজুহাতে সময় বৃদ্ধির চেষ্টা চালাচ্ছে। ২০১৫ সালে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ ‘পুনর্গঠন’ করে শোধের সময় বাড়িয়ে নেয় ১১টি বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান।

অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ গ্রাহকদের বিশেষ ছাড় দেওয়ার নিয়ম করেছিল; এর যেহেতু অপব্যবহার হচ্ছে—এখন তাদেরকেই নিয়ম সংশোধনের কথা ভাবতে হবে। ঋণদানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তাকে চিহ্নিত করে তাঁর বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি করছে কেউ কেউ।

এ ছাড়া বিদেশে পণ্য রপ্তানির ঋণপত্র (এলসি) খুলে এফডিবিপির মাধ্যমে এবং আমদানির ক্ষেত্রে বন্দর থেকে পণ্য খালাস ও পরিবহনের জন্য নেওয়া ‘বিশ্বাসের ঋণ’ বলে খ্যাত ‘এলটিআর’ তথা লোন এগেইনেস্ট ট্রাস্ট রিসিটর বিপরীতে নেওয়া ঋণও অনেকে শোধ করছে না। বেসরকারি ব্যাংকের কোনো কোনো কর্মকর্তা বলছেন, ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে অনেক পরিচালকও তাঁদের ওপর চাপ দেন। কথা না শোনায় অনেক ব্যাংকের এমডিকে চাকরিও হারাতে হয়েছে। ফুঁসলিয়ে ঋণ দেওয়ারও অভিযোগ আছে ব্যাংকের বিরুদ্ধে—পরে যা অনেক গ্রাহক শোধ করতে পারে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, গত ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের অঙ্কটি ছিল ৭৪ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা (মোট ঋণের ৯.৩১ শতাংশ)। সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠক সূত্রে জানা যায়, শীর্ষ ২৫ ঋণ খেলাপির কাছে সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকারও বেশি আটকে আছে।

ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, রাজনৈতিক পরিস্থিতির নাম করে ২০১৫ সালে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ শোধের সময় পুনর্নির্ধারণ তথা বাড়িয়ে নেয় ১১টি বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান। প্রচলিত ১০ শতাংশ ডাউন পেমেন্টের বদলে তাদের থেকে নেওয়া হয় এক থেকে দুই শতাংশ অর্থ। ব্যাংক তাদের এই ছাড় দিলেও ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো ফের ঋণ পরিশোধে গড়িমসি করে, এখন আবারও সময় বৃদ্ধি তথা ঋণ পুনর্গঠনের চেষ্টা করছে বলে জানা গেছে।

সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১১টি প্রতিষ্ঠান বিশেষ সুবিধায় প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ পুনর্গঠন করিয়ে নেয় ২০১৩ সালে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ব্যবসায় মার খাওয়ার কথা বলে। ওই সময় এই প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিটির ঋণ ছিল ৫০০ কোটি টাকার ওপরে। এর মধ্যে একটি প্রতিষ্ঠানের ঋণই ছিল পাঁচ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ পুনর্গঠন করে দীর্ঘমেয়াদে তা পরিশোধের সুযোগ দেওয়া হয়। এরপর সেই সুযোগটিও কাজে লাগাতে পারেনি এই প্রতিষ্ঠানগুলোর কয়েকটি। একটি বা দুটি কিস্তি দিয়ে এখন তারা আর কিস্তি পরিশোধ করছে না। জানা গেছে, এর মধ্যে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করার প্রস্তুতি নিয়েছে ব্যাংকগুলো।

এ ছাড়া খেলাপি ঋণের একটি বড় অংশ তৈরি হয়েছে বৈদেশিক বাণিজ্য ঘিরে। রপ্তানির ক্ষেত্রে এলসি বা ঋণপত্রের বিপরীতে দেওয়া ঋণ সুবিধার কিছু টাকা অনাদায়ী থাকছে। ঋণপত্রের বিপরীতে ১৮০ দিন বা একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত পণ্য রপ্তানির অর্থ দেশে আসার কথা থাকে। এই সময়ে প্রতিষ্ঠানগুলো ওই রপ্তানির নথিপত্র (ফরেন ডকুমেন্ট বিল পারচেজ) জমা রেখে চলতি মূলধন ঋণ নিতে পারে। ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, এই ধরনের ঋণ খেলাপি হয়ে পড়লে অর্থ আদায় কঠিন হয়ে যায়। রপ্তানির ক্ষেত্রে আরেক ধরনের ঋণ রয়েছে যেটাকে বলা হয় অভ্যন্তরীণ বিল ক্রয় (আইবিপি)। এ ক্ষেত্রে কোনো পণ্য বিদেশে রপ্তানি করার আগে এর উপকরণ কেনার জন্য স্থানীয়ভাবে কিছু ঋণপত্র খোলা হয়। কিন্তু পণ্য রপ্তানি না করে ভুয়া কাগজপত্র দেখিয়ে ঋণপত্র খুলে মোটা অঙ্কের টাকা তুলে নেওয়া হয় কোনো রকম জামানত ছাড়াই। এর উদাহরণ হলমার্ক এবং বিসমিল্লাহ টাওয়েল গ্রুপ।

আরো এক ধরনের ঋণ আছে যা দেওয়া হয় বড় বড় কিছু প্রতিষ্ঠানকে। ব্যাংক বিশ্বাস করতে পারে এমন কিছু প্রতিষ্ঠানকে এলটিআর সুবিধা দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো বিশ্বাস করে আমদানিকৃত পণ্য ছাড় ও পরিবহনে আমদানিকারকদের সহায়তা করে। নিয়ম হচ্ছে—আমদানিকারক বা আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ওই পণ্য বিক্রি করে ধীরে ধীরে ঋণ পরিশোধ করে। এই ঋণও অনেক সময় খেলাপি হয়ে পড়ছে। এলটিআর ঋণকে পরবর্তী সময়ে ‘ফোর্সলোন’ হিসেবে দেখিয়ে গ্রাহকের কাছ থেকে আদায়ের চেষ্টা চলে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘বাংলাদেশে একবার কাউকে কোনো সুবিধা দেওয়া হলে সে বারবার সেই সুবিধা নিতে চায়। এটাই এ দেশের সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। পুনর্গঠনের নীতিমালা করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংকই। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংককেই ব্যবস্থা নিতে হবে। অডিট ফার্ম, চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টদের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ঋণগুলো পুনর্গঠন করা হয়েছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক অনুমোদন দিয়েছিল। এখন সংশ্লিষ্ট সব পক্ষ বসে এই ঋণগুলোর বিষয়ে কী করা যায় সেটা ভাবতে হবে।’ এ ছাড়া নতুন ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোকে আরো সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক এই গভর্নর।

বড় বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানকে পর্যাপ্ত জামানত ছাড়া ঋণ দেওয়ার প্রতিযোগিতা বন্ধের তাগিদ দেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ। তিনি বলেন, ‘নিয়মের বাইরে গিয়ে কেউ কিছু করলে তাকে অবশ্যই শাস্তির আওতায় আনতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রতিটি ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রেই সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তার নাম কাগজ ঘাঁটলেই বেরিয়ে আসবে। তবে এখানে দেখতে হবে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা কি পরিচালক বা ওপর মহল বা বাইরের কারো প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে ঋণটি দিয়েছেন কি না। এটা তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিলে এভাবে ব্যাংকের টাকা লুটপাট বন্ধ হবে।’ তবে এখন পর্যন্ত এ ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি জানিয়ে তিনি বলেন, এটা না করা পর্যন্ত ঋণ জালিয়াতি এবং ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের হাতে ব্যাংকের অর্থ কুক্ষিগত হওয়া নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।

জামানত ছাড়া এবং প্রতিষ্ঠানের যোগ্যতার সীমাবদ্ধতা বিবেচনা না করে শুধু পরিচিতির ভিত্তিতে ঋণ দেওয়ারও সমালোচনা করছেন বিশেষজ্ঞরা। কিছুদিন আগেও একটি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকে চামড়া ও পোশাক শিল্পের দুটি বড় গ্রুপের ঋণ অনিয়মের কথা জানা গেছে। হিসাব করে দেখা গেছে, এই প্রতিষ্ঠানগুলোর সব সম্পত্তি বিক্রি করলেও ব্যাংকটি ঋণের টাকা তুলতে পারবে না।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ব্যাংকের অনেক কর্মকর্তা বা পরিচালকের যোগসাজশে পর্যাপ্ত জামানত ছাড়াই ঋণ দেওয়া হচ্ছে। ঋণগুলো আদায়ও করা যাচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে প্রথম দায়ই হলো ব্যাংকের। এসব ঋণ বিতরণের সঙ্গে কারা জড়িত সেটা খুঁজে বের করে দৃশ্যমান শাস্তির আওতায় আনতে হবে। নইলে ব্যাংকের ঋণ নিয়ে খেলাপি হওয়ার মাত্রা বাড়তেই থাকবে।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ‘সরকারি ব্যাংকগুলো এখন অনেক সতর্কভাবে ঋণ বিতরণ করছে। বেসরকারি ব্যাংকগুলোই বরং এখন আগ্রাসী ব্যাংকিং করছে। এটা ব্যাংক খাতের জন্য খুবই অ্যালার্মিং একটি বিষয়।’

অভিযোগ রয়েছে, পরিচালকদের কথা না শোনায় অনেক ব্যাংকের এমডিকে চাকরি হারাতে হয়েছে। তবে বেসরকারি ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) সভাপতি ও এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার সম্প্রতি বলেন, কোনো ব্যাংকের মালিকের কারণে ওই ব্যাংকের এমডি পদত্যাগ করেছেন এমন কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ আমাদের কাছে নেই। কোনো ব্যাংকের এমডি তো আজ পর্যন্ত কোথাও বলেননি যে তিনি মালিকদের কারণে পদত্যাগ করেছেন। তাঁরা যদি না বলেন তাহলে আমরা কিসের ভিত্তিতে মন্তব্য করব?’

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর ও বর্তমান ব্যাংকিং রিফর্ম অ্যাডভাইজার এস কে সুর চৌধুরী বলেন, ‘ব্যাংকগুলো ভালো একটি পার্টি পেলে ঋণ দেওয়ার জন্য ওই পার্টির অফিসে গিয়ে বসে থাকে। এক পার্টি কিছুদিন আগে বাংলাদেশ ব্যাংকে এসে জানিয়েছে, ব্যাংকের চাপে পড়েই কয়েকটি প্রকল্পে ঋণ নিয়েছিলেন তিনি। তবে যে পরিমাণে ঋণ নিয়েছিলেন সেই মাত্রায় ব্যবসা বাড়াতে পারেননি। উল্টো ঋণের সুদ পরিশোধ করতে গিয়ে ঋণটি আর পরিশোধ করে উঠতে পারছেন না। পাঁচ-ছয়টি ব্যাংক ওই পার্টিকে ঋণ দিয়ে এখন পার্টির পেছনে ঘুরছে। পার্টি ঘুরছে খেলাপি হওয়ার হাত থেকে বেঁচে ব্যবসা পুনরুদ্ধার করার আশায়।’ সূত্র: কালের

পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন