রিজার্ভের টাকায় উন্নয়ন প্রকল্প, অর্থনৈতিক আতঙ্ক!

  10-07-2020 05:03PM

পিএনএস (আহমেদ জামিল) : করোনায় ঋণ আদায় ও আমানত প্রবাহ কমে যাওয়ায় ব্যাংকের ঋণ প্রদানের সক্ষমতা দিন দিন কমে যাচ্ছে। চরম অর্থনৈতিক সংকটে রয়েছে সরকার। অনেকটাই বাধ্য হয়ে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে রিজার্ভের টাকা হাত দিতে হচ্ছে সরকারকে। রিজার্ভ একমাত্র ব্যাকআপ । এখন রিজার্ভ থেকে প্রকল্পের জন্য ঋণ নেয়া কতটা যৌক্তিক তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। তাছাড়া ভাগবাটোয়ারা করে ঋণ নিচ্ছেন ব্যাংক পরিচালকেরা। যোগসাজশের মাধ্যমে এক ব্যাংকের পরিচালক আরেক ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছেন। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তা পরিশোধ না হওয়ায় বেকায়দায় ব্যাংকগুলো।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নিজ ব্যাংক ও অন্য ব্যাংক থেকে পরিচালকরা ঋণ নিয়েছেন প্রায় পৌনে দুই লাখ কোটি টাকা। এ ঋণ মোট ব্যাংক ঋণের ১২ শতাংশের বেশি।

সর্বশেষ মাত্র ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট নিয়ে দীর্ঘ ১০ বছরের জন্য ঋণ নবায়ন করা হয়। এতে সুদহারেও বড় ধরনের ছাড় দেয়া হয়। এর ফলে ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণের কারণে সঙ্কট কাটেনি। বরং দিন দিন বেড়ে গেছে। ডিসেম্বর শেষে প্রায় ৫৭ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করার পরও খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ৯৭ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা।

এর পর করোনার মহামারি থাবার কারণে প্রথম দফায় জানুয়ারি-জুন পর্যন্ত সময় খেলাপি ঋণ স্থগিত করা হয়েছে। দ্বিতীয় দফায় মহামারীর প্রকোপ দীর্ঘায়িত হওয়ায় আরও তিন মাস বর্ধিত করা হয়েছে এই সময়। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত কোনো ঋণের শ্রেণিমান পরিবর্তন করা যাবে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ থেকে এ সংক্রান্ত একটি নির্দেশনা জারি করা হয়েছে, যা সব ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের কাছে পাঠানো হয়েছে। অর্থাৎ এ সময়ের মধ্যে ঋণ পরিশোধ না করলেও তাদেরকে খেলাপি বলা যাবে না।

এখন কাগুজে কলমে ব্যাংকের উদ্বৃত্ত তারল্য এক লাখ কোটি টাকা দেখানো হচ্ছে; কিন্তু বাস্তব অবস্থায় কতটুকু আছে, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। দেশে বর্তমান রিজার্ভ তিন হাজার ৬০০ কোটি ডলারে উন্নীত হয়েছে, যা এযাবৎকালে রেকর্ড। বর্তমান রিজার্ভের টাকা দিয়ে আট মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। তাই রিজার্ভের টাকা উন্নয়ন প্রকল্পে খরচের আলোচনায় উঠে এলো জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায়। রিজার্ভের টাকা উন্নয়ন প্রকল্পে খরচের বিষয়টি তুলেছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, ‘এটা একটা যুগান্তকারী প্রস্তাব এসেছে প্রধামন্ত্রীর কাছ থেকে। আমরা এটাকে সমর্থন করি।’প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, এই অর্থ ব্যয় করলে অর্থনীতিতে কী ধরনের প্রভাব পড়বে এবং এ অর্থ ব্যয় করা যাবে কি না ইত্যাদি বিষয়ে গবেষণা করতে হবে। এ জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে চিন্তাভাবনা করতে হবে।

এক প্রশ্নের জবাবে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, ‘আমার ব্যক্তিগত মতামত হলো, রিজার্ভের টাকা উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয় করা যায়। তবে ঋণ নিতে হবে ডলারে এবং পরিশোধও করতে হবে ডলারেই। তা ছাড়া বিদেশ থেকে ঋণ নিলে সুদ কম থাকলেও আমাদের নানা শর্ত মানতে হয়। ফলে প্রকল্পের বাস্তবায়ন দেরি হওয়াসহ নানা জটিলতা থাকে।’ অন্য এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, ‘আমরা আমাদের নিজেদের টাকা নিজেরাই ব্যবহার করব, বাম হাতের টাকা ডান হাত ঋণ নেবে। এতে কোনো সমস্যা দেখছি না। তবে এ বিষয়ে নিয়ম-কানুন, নীতিমালা ও বিধি ঠিক করবে অর্থ বিভাগ।’

এমনি অবস্থায় করোনাভাইরাসের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের সহায়তা দিতে প্রায় ৭৩ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনার অর্থের বেশির ভাগ ব্যাংকের মাধ্যমে বিতরণের সিদ্ধান্ত বাস্তব সম্মত নয় বলে অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা করেন।

তাদের মতে, ব্যাংকগুলোর নিজস্ব উৎস থেকে ৭৩ হাজার কোটি টাকার অর্থ বিতরণ করা সম্ভব হবে না। বিকল্প উপায়ে অর্থের সংস্থান না করলে ব্যাংকগুলোর পক্ষে প্রণোদনার অর্থ ছাড় করা কঠিন হবে।

ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, গত কয়েক বছর ধরেই ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নিয়ে বেশির ভাগই পরিশোধ করছেন না বড় বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থাও নেয়া হয়নি। উপরন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে এসব ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের ছাড় দেয়ার জন্য বিভিন্ন সময় বিভিন্ন নামে নীতি সহায়তা দেয়া হয়েছে। এসব কারণে ব্যাংক সাধারণের আমানতের অর্থ দিয়ে উদ্যোক্তাদের যে ঋণ দিয়েছিল তা আদায় একেবারেই কমে গেছে। কিন্তু আমানতকারীদের নির্ধারিত মেয়াদ শেষে সুদসহ আসল পরিশোধ করতে হচ্ছে প্রতিনিয়তই।

এ দিকে দীর্ঘ দিন ধরে আমানতের সুদহার কমিয়ে আনছে ব্যাংকগুলো। আমানতের সুদহার কমানোর ফলে ব্যাংকিং খাতে আমানত প্রবাহ কমে গেছে। এক দিকে নগদ আদায় কমে যাওয়া ও এর পাশাপাশি আমানত প্রবাহ নিম্নমুখী হওয়ায় ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ সক্ষমতা কমে গেছে। আর যে এক লাখ কোটি টাকার ওপরে উদ্বৃত্ত তারল্য দেখানো হচ্ছে এর বেশির ভাগই সরকারের কোষাগারে ঋণ আকারে আটকে আছে।

এর বিপরীতে ব্যাংকগুলোর হাতে ট্রেজারি বিল ও বন্ড রয়েছে। সবমিলেই ব্যাংকগুলোর নগদ অর্থের টানাটানির মধ্যে রয়েছে। প্যাকেজ ঘোষণার এই অর্থের পুরোটাই জোগান দিতে হবে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে। এ ঋণে সুদের হার হবে ৯ শতাংশ। এর মধ্যে অর্ধেক, অর্থাৎ ৪ দশমিক ৫ শতাংশ পরিশোধ করবে ঋণগ্রহীতা শিল্প/ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। বাকি ৪ দশমিক ৫ শতাংশ সরকার ভর্তুকি হিসেবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে দেবে। এসএমই খাতে সরকার সুদ ভর্তুকি দেবে ৫ শতাংশ। এর বাইরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রফতানিকারীদের জন্য আরেকটি তহবিল এবং রফতানি উন্নয়ন তহবিলের (ইডিএফ) আকার বাড়ানো হয়েছে।

এর বাইরে ব্যাক টু ব্যাক এলসির আওতায় কাঁচামাল আমদানি সুবিধা বাড়াতে ইডিএফের বর্তমান আকার ৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার থেকে বাড়িয়ে ৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করা হবে। ফলে ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ অতিরিক্ত ১২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা ইডিএফ তহবিলে যুক্ত হবে। একই সাথে বাংলাদেশ ব্যাংক পাঁচ হাজার কোটি টাকার একটি নতুন তহবিল চালু করবে, যেখান থেকে ৭ শতাংশ সুদে ঋণ দেয়া হবে।


পিএনএস/জে এ

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন