নারী নির্যাতনের ‘আইএস স্টাইল’

  26-10-2016 02:37PM

পিএনএস ডেস্ক: আইএস ঘাঁটিতে নারী নির্যাতনের কাহিনি এর আগে কম-বেশি বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। নারী নির্যাতনকে জায়েজ করতে নিজস্ব বিধি-বিধানও রয়েছে তাদের ডেরায়। চার মাস আগে গ্রেপ্তার আইএসের মধ্যম সারির এক নেতাসহ আরও দুই এক জন ইয়াজিদি নারীর থায়ই নারী নির্যাতনের রোমহর্ষক কাহিনির খণ্ড চিত্র ফুটে উঠেছে। এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন পোস্ট একটি দীর্ঘ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে এক নির্যাতিত নারীর বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, ১৬ বছর বয়সী এক কিশোরীকে আইএস ঘাঁটিতে বিয়ের নামে অন্তত সাত জন পুরুষের শয্যাসঙ্গী হতে হয়েছে।

সম্প্রতি আইএস ঘাঁটি থেকে কুর্দিস্তানে ঢোকার সময় আইএসের মাঝারি গোছের এক নেতাকে আটক করা হয়। তিনি এখন কারাবন্দি। সম্প্রতি ওয়াশিংটন পোস্টের এক সাংবাদিক আইএস নেতার একটি সাক্ষাৎকার নেন। সাক্ষাৎকারের চুম্বক অংশ কারেন্টনিউজ পাঠকের সামনে তুলে ধরা হলো।

চার মাস আগে ৩৫ বছর বয়সী এই আইএস নেতা বন্দি হন। বন্দি অবস্থায় ছোট্ট একটি ঘরের মধ্যে খাটের ওপর বসে ছিলো। চারপাশের দেয়ালগুলো ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। অপ্রতিভ আলোয় আরও খারাপ দেখাচ্ছিল।

সাধারণ ইরাকির চেয়ে তার গায়ের রং পরিষ্কার, কোঁকড়া লালচে বাদামী চুল, চোখের রং হালকা বাদামী। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই লড়াকু যোদ্ধা আইএস এর গোয়েন্দা বিভাগের নেতা টাইপের ছিল। আইএসের আস্তানায় তথ্য সংগ্রহের জন্য আটক ব্যক্তিদের ওপর নির্যাতন চালাতো এই লোকটি।

ওয়াশিংটন পোস্টের সাংবাদিক বলছিলেন, ভেতরে ঢুকে আমি কিছুটা ভয়ে ভয়ে ছিলাম। যদি এই যোদ্ধা আবার তেড়ে আসেন, আমার ওপর চড়াও হন। অনেকটা কাছাকাছি গিয়ে তার কাছে তার স্ত্রী সম্পর্কে জানতে চাইলাম। তাকে বললাম ‘তোমার স্ত্রী সম্পর্কে কিছু বলো।’ ‘তুমি তার সাথে কেমন আচরণ করতে?’

চেপে রাখা রাগ দমন করে সে বললো, ‘আমার স্ত্রী তার মুখমণ্ডল ও চেহারা সর্বদা ঢেকে রাখতো।’

সে বলতে লাগলো, ‘আমার স্ত্রী’র আমাকে ছাড়া কোথাও যাওয়া নিষেদ্ধ ছিল।’

কিছু উদ্বাস্তুর সাথে কুর্দি এলাকায় প্রবেশের চেষ্টা করতে গেলে চার মাস আগে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। আলাপচারিতায় সে জানায়, চার মাসের উপর আমি এখানে বন্দি রয়েছি। যেহেতু আমার স্ত্রী আমার সঙ্গে নেই চার মাস হলো। সম্ভবত আমার স্ত্রীকে কারো সাথে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়েছে।

সাংবাদিকের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমার স্ত্রী অন্য সব মহিলাদের মতোই, শুধুই সে একজন মহিলা’ ‘মহিলাদের শুধু জীবিত থাকতে হবে বিবাহিত অবস্থায়, সন্তান নিয়ে। তাদের জন্য জিহাদ বলতে কিছু নেই। মহিলারা টিকে থাকে, বেচে থাকে না!’

ঐ মহিলা সাংবাদিককে সে আরও বলে, ‘তুমি খুবই সুন্দরী, আইএস যদি তোমাকে পেতো, তারা তোমাকে পেটাতো, এবং দাসী বানিয়ে ফেলতো।’

সাক্ষাৎকারের ওপর ভিত্তি করে ঐ সাংবাদিক বলছিলেন, আইএস আসলে অমানবীকরণের এমন একটা পদ্ধতি তৈরি করে ফেলেছে, যেখানে এটি তাদের সদস্যদেরকে ইসলাম এর নামে স্ত্রী-বিদ্বেষ চরিতার্থ করার সুযোগ করে দিচ্ছে, আক্রমণাত্মক যৌন প্রবণতা বা ক্ষমতা প্রদর্শনের সুযোগ করে দিচ্ছে।

ওয়াশিংটনের ঐ সাংবাদিক ও ক্যামেরাম্যান বলেন, পরে ২৩ বছর বয়সী এক ইয়াজিদি মহিলার সঙ্গে তাদের কথা হয়। মাত্র দুই মাস আগে আইএস ডেরা থেকে মুক্তি পেয়ে উদ্বাস্তু হিসাবে আশ্রয় শিবিরে দিন কাটে তাদের।

ঐ নারী ফিসফিস করে বললেন, ‘তার পরিবার সিঞ্জার থেকে এসেছে, তারা ঐ শহরেই থাকতো’। অর্থ-বিত্ত কোনো কিছুই কম ছিল না। আমাদের পরিবার কয়েকজন তরুণী সুন্দরির বাস ছিল। একদিন একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে আমরা সবাই আনন্দ-উল্লাস করছিলাম। বাড়ি-ভর্তি দুই সহস্রাধিক লোকের সমাগম ছিল। হঠা্ৎ আইএসের হানা এবং তারা মুহূর্তের মধ্যে সবকিছু ছিনিয়ে নেয়। ছিনিয়ে নেয় সুন্দরি কিশোরীদেরকেও।

ইয়াজিদিরা ইরাকে ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং আইএস তাদেরকে ঘৃণা করে। আইসের দৃষ্টিতে এরা অবিশ্বাসী এবং শয়তানের উপাসক। আর এই যুদ্ধে ইয়াজিদি মহিলাদের চরম মূল্য দিতে হয়েছে।

২০১৪ সালের আগস্টে কুর্দিস্তানের সিঞ্জার শহরে সেনাবাহিনী’র হামলার পর হাজার হাজার ইয়াজিদি মহিলাকে এক অর্থে বিক্রি করে দেওয়া হয় ‘অস্থায়ী বিয়ে’র নাম দিয়ে একাধিক লোকের কাছে।

আইএস এর দখলকৃত এলাকায় সুন্নি মহিলাদের জোর করে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়, আর ইয়াজিদিদের সঙ্গে আইএস অনেকটা পশুর মতো আচরণ করেন। যদিও ইসলামিক স্টেট এর আলেমরা ইয়াজিদি মহিলাদের সাথে এই ‘স্বল্প-মেয়াদের বিয়ে’কে পবিত্র বলে ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু এই একপাক্ষিক আয়োজন ভণ্ডামি ছাড়া কিছুই নয় যেখানে ধর্ষণ আর যৌন-দাসত্বই হল প্রধান প্রতিপাদ্য।

কিছু কিছু ইয়াজিদি মহিলা এও বলেন যে, তাদেরকে মাত্র ১০ ডলার বা এক কার্টুন সিগারেটের বিনিময়ে কিনে আনা হয়েছে। অন্যরা গণধর্ষণ এবং যৌন হিংস্রতা’র কথা মনে করিয়ে দেয় যার পরিমাণ এতোই বেশি এবং এতোই জঘন্যতম-নারকীয় যা পাঠকদের জন্য তুলে ধরা সম্ভব নয়।

ওয়াশিংটনের এই সাংবাদিক এর নাম দিয়েছে ফরিদা। ফরিদা আলাপকালে তার বোনোর ওপর আইএসের নির্মমতার নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে সাংবাদিককে বলেন,

আমার বোনের বয়স ছিল মাত্র ১৬ বছর। ওরা তাকে সাত জন পুরুষের সাথে বিয়ে দিয়েছিল!, সে এখনও সিরিয়ায় আছে আইএস ডেরায়।

আমি একজন পুরুষকে টানা চারজন মহিলাকেও ধর্ষণ করতে দেখেছি। মায়ের বুক থেকে দুধের বাচ্চাকেও টেনেহিঁচড়ে ছিনিয়ে নিয়ে যেতে দেখেছি আমি। এক নারীকে একাধিক পুরুষ বিয়ে করতো। নিজের অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করে তিনি বলেন, কোন লোক যখন আমাকে বিয়ে করতো তখন তার কোন বন্ধু যদি আমাকে দেখে ফেলতো এবং পছন্দ করে ফেলতো তো সেও আমাকে বিয়ে করতো। আমাকে এভাবে মোট পাঁচজনের সাথে বিয়ে দেওয়া হয়েছে!

আইএস ফরিদার পাঁচজন ভাইকে হত্যা করেছে, ভাইদের হত্যা স্মৃতি ফরিদাকে এখনও তাড়িয়ে বেড়ায়। ফরিদা বলেন, ‘আমার স্বামী এখনও বেঁচে আছে কিন্তু এখন থেকে ১০০ বছর পার হয়ে গেলেও আমার ভাইদের এবং পরিবারকে হারানোর মর্মযন্ত্রণা থামাতে পারবো না। ফরিদা আরও বলেন, ‘আমি সবসময় বিষণ্ণ থাকি এবং কাঁদি, আমার জীবন এখন ক্লান্তিময়, আমি আর কখনই আমার স্বামীকে খুশি রাখতে পারবো না’

যদি সে কোন আইএস সদস্যের সাথে কথা বলার সুযোগ পেতো তাদের কি জিজ্ঞাসা করতো? এমন প্রশ্ন করা হলে ফরিদা বলে, ‘আমার তাদেরকে সত্যিই কিছু বলার নাই, ‘আপনি যদি তাদেরকে আমার সামনেও এনে দেন এবং নির্যাতন করতে থাকেন, সালাদের মতো কুচি কুচি করেও তাদের কেটে ফেলেন, আমি কিছুই বলবো না, কারণ আমার হৃদয় ভেঙ্গে গেছে, এবং আমার জীবন কখনোই সেখানে ফিরে যাবে না যেভাবে সেটা ছিল, আমি যাই বলি না কেন’

২৫ বছর বয়সী অপর এক মহিলার নাম লায়লা। সে এখন দুহক সীমান্তে একটা উদ্ভাস্তু শিবিরে বাস করে। ফরিদার চোখেমুখে রাগ থাকলেও লায়লা পুরোপুরি অনুভূতিহীন।

লাইলা ঐ সাংবাদিককে বলে, ‘তারা বলছিল আমরা যেভাবে ধর্ম পালন করি এভাবে আর করা যাবে না এর পরিসমাপ্তি টানতে হবে। ‘কিন্তু তখনও আমাদের হৃদয় একইরকম ছিল এবং বারবার বলছিল আমরা ইয়াজিদি, তারা আমাদের উপর ধর্ষণ-নির্যাতন যা কিছু চালাতে পারে কিন্তু আমাদের মন পরিবর্তন করতে পারবে না’

অশ্রু ভারাক্রান্ত চোখে ফরিদার কথার মাধ্যমে সাক্ষাৎকারটি শেষ হয়, ‘আমি না মাঝে মাঝেই উত্তেজিত হয়ে যায়, আমার মনে হয় সব কাপড়-চোপড় ছিঁড়ে ফেলি এবং চিল্লাইতে চিল্লাইতে রাস্তা দিয়ে দৌড়াতে থাকি, আমি শপথ করে বলছি, আমি চাইতাম, তারা যখনই আসলো তখনই আমাদের সবাইকে মেরে ফেলতো। আমরা সবাই যদি একসাথে মারা যেতাম, তাহলে আমরা হয়তো এই কুৎসিত মিথ্যার পৃথিবীটাকে পেছনে ফেলতে পারতাম, আর অনেক অনেক শান্তিতে থাকতাম। আমরা বেচে আছি কিন্তু আর কখনোই নিজেদের ফিরে পাবো না’



পিএনএস/আলআমীন

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন