রোহিঙ্গাদের নিয়ে বিশাল অংকের অর্থ বাণিজ্য

  04-12-2016 12:43PM


পিএনএস ডেস্ক: জাতিসংঘের মতে, বিশ্বের অন্যতম নিপীড়িত এক জনগোষ্ঠী মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যের মুসলিম রোহিঙ্গা। দেশটির সেনাবাহিনীর হাতে নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন তারা। দিনের পর দিন খেয়ে-না খেয়ে খোলা আকাশের নিচে থাকতে হচ্ছে তাদের। হন্যে হয়ে এদিক-সেদিক ঘুরছেন একটু আশ্রয়ের আশায়। ঢুকে পড়ছেন পার্শ্ববর্তী দেশ বাংলাদেশেও।

নির্যাতিত এই জাতিগোষ্ঠীর খবর জানাতে মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী এলাকা দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল আছেন একটি গণমাধ্যমের প্রতিবেদক শাহেদ শফিক। তার ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ থাকছে অষ্টম পর্ব।

মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও স্থানীয় মগ দস্যুদের হাতে নির্যাতনের শিকারে হয়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে অবৈধভাবে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের নিয়ে চলছে অমানবিক কাণ্ড। ক্ষুধার পীড়ায় অতিষ্ট এসব নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের কাজের জন্য বিক্রি করে হাজার হাজার টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে একটি চক্র। শ্রমের অর্ধেক টাকাও দেয়া হচ্ছে না তাদের। দুর্বলতার সুযোগে এমন কাণ্ড ঘটিয়ে চলেছে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রভাবশালীরা।

পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও রাখাইনদের নির্যাতনে টিকতে না পেরে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে সেদেশের সীমান্তবর্তী এলাকায় অবস্থান করছে হাজার হাজার রোহিঙ্গা। বাস্তুহারা এসব রোহিঙ্গা সীমান্ত পাড়ি দেয়ার উপায় খুঁজছে। এ সুযোগেই একটি দালাল চক্র তাদের পার করে দেয়ার কথা বলে হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অংকের টাকা। বিজিবির চোখ ফাঁকি দিয়ে সীমান্ত পাড়ি দেয়ার পর রোহিঙ্গাদের নিয়ে যাওয়া হয় তাদের নিয়ন্ত্রিত ক্যাম্প কিংবা পাহাড়ের গহীন জঙ্গলে তৈরি করা নতুন নতুন খুপরি ঘরে। সেখান থেকে দেশের বিভিন্ন স্থান কিংবা পার্শ্ববর্তী জেলা ও উপজেলায় শ্রমিক হিসেবে বিক্রি করে দেয়া হচ্ছে।

এদিকে রোহিঙ্গাদের জন্য টেকনাফ, উখিয়া, মহেশখালী ও কক্সবাজারের বিভিন্ন স্থানে পাহাড়ের গুহা ও অনিবন্ধিত ক্যাম্পগুলোতে নতুন নতুন খুপরি ঘর তৈরি করা হয়েছে। কোথাও আশ্রয় না পেয়ে লম্বা কলোনি, পলিথিন, বাঁশ ও কাঠ দিয়ে তৈরি এসব ঘরে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের উঠতে বাধ্য করা হচ্ছে। চক্রটি প্রথমে কম মূল্যে রোহিঙ্গাদের কাছে ঘরগুলো ভাড়া দিয়ে থাকলেও পরে বিভিন্ন কাজে জড়িয়ে হাতিয়ে নিচ্ছে হাজার হাজার টাকা।

গত শুক্রবার ভোরে উখিয়ার বালুখালী সীমান্ত দিয়ে ট্রলারযোগে ৪৭ রোহিঙ্গাকে পালিয়ে আনেন স্থানীয় দালাল আলী হোসেন। তিনি ক্যাম্পের স্বঘোষিত চেয়ারম্যান আবু বকর সিদ্দিকের লোক বলে জানা গেছে। কুতুপালং ক্যাম্পের পাশের একটি পাহাড়ের গহীন জঙ্গলে নতুন করে তৈরি করা কয়েকটি ঘরে উঠানো হয়েছে এসব ভাগ্য বিড়ম্বিতদের। নিজ দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে জীবন বাঁচাতে পালিয়ে আসা এসব রোহিঙ্গা ঘর পেয়ে যেন স্বস্তি বোধ করেন। দীর্ঘ ২৫ দিনের মতো গ্রাম থেকে গ্রামের খোলা আকাশের নিচে রাত কাটানোর পর এই খুপরি ঘরগুলোকে ‘নেয়ামত’ মনে করছেন তারা। টেকনাফ, উখিয়া ও কক্সবাজারসহ সীমান্তবর্তী এলাকার সড়কগুলোতে বিজিবির চেকপোস্ট থাকায় তারা প্রকাশ্যে চলাফেরাও করতে পারছেন না। ক্যাম্প কিংবা পাহাড়ি এলাকায় কোনো কর্মসংস্থান না থাকায় দেশের বিভিন্ন স্থানে কাজের জন্য বিক্রি করে দেয়া হচ্ছে তাদের।

ধন-সম্পদ সব হারিয়ে খাবারের জন্য হাহাকার করছে মিয়ানমারের এসব উদ্বাস্তু পরিবার। দিনের পর দিন উপবাস থাকার পর দু’মুঠো ভাতের আসায় ঘুরছেন অন্য রোহিঙ্গাদের ঘরে। কিন্তু লাভ হচ্ছে না। সবারই অবস্থা তো একই। খাবারের জন্য কোথায় যাবে? কী করবে? কার কাছে যাবে?

অভিযোগ উঠেছে রোহিঙ্গাদের আশ্রয়দাতারাই দৈনিক কাজের ভিত্তিতে বিভিন্ন স্থানের কলকারখানা, মাছের ঘের ও কৃষি খামারসহ বিভিন্ন জায়গায় কাজে লাগাচ্ছেন। কাজের জন্য একজন রোহিঙ্গাকে দৈনিক ৪০০ থেকে ৭০০ টাকায় চুক্তি করা হয়। কিন্তু এ থেকে তাদের দেয়া হয় ১৫০-৩০০ টাকা। সরদার হিসেবে বাকি টাকা নিয়ে নেন আশ্রয়দাতারা। শুধু বর্তমানে এমনটি হচ্ছে তা নয়, অতীতেও এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

এ ছাড়া নতুন তৈরি করা ঘরে আশ্রয় দেয়া রোহিঙ্গাদের দিয়ে মাদক, ইয়াবা ও পতিতাবৃত্তিসহ নানা অসামাজিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করার অভিযোগ রয়েছে স্থানীয় প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে। রোহিঙ্গাদের দুরবস্থাকে কাজে লাগিয়ে এই চক্রটি রাতারাতি বনে যাচ্ছে কোটিপতি।

উখিয়ার কুতুপালংয়ের অনিবন্ধিত ক্যাম্পের সেতারা বেগমের ঘরে উঠেছেন ১৬ জন রোহিঙ্গা। তিনি মিয়ানমার থেকে নির্যাতনের শিকার হয়ে পাঁচ বছর আগে পালিয়ে এসে ওই ক্যাম্পের নেতা আলী হোসেনের আশ্রয়ে বর্তমান ঘরটিতে ওঠেন। ওই নেতা সরদার হিসেবে সেতারা বেগমের পরিবারের সদসদের বিভিন্ন এলাকায় দৈনিক কাজের জন্য বিক্রি করেন। ৩৫০ থেকে ৭০০ টাকা পর্যন্ত তাদের বিক্রি করা হলেও তার স্বামীকে দেয়া হয় ২৫০ টাকা। এ থেকে ৫০ টাকা দিতে হয় বাসা ভাড়ায়। বাকি ২০০ টাকায় চলে তার ছয় সদস্যের পরিবার। বাকি টাকা সরদার হিসেবে রেখে দেয়।

সেতারা বেগম জানান, ২০০ টাকা দিয়ে যেখানে তার ছয় সদস্যের পরিবার চালানো কষ্টকর সেখানে অতিরিক্ত ১৬ জনকে কীভাবে চালাবেন। তারা নতুন হওয়ায় সরাসরি কাজ পাচ্ছে না। স্থানীয় ভাষাও বোঝেন না অনেকেই। তাছাড়া রাস্তাঘাটে বিজিবির টহল থাকায় ঠিকমতো ঘর থেকে বেরও হতে পারেন না। ফলে ভয়াবহ খাবার সংকটে রয়েছেন তারা। শনিবার থেকে আলী হোসেনের সঙ্গে অর্থ উপার্যনে তারাও যোগ দিচ্ছেন।

গত কয়েকদিন মিয়ানমার সীমান্তবর্তী এলাকাগুলো ঘুরে দেখা গেছে, বিপর্যস্ত রোহিঙ্গাদের নিয়ে গড়ে উঠেছে একাদিক দালাল চক্র। চক্রটি হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি অংকের টাকা। মিয়ানমারে গিয়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরাও পড়েছেন কেউ কেউ। এদের কয়েকজন টেকনাফের বড়ইতলী গ্রামের মৃত জহির আহমদের ছেলে আনোয়ার সাদেক (২০), বড়ইতলীর লামাপাড়ার আমানুল্লাহর ছেলে সলিম উল্লাহ (১৮) ও নাইট্যংপাড়ার মৃত মোহাম্মদ শফির ছেলে আহমদ উল্লাহ (২২)। গত বুধবার রাতে তারা মিয়ানমার বর্ডার গার্ডের হাতে আটক হয়।

অনুপ্রবেশকারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত কয়েকদিন ধরে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ, চিপ্রাং, জালিয়াপাড়া, উন ওয়াব্রাং, জাদিমুরা, নয়াপাড়া, উলুবনিয়া, সাবরাং, হ্নীলা, নাজরিপাড়া, হোয়াইক্ষ্যং, লেদা এবং উখিয়া উপজেলার কুতুপালং, ঘুমধুম, তুমব্রু, বালুখালী, বেতবুনিয়া, ঝিমনখালী, খারাংখালী, বালুখালী কাস্টমস অফিস এবং বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি এলাকার তমরু পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঘটছে।

অভিযোগ উঠেছে তুমব্রুর ইউপি সদস্য আবদুল গফুর সীমান্ত পার হওয়া রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে ৫০০ টাকা হারে আদায় করছেন। তার নিয়ন্ত্রিত একটি চক্র টাকাটি আদায় করে নিচ্ছেন। স্থানীয় গণমাধ্যমগুলোও এই চক্রটির বিরুদ্ধে একাধিক খবর প্রকাশ করেছে। এ ছাড়া আরো শক্তিশালী একটি চক্র এই রোহিঙ্গাদের দিয়ে বাণিজ্য করছেন।

তবে এসব অভিযোগের বিষয়ে অভিযুক্তদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা হলেও তাদের কাউকে পাওয়া যায়নি।

পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন