দৃষ্টি হারাচ্ছে কাশ্মীর, তরুণদের করুণ কাহিনী তুলে ধরেছে অ্যামনেস্টি

  15-09-2017 03:39PM


পিএনএস ডেস্ক: ‘রাতে ঘুমের মধ্যে দু:স্বপ্ন দেখি, আমার দিকে প্যালেট গুলি ছোড়া হচ্ছে। শান্তিতে এখন আর আমি ঘুমাতে পারি না। টিভিতে কার্টুন দেখা, রাস্তায় নেমে বন্ধুদের সঙ্গে খেলা করা, কিংবা বই পড়া এখন আমার কাছে স্বপ্নের বিষয়।

আমার মুখে প্যালেট গানের ৯২টি গুলি লেগেছে। কে বলে প্যালেট প্রাণঘাতি নয়? প্যালেট আমাদের স্বপ্ন ও আশাগুলো হত্যা করেছে। আমাদের মন ভেঙ্গে দিয়েছে। আমাদের জীবন পরিণত করেছে নরকে।

শত শত প্যালেট গুলি যখন আমার দিকে ছুটে আসে তখন আমি বাড়িতে বসেছিলাম। গুলিগুলো আমার মুখে লাগে। আমার মুখের মধ্যে অনেকগুলো গুলি ঢুকে যায়। যে লোকটি আমার দিকে প্যালেট গুলি ছুড়েছিলো আমি তার বিচার চাই। কিন্তু জানি রাষ্ট্র এসবে থোরাই কেয়ার করে। এই রাষ্ট্র ব্যবস্থার ওপর আমার কোনো আস্থা নেই।’

সম্প্রতি অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল (এআই)’র রিপোর্টে ভারত অধিকৃত কাশ্মীরের প্যালেট গুলিবিদ্ধ যে ৮৮ জন তরুণের সাক্ষাতকার নেয়া হয় ওপরের হৃদয় বিদারক বর্ণনা তাদেরই কয়েকজনের কাছ থেকে পাওয়া। ভারতীয় বাহিনীর নির্বিচার প্যালেট গান ব্যবহার কিভাবে কাশ্মীরিদের জীবন নিষ্পেষিত করে দিচ্ছে তার করুণ কাহিনীগুলো সামনে নিয়ে এসেছে অ্যামনেস্টি।

গত ১৩ সেপ্টেম্বর জম্মু-কাশ্মীরের শ্রীনগরে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনটি এক সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে এই রিপোর্ট প্রকাশ করে। অনুষ্ঠানে প্যালেট গুলির শিকার অনেক তরুণ তাদের রোজকার বেদনা ও দুর্ভোগ সাংবাদিকদের কাছে তুলে ধরে।

দৃষ্টি হারাচ্ছে কাশ্মীর

রিপোর্টের প্রচ্ছদে দেয়া ছবিটি ইনশা মোসতাক নামে ১৫ বছর বয়সী নবম শ্রেণীর এক বালকের। দক্ষিণ কাশ্মীরের শোপিয়ান জেলায় তার বাড়ি। ২০১৬ সালে কাশ্মীরি গণঅভ্যুত্থানের কেন্দ্র ছিলো এই শোপিয়ান।

গুলিতে দু’চোখ হারিয়েছে ইনশা। রাস্তার দিকে মুখ করা রান্না ঘরের জানালায় সে তখন দাঁড়িয়েছিলো। নিরাপত্তা বাহিনী লক্ষ্যহীনভাবে হাজার হাজার প্যালেট গুলি ছুড়ছিলো তখন।

গত ১৪ মাসে ছয় দফা সার্জারির পরও বালক ইনশার দৃষ্টি শক্তি ফেরানো যায়নি।

অ্যামনেস্টি ইন্ডিয়া’র সিনিয়র ক্যাম্পেইনার জহুর ওয়ানি জানান, স্থানীয় কিছু এনজিও’র সহায়তায় তারা রিপোর্টটি তৈরি করেছেন। তারা দেখেছেন যে আসিফ আহমদ শেখের মতো নয় বছরের শিশু থেকে হাসিনা বেগমের মতো ৬৫ বছর বয়সি বৃদ্ধাও প্যালেট গানের গুলিতে অন্ধ হয়ে গেছেন।

অ্যামনেস্টির রিপোর্টে লেখার চেয়ে ছবির সংখ্যা বেশি। প্যালেট বন্দুকের বিপজ্জনক, ত্রুটিপূর্ণ ও নির্বিচার ব্যবহার কিভাবে সংঘাত-কবলিত উপত্যকাবাসীর জীবন বিপর্যস্ত করছে বিশ্ববাসীকে তা জানতে এই উদ্যোগ।

রিপোর্টে আরো ৮৮ জনের ছবিসহ বিবরণ তুলে ধরা হয়। এদের মধ্যে ৩১ জনের দু’চোখেই গুলি লেগেছে। দু’জন দৃষ্টিশক্তি পুরোপুরি হারিয়েছে।

ওয়ানি জানান, আহত ১৪ জন মহিলা ছিলেন নিজের ঘরে, তারা রাস্তায় গিয়ে কোনো বিক্ষোভে অংশ নেননি।

একজন মহিলা বলেন তিনি তখন ঘরে বসে বিকেলের নাস্তা তৈরি করছিলেন। বাইরে নিরাপত্তা বাহিনীর ছোড়া গুলি এসে তার চোখে লাগে।

রিপোর্ট তৈরির জন্য এআই কাশ্মীরের স্বাস্থ্য বিভাগ থেকেও উপাত্ত সংগ্রহ করে। তাতে দেখা যায় জম্মু-কাশ্মীর পুলিশের ১৬ সদস্যও প্যালেট গুলিতে আহত হয়। চোখসহ তাদের শরীরের বিভিন্ন অংশে এই গুলি লাগে।

গত বছর হিজবুল মুজাহিদিন কমান্ডার বুরহান মুজাফ্ফর ওয়ানি ভারতীয় বাহিনীর হাতে নিহত হওয়ার পর ১৬ থেকে ২১ জুলাই পর্যন্ত কাশ্মীরজুড়ে প্রবল গণবিক্ষোভ চলে।

ওয়ানি বলেন, প্যালেট বন্দুক ব্যবহারে ভারতীয় বাহিনী কতটা অদক্ষ পুলিশ সদস্য আহত হওয়া তার প্রমাণ। তারা জানে না কিভাবে নিরাপদে এগুলো ব্যবহার করতে হয়। আমরা শুধু জানি এগুলো ভিকটিমের জন্য কতটা মর্মান্তিক।

প্যালেট গান ব্যবহার নিষিদ্ধ করে, কাশ্মীরে নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি জানায় অ্যামনেস্টি।

এআই ইন্ডিয়ার নির্বাহী পরিচালক আকতার পাতিল বলেন, বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে সরকার বৈধ শক্তি যেমন জলকামান বা লাঠিচার্র্জ বা টিয়ারগ্যাস ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু, এই প্যালেট গান পুরোপুরি নিষিদ্ধ করতে হবে। এসব অস্ত্র শুধু কাশ্মীরিদের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য মজুত করে রাখা হয়েছে। এগুলো ব্যবহার বন্ধ করতে হবে।

স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেছিলেন গুলি ও গালি দিয়ে কাশ্মীর সমস্যার সমাধান হবে না, এ জন্য কাশ্মীরিদের বুকে আগলে নিতে হবে। এই বক্তব্যের প্রতিও দৃষ্টি আকর্ষণ করেন পাতিল। তার মতে সরকার আসলেই যদি এ কথা বুঝাতে চায় তাহলে তাকে প্যালেট ফায়ারিং বন্ধ করতে হবে।

পাখি শিকারের কাজে ব্যবহৃত প্যালেট গান প্রথম ২০১০ সালের গ্রীষ্মে কাশ্মীরে বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার শুরু করে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী। ওই সময় নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে ১২০ জনের বেশি বেসামরিক কাশ্মীরি নিহত হয়।

অ্যামনেস্টি ইন্ডিয়ার সিনিয়র নীতি উপদেষ্টা শৈলেশ রায় বলে, জননিরাপত্তা বজায় রাখার দায়িত্ব আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর। কিন্তু প্যালেট গান ব্যবহার কোনো সমাধান নয়। পাথর ছোঁড়ার জবাবে বন্দুকের গুলি ছোঁড়া যেতে পারে না। প্যালেট গানের ফলে যে ক্ষতি হচ্ছে তা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে কর্তৃপক্ষকে।

তিনি বলেন, প্যালেট গান ব্যবহার শক্তিপ্রয়োগের আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানের লঙ্ঘন। এসব বন্দুকের গুলিতে ছোট ছোট ৫০০ ধাতব প্যালেট বা বটিকা থাকে। এই বন্দুকের গুলি ছোড়া হলে তা কোন দিকে ছুটবে তা নিয়ন্ত্রণের কোনো সুযোগ নেই। ফলে এর ক্ষয়ক্ষতি হয় নির্বিচার।

দৃষ্টি হারাণোর যন্ত্রণা, বিষন্নতা

অ্যামনেস্টির অনুষ্ঠানে প্যালেট গুলির শিকার হওয়াদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন শাবরোজা মির, ইফরা শাকুর, নাজির আহমেদ দার ও দানিশ রাজিব ভাট।

দুর্ভাগ্যের বর্ণনা দিতে গিয়ে ১৮ বছর বয়সী মির বলেন, আমাদের বাড়ি প্রধান সড়কের পাশে। তখন গ্রামে কোনো বিক্ষোভ চলছি না। হঠাৎ গাড়িতে করে একদল পুলিশ ও সিআরপিএফ সদস্য এসে আমাদের বাড়ির জানালা ভাংচুড় শুরু করে। এরপর প্যালেট গানের গুলি ছোড়ে।

মিরের বা চোখে পাঁচটি প্যালেট ঢুকে যায়। এতে সে স্থায়ীভাবে চোখটি হারায়।
‘চোখ হারিয়ে আমি স্কুল ছাড়তে বাধ্য হই। এখন আমি পাঁচ মিনিটও বই পড়তে পারি না। আমি কাঁদতে চাই। কিন্তু তাও পারি না। কারণ জানি এতে আমার চোখের আরো ক্ষতি হবে’-এমন হৃদয়বিদার বর্ণনা দেন মির। চোখ হারিয়ে গত বছর তার আর দশম শ্রেণীর পরীক্ষা দেয়া হয়নি।

ঘরের মধ্যে থেকেও প্যালেট গানের শিকার ব্যক্তিরা যে শুধু শারীরিক ক্ষতির শিকার হয়েছেন তা নয়, এর ফলে তাদের মধ্যে হতাশা, উদ্বেগ তৈরি হচ্ছে, ক্রমাগত ট্রমার কারছে স্মৃতিশক্তি নষ্ট হচ্ছে।

শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে মির বলেন, ‘আমি জানি না কেন। কিন্তু এখন তুচ্ছ অনেক কিছু নিয়ে আমি আমার ভাই ও পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ঝগড়া করি। আমি আমরা স্মৃতিশক্তি হারাচ্ছি বলে বলে মনে হচ্ছে। অনেক কিছুই এখন ভুলে যাই।’

প্যালেট বন্দুক কিভাবে গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা তৈরি করেছে তাও অ্যামনেস্টির রিপোর্টে তুলে ধরা হয়েছে।

শ্রীনগরের শ্রী মহারাজা হরি সিং হাসপাতালের রিপোর্টে দেখা যায়, ২০১৬ সালের জুলাই থেকে দুই চোখে প্যালেটগানের গুলি লেগেছে এমন ১২০৯ জনের চিকিৎসা দেয়া হয়েছে ওই হাসপাতালে।

পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন