ঋণ পেতে স্ত্রীকেও ‘হানি ট্র্যাপ’ হিসেবে ব্যবহার!

  18-02-2018 09:59AM



পিএনএস ডেস্ক: ভারতের প্রখ্যাত হীরে ব্যবসায়ী নীরব মোদির জালিয়াতির তদন্ত করতে গিয়ে চক্ষু চড়কগাছ দুঁদে গোয়েন্দাদেরও। তারা জানতে পেরেছেন, ঋণ নেয়া, লেটারস অব আন্ডারটেকিং (এলওইউ) পাওয়া এবং নবীকরণের সময় ‘হানি ট্র্যাপ’ ব্যবহার করেছেন নীরব। এমনকী সেই কাজে ব্যবহার করেছেন তার স্ত্রী অ্যামিকেও। পাঁচ-ছ’বছর ধরে বিভিন্ন ব্যাংক কর্মকর্তাকে এভাবেই কুপোকাত করতে সমর্থ হয়েছেন নীরব। মার্কিন নাগরিক অ্যামি নীরবের মতোই জানুয়ারিতেই দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন।

গোয়েন্দারা মনে করছেন, জালিয়াতির এই ঘটনায় নীরবের মতোই তার মামা মেহুল চোকসির মাথাও সমানভাবে কাজ করেছে। শনিবার গীতাঞ্জলি গ্রুপের প্রোমোটার মেহুলের বিরুদ্ধে নতুন করে এফআইআর দায়ের করেছে সিবিআই। পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে১১ হাজার ৪০০ কোটি রুপি পেতে এলওইউ-এর জন্য ভুয়ো নথি পেশের জন্যই এই এফআইআর। সিবিআই-এর অভিযোগ, শুধুমাত্র ২০১৭-১৮ অর্থবর্ষেই চোকসির তিন সংস্থা- গীতাঞ্জলি জেমস, নক্ষত্র ও গিলির সঙ্গে ১৪৩টি এলওইউ স্বাক্ষর করেছে পিএনবি। যার মোট অর্থমূল্য চার হাজার ৮৮৬ কোটি টাকা। চোকসির বিরুদ্ধে আগেই ২৮০ কোটি রুপির জালিয়াতির একটি অভিযোগ দায়ের করেছিল সিবিআই। তার সঙ্গে চোকসি এবং নীরব মোদির সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে এলওইউ বাবদ ছ’হাজার ৪৯৮ কোটি রুপ জালিয়াতি জুড়ে তদন্ত শুরু করেছে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা। এফআইআর দায়েরের পরে শনিবার দেশের ছ’টি শহরে গীতাঞ্জলি গ্রুপের ২৬ শাখায় তল্লাশি চালায় সিবিআই। তাছাড়া, পিএনবি-তে নানা সময়ে নরিম্যান পয়েন্ট শাখা, ব্রাডি হাউস শাখায় কর্মরত কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছে সিবিআই। জালিয়াতির তদন্তে ডিআইজি-র নেতৃত্বে বিশেষ দল গঠন করেছে তারা।

গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন, নীরব মোদি এবং তার মামা মেহুল চোকসির সংস্থার নিয়মিত ক্রেতা ছিলেন বলিউড অভিনেতা, রাজনৈতিক নেতা থেকে একাধিক প্রভাবশালীরা। নোট বাতিল পরবর্তী সময়ে এই হুজ হুরা নগদে প্রচুর জিনিসপত্র কিনেছেন মোদি এবং চোকসির দোকান থেকে। প্রকৃত মূল্য গোপন করতেই নগদে এই কেনাকাটা বলে আয়কর কর্তাদের সন্দেহ।

জালিয়াতি ২২ হাজার কোটি রুপি!
‘১১,৪০০ কোটি রুপ নয়, নীরব মোদি সব মিলিয়ে ২২ হাজার কোটি রুপির জালিয়াতি করেছেন সরকারি ব্যাংক থেকে। এই বিপুল অঙ্কের টাকা একজন ব্যক্তি লুট করলেন, আর সেটা প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী জানেন না? প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, তিনি নাকি রাজকোষের চৌকিদার! রাজকোষ তো তার আমলেই সবথেকে বেশি ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। চৌকিদার মুখ খুলুন।’ এই প্রশ্ন তুলে শনিবার কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী তোপ দেগেছেন। কংগ্রেস শুধু নীরব মোদি নয়, ব্যাংক কেলেঙ্কারিতে নরেন্দ্র মোদিকে জড়াতেও মরিয়া আক্রমণে নেমেছে। কংগ্রেস সভাপতি বলেছেন, ২০১৫ সালে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে অভিযোগ জমা পড়েছিল। সেই অভিযোগের পরও ব্যবস্থা নেয়া হলো না কেন? নানা জটিলতা তৈরি করে এবং সুদের হার কমিয়ে সাধারণ মানুষকে যখন ব্যাংক নাজেহাল করে দিচ্ছে, তখন জালিয়াত ব্যবসায়ীদের ব্যাংক লুট করে পালানোর সুযোগ কেন করে দিচ্ছে মোদি সরকার? বস্তুত বিরোধীদের হাতে নতুন অস্ত্র তুলে দিয়েছে খোদ সিবিআইয়ের করা এফআইআর। যেখানে দেখা যাচ্ছে, নীরবের উত্থান কংগ্রেস আমলে হলেও রমরমা হয়েছে মোদি জমানাতেই।

বৃহস্পতিবার তদন্তকারী সংস্থাগুরণ্র পক্ষ থেকে যে এফআইআর হয়েছে সেখানে স্পষ্ট বলা আছে, নীরব মোদিকে সিংহভাগ জাল লেটার অব আন্ডারটেকিং হয় দেয়া হয়েছে অথবা রিনিউ করা হয়েছে ২০১৭-১৮ সালে। ১৪৮টি’র বেশি জাল লেটার অব আন্ডারটেকিং এবং ২৩০-এর বেশি লেটার অব ক্রেডিট দেখিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যাংক থেকে তুলে নিয়ে বিদেশের ব্যাংকে জমা করেছেন নীরব মোদি। শুধু যে নতুন করে লেটার অব আন্ডারটেকিং দেয়া হয়েছে তাই নয়। নীরব মোদি ও মেহুল চোকসির ১৭টি সংস্থা পুরনো যে লেটার অব আন্ডারটেকিং দেখিয়ে লোন নিয়েছিল, সেগুলির এক পয়সাও ফেরত না দেয়া সত্ত্বেও সেই একই লেটার অব আন্ডারটেকিংয়ের রিনিউয়াল করে দেয়া হয়েছে। তদন্তে উঠে এসেছে ১১,৩০০ কোটি রুপি জালিয়াতি করে সরিয়ে নেয়ার পরও নীরব মোদি এবং মেহুল চোকসি জানুয়ারি মাসেই আবার লোনের জন্য আবেদন করেছিলেন। তাহলে কি তাদের আশ্বস্ত করা হয়েছিল যে একই লেটার অব আন্ডারটেকিং দেখিয়ে দেখিয়ে বারংবার লোন পাওয়া যাবে? কারণ দেখা গেছে বিগত কয়েক বছরে তাদের যে লোন দেয়া হয়েছে, তার কোনো এন্ট্রিই নেই ব্যাংকের কম্পিউটার ব্যবস্থায়।

এদিকে শনিবারও কলকাতাসহ ভারতের বিভিন্ন শহরে নীরব মোদি ও তার আত্মীয়দের অফিসে ইডি হানা দেয়।

গত জানুয়ারির শুরুতেই নীরব মোদি দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। ৬ জানুয়ারি তার স্ত্রী ও বাকি পরিবারও পালিয়েছে। আর ৩১ জানুয়ারি সিবিআই প্রথম এফআইআর করেছে। সেই এফআইআরের ভিত্তিতে শনিবার প্রথম গ্রেফতার হয়েছে স্বাধীন ভারতের এই বৃহত্তম ব্যাংক কেলেঙ্কারির ঘটনায়। পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্কের অবসর প্রাপ্ত এক ডেপুটি ম্যানেজার, যিনি সমস্ত লেটার অব আন্ডারটেকিং-এ স্বাক্ষর করেছিলেন, সেই কর্মকর্তা এবং মেহুল চোকসির সংস্থার এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে এত বড় মাপের কেলেঙ্কারি কখনও মুম্বইয়ের কয়েকটি ব্রাঞ্চের এক-দুজন কর্মী ও ম্যানেজারকে সঙ্গে নিয়ে সম্পন্ন করা কি সম্ভব? আরো রাঘববোয়ালরা যে এর পিছনে আছে তা নিয়ে সন্দেহ নেই তদন্তকারীদের। থেমে নেই বিজেপিও। আজ প্রতিরক্ষামন্ত্রী নির্মলা সীতারামন সাংবাদিক সম্মেলন করেন। তিনি বলেন, অভিষেক মনু সিংভির পরিবারই তো মেহুল চোকসির একটি সংস্থার সঙ্গে যুক্ত।

রীতিমতো নথিপত্র দেখিয়ে তিনি বলেন, অভিষেক মনু সিংভির পরিবার ওই সংস্থার শেয়ার হোল্ডার। এই অভিযোগ শুনেই কলকাতায় থাকা অভিষেক মনু সিংভিও পাল্টা বলেন, আমার পরিবার নীরব মোদি ও মেহুল চোকসির কোনো সংস্থার সঙ্গে কোনোভাবেই যুক্ত নয়। একমাত্র মেহুল চোকসির একটি শো রুম আমার পরিবারের মালিকানার বিল্ডিংয়ে একটি ফ্লোর ভাড়া নিয়ে দোকান খুলেছিল। সেটাও গত বছর তারা নিজে থেকে ছেড়ে দিয়েছে। তারা ছিল নিছক ভাড়াটে। সুতরাং বিজেপি ডাহা মিথ্যে বলছে। ক্ষমা না চাইলে তিনি মানহানির মামলার হুমকিও দেন। এদিকে তদন্তকারীরা শনিবার দিনের শেষে জেনেছেন বিস্ফোরক এক তথ্য! নীরব মোদি নাকি ব্যাংক অফিসারদের দিয়ে জাল নথি তৈরি করাতেন টাকার পাশাপাশি নারীসঙ্গ তথা হানিট্র্যাপের মাধ্যমে! বহু ক্ষেত্রেই নীরব মোদির স্ত্রীকেও হানিট্র্যাপ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।

পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন