দুই দলে দেখা হলেই ভোটের আলাপ

  17-07-2017 08:16AM


পিএনএস ডেস্ক: ৩ জুলাই। আমেরিকার স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে রাজধানীতে এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে ঢাকার মার্কিন দূতাবাস। আমন্ত্রিত সুধীজনদের মধ্যে আছেন দুই বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের বেশ কয়েকজন রাজনীতিবিদও। বাইরে রাজনৈতিক ভেদাভেদ যতই থাক—এসব ঘরোয়া অনুষ্ঠানে নেতারা আন্তরিকভাবে, উষ্ণতার সঙ্গে, খোশমেজাজেই ভাববিনিময় করেন; এই অনুষ্ঠানেও তাই হলো। বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন নেতাকে দেখে এগিয়ে গেলেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর এক সদস্য। টিপ্পনী কেটে বললেন, ‘আপনারা তো আরামেই আছেন মনে হচ্ছে। শরীর, স্বাস্থ্য তো দেখি অনেক ভালো হয়েছে, চকচক করছে। ’ বিএনপির ওই নেতা হেসে বললেন, ‘হুম, কয়েক ডজন মামলা নিয়ে আরামেই আছি!’ এরপর হূদ্যতাপূর্ণ পরিবেশেই শুরু হলো দুই নেতার কথোপকথন। চলল আড্ডা। আগামী জাতীয় নির্বাচন, বিএনপির দাবিদাওয়া, আওয়ামী লীগের অবস্থান, বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা-গ্রেপ্তারসহ নানা বিষয়েই আলোচনা চলল অনেকটা সময়জুড়ে। বাদ যায়নি ব্যক্তিগত, পারিবারিক বিষয়ের কুশলাদি বিনিময়ও।

শুধু দূতাবাসের দাওয়াত নয়, সামাজিক-সাংস্কৃতিক নানা অনুষ্ঠান, টেলিভিশন টক শোসহ বিভিন্ন উপলক্ষে দুই পক্ষের নেতাদের মাঝেমাধ্যেই দেখা হচ্ছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও রাজপথের বিরোধী দল বিএনপির কেন্দ্রীয় শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা একে অন্যের মনোভাব ও অবস্থান জানা-বোঝার সুযোগটি হাতছাড়াও করছেন না। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে দুই পক্ষ সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা যেমন বলছে, পদ্ধতিগত বিষয় নিয়ে নিজ নিজ দলীয় অবস্থানও তুলে ধরছে। তাদের এই আলাপচারিতার গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো আরো পরে পৌঁছে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কাছেও।

আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই দলের নেতারাই বলছেন, চলমান রাজনৈতিক সংকট নিরসন করে কিভাবে সব দলের অংশগ্রহণে একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা যায়, তা নিয়েই এসব অনানুষ্ঠানিক আলোচনা হচ্ছে। তবে এ আলোচনা দলের উচ্চপর্যায়ের পরামর্শে হচ্ছে না। দুই দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতারা নিজেদের মতো করে এসব আলোচনা চালাচ্ছেন।

২০১৮ সালের শেষ বা ২০১৯ সালের শুরুতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। মাত্র দেড় বছরের মতো সময় বাকি থাকলেও দুই দলে দূরত্ব ঘুচে যাওয়ার কোনো লক্ষণ এখনো দেখা যাচ্ছে না এবং এসব অনানুষ্ঠানিক আড্ডায় তাঁরা তা তুলেও ধরছেন। এর পরও শেষ পর্যন্ত সম্পর্কের বরফ গলবে, সব দলের অংশগ্রহণে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে—এমনটাই বিশ্বাস করেন উভয় দলের নেতারা।

ঘরোয়া এসব আড্ডায় রাজনৈতিক প্রসঙ্গে যে মতবিনিয়ম চলে, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই দলেরই নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের বেশ কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। গতকাল রাতে বারিধারার যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসে এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানেও কথা বলেন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতারা। অনুষ্ঠানটিতে আওয়ামী লীগ নেতা এইচ টি ইমাম, ড. আব্দুর রাজ্জাক, মুহাম্মদ ফারুক খান এবং বিএনপি নেতা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, নজরুল ইসলাম খান, আসাদুজ্জামান রিপন, জাতীয় পার্টির জি এম কাদের, বিকল্পধারার মাহী বি চৌধুরী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়া সম্প্রতি গুলশানে ভারতীয় হাইকমিশনের প্রথম সেক্রেটারি নিনাদ দেশপাণ্ডের বিদায়ী নৈশভোজ, একটি জাতীয় দৈনিক আয়োজিত ঈদ সংখ্যা প্রকাশনী অনুষ্ঠানসহ বিভিন্ন টেলিভিশন টক শোর ফাঁকে আওয়ামী লীগ, বিএনপির নেতারা নিজেদের মধ্যে নানা বিষয়ে কথা বলেছেন।

জানা যায়, গত ৩ জুলাই বারিধারায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসে আমেরিকার স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী ও মুহাম্মদ ফারুক খান, পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী, বিএনপি নেতাদের মধ্যে ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ড. আবদুল মঈন খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, আবদুল আউয়াল মিন্টু প্রমুখ। অনুষ্ঠানে দুই দলের নেতারা আগামী নির্বাচন নিয়ে আলাপ-আলোচনা করেন।

রাজধানীর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে রাজনেতিক প্রসঙ্গ ওঠে কি না জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মুহাম্মদ ফারুক খান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘হ্যাঁ, আমাদের নানা কথাই হয়। সম্প্রতি আমেরিকান এমবাসির একটি অনুষ্ঠানেও বিএনপির শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে অনেক কথাবার্তা হয়েছে। তাঁরা আগামী নির্বাচনে সহায়ক সরকারের দাবি নিয়ে কথা বলেছেন। বিএনপি খুব শিগগির সহায়ক সরকারের রূপরেখা দেবে বলে জানিয়েছে। আমরা তাদের সহায়ক সরকারের প্রস্তাব নির্বাচন কমিশনকে দিতে বলেছি। ’

সাবেক মন্ত্রী মুহাম্মদ ফারুক খান আরো বলেন, ‘আমরা বিএনপি নেতাদের নির্বাচনে আসার বিষয়ে সব সময়ই উদ্বুদ্ধ করি। তাঁদের বলি, আপনারাই তো তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নষ্ট করেছেন। এখন আর সেটি ফিরে আসবে না। সংবিধানসম্মতভাবেই সামনের নির্বাচন হবে। সেই নির্বাচনে আপনাদের অংশ নেওয়া উচিত। ’

অনানুষ্ঠানিক আলোচনার বিষয়গুলো আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে জানানো হয় কি না জানতে চাইলে মুহাম্মদ ফারুক খান বলেন, ‘আলোচনার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয় বা নতুন কোনো তথ্য থাকলে নেত্রীকে তা জানাই। ’

এবার আর ভুল নয়, আগামী নির্বাচনে অংশ নিতেই হবে—ঘরোয়া অনুষ্ঠানগুলোয় অংশগ্রহণকারী বিএনপি নেতারা এমন আভাস দিচ্ছেন বলেও জানা যায়। জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ড. আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘তাঁদের সঙ্গে নির্বাচন নিয়ে নানা কথাবার্তাই হয়। তাঁদের বক্তব্যে বোঝা যায় আগামী নির্বাচনে তারা অবশ্যই অংশ নেবে। ’

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে গণমাধ্যমকে বলেন, ‘অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় তো বিএনপির নেতারা বলেন যে আগামী নির্বাচনে তাঁরা অংশ নেবেন। তাঁরা তাঁদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত বিভিন্ন মামলা প্রত্যাহারের বিষয়েও কথা বলেন। যেমন সম্প্রতি আমেরিকান ইনডিপেনডেন্ট ডে উপলক্ষে একটি অনুষ্ঠানে বিএনপি নেতারা তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার করতে বলেন। আমরা বলেছি, রাজনীতিবিদদের জন্য মামলা বড় বিষয় নয়। মামলাগুলো কিসের সেটা দেখতে হবে। রাজনৈতিক মামলা হলে এক রকম বিষয়, আর নাশকতার মামলা হলে অন্য বিষয়। জ্বালাও-পোড়াও করে মানুষ খুন, রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংস করলে মামলা, সে মামলা তো প্রত্যাহার করার সুযোগ নেই। ’

বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান, দূতাবাসের অনুষ্ঠানসহ অন্যান্য অনুষ্ঠানে এ নিয়ে সরকারি দলের নেতাদের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা হওয়ার কথা গণমাধ্যমের কাছে স্বীকার করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান ও যুগ্ম মহাসচিব মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল।

মাহবুবুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আলোচনা তো হচ্ছে। তারাও বলছেন, আমরাও বলছি। এখন সময়ই বলে দেবে কী হয়। ’

মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, ‘শুধু আওয়ামী লীগ কেন, সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোতে চলমান রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে আমন্ত্রিত প্রায় সকল রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে আমাদের কথা হয়। তাঁরাও সংকট নিরসনে কিভাবে কাজ করা যায় সে পরামর্শ দেন, আমরাও আমাদের পরামর্শ তুলে ধরি। আমাদের দাবি যেহেতু ন্যায়সংগত, স্বাভাবিকভাবেই আমাদের যুক্তির সঙ্গে তাঁদের অনেকে একমত পোষণ করেন। ’

আগামী নির্বাচন নিয়ে ক্ষমতাসীনদের মনোভাব কী বুঝতে পারছেন? এমন প্রশ্নের জবাবে বিএনপি স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে গণমাধ্যমকে বলেন, ‘ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ নেতাদের মনোভাব হচ্ছে, রাজনীতিবিদদের কর্তৃত্ব বহাল রেখেই নির্বাচনকালীন সরকার হতে পারে। এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার যেকোনো প্রস্তাব তাঁরা মানতে প্রস্তুত। যুক্তি হিসেবে তাঁরা ২০০৭ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নানা কর্মকাণ্ডের কথা বলেন। কিন্তু আমাদের যুক্তি হচ্ছে, তত্ত্বাবধায়ক বা সহায়ক সরকার যাই হোক, সেই সরকারের প্রধান ও অন্য সদস্যদের অবশ্যই অরাজনৈতিক ব্যক্তি হতে হবে। কেননা শেখ হাসিনার অধীনে যে দেশে কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না তার অনেক প্রমাণ দেশবাসী দেখেছে। ’

বিএনপির এই নেতা আরো বলেন, ‘আমরা তাদের বারবার তাগাদা দিয়েছি, সংকট নিরসন করতে হলে অবশ্যই বিরোধী দলের সঙ্গে বসতে হবে, আলোচনা করতে হবে। উটপাখির মতো মরুভূমিতে ঝড় আসলে বালুর তলে মুখ ঢুকিয়ে ঝড় এড়ানো যাবে না। অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ থাকে? এ দেশে অতীতে এমন অনেক সমস্যা দেখা দিয়েছিল যেগুলো আলোচনা করেই ঠিকঠাক করা হয়েছে। তাদের (আওয়ামী লীগ) নেতাও অনেক গোলটেবিল করেছেন আইয়ুব খান, ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে। আসলে নির্বাচনের সময়ে নির্বাচন কমিশন যদি শক্তিশালী হয়ে যায় তাহলে এই সমস্যা থাকে না। আমরা বলেছি, কোন কোন মিনিস্ট্রি নির্বাচন কমিশনের কাছে যাওয়া উচিত, কিভাবে দেশ পরিচালনা হবে। কিন্তু সেই জায়গাগুলো থেকে সরকার সরে গেছে। তাদের নিজেদের অবস্থান আগে ঠিক করতে হবে। ’

এদিকে বিএনপির একাধিক নেতা এ ধরনের অনানুষ্ঠানিক আলোচনার সার্থকতাই দেখেন না। উভয় দলেরই নিজ নিজ অবস্থানে অনড় থাকার ঘটনায় উদ্বেগ ব্যক্ত করে তাঁরা বলেন, দুই পক্ষকেই ছাড় দিতে হবে, তবে যদি কিছু হয়।

সম্প্রতি বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দলীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘আমি কিন্তু আশাবাদী মানুষ। আমি প্রতি মুহূর্তে আশা করি যে গুড থিংকস উইল কাম আউট, ভালো জিনিস আসবেই। বরফ গলানো এক দিনে নাও হতে পারে, নাও গলতে পারে, গলতেও পারে। তবে আমি আশাবাদী যে বরফ গলবে, গলতেই হবে। আমি বিশ্বাস করি, শেষ পর্যন্ত শুভ বুদ্ধির উদয় হবে। আলোচনার মধ্য দিয়ে একটা সমঝোতার রাস্তা বেরোবে। ’ ক্ষমতাসীনদের মনোভাব বুঝতে পারছেন না জানিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘ওনারা কী চান আমি বুঝতে পারি না। সরকার আসলে কী চায়?’

পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন