চিৎকৎসা দক্ষতার অভাবে অস্ত্রোপচারে মৃত্যু

  23-02-2024 02:00PM

পিএনএস ডেস্ক: দেশে দুই হাজারের বেশি অ্যানেসথেসিওলজিস্ট বা অবেদনবিদ রয়েছেন। তবে এই সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় খুব কম। সরকারি হাসপাতালগুলোতে গড়ে সার্জন রয়েছেন একজন। প্রতি দুটি হাসপাতালের বিপরীতে অবেদনবিদ রয়েছেন একজনেরও কম।

এসব হাসপাতালে গড়ে প্রতি তিনজন সার্জনের বিপরীতে অবেদনবিদ মাত্র একজন। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।

অবেদনবিদদের এই সংকটে একদিকে যেমন বিভিন্ন হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের মতো জটিল চিকিৎসা ব্যাহত হচ্ছে, তেমনই এ কাজে দক্ষতার অভাবে চিকিৎসাসেবায় মৃত্যুঝুঁকির মতো পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। রাজধানীতে সম্প্রতি খতনার দুটি পৃথক ঘটনায় দুই শিশুর মৃত্যু হয়েছে।

শিশু দুটির মা-বাবার অভিযোগ ভুল অ্যানেসথেসিয়া নিয়ে, যে কারণে তাদের আর জ্ঞান ফেরেনি। এসব ঘটনায় অনেক অভিভাবক আতঙ্কিত। নাম প্রকাশ না করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত একজন অভিভাবক বলেন, এই মৌসুমে তাঁর ছয় বছর বয়সী শিশুপুত্রের খতনা করাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু উল্লিখিত ঘটনাগুলো তাকে দমিয়ে দিয়েছে।

আরেকটু দেখেশুনে এগোবেন।

হাসপাতালে খতনার কাজটি করেন শল্যচিকিৎসক। রোগীকে অ্যানেসথেসিয়ার মাধ্যমে অচেতন বা শরীরের স্থানবিশেষ অবশ করে অস্ত্রোপচারের জন্য প্রস্তুত করেন অবেদনবিদ।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, খতনা করাতে গিয়ে এ ধরনের মৃত্যুর ঘটনা যে সাম্প্রতিক, তা নয়। বছরের পর বছর ধরে ঘটছে।

প্রশিক্ষিত অবেদনবিদের সংকট ও অ্যানেসথেসিয়ায় অব্যবস্থাপনার কারণে সার্জারি করতে গিয়ে রোগীর মৃত্যু হচ্ছে। শুধু অচেতন বা অবশ করাটাই অবেদনবিদের একমাত্র কাজ নয়, অস্ত্রোপচার-পরবর্তী সময়ে রোগীর জ্ঞান ফেরানোর গুরুদায়িত্বও তিনি পালন করেন। অথচ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দক্ষ অবেদনবিদ দিয়ে এসব কাজ করানো হচ্ছে না।

অ্যানেসথেসিয়া দেওয়ার আগে অবেদনবিদ রোগীর সার্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে তার মেডিক্যাল হিস্ট্রি খতিয়ে দেখে সিদ্ধান্ত নেবেন, রোগীকে তা দেওয়া যাবে কি না। কিন্তু বিষয়টি অনেক ক্ষেত্রে মানা হচ্ছে না। ফলে একের পর এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটছে।

‘বাংলাদেশ হেলথ ওয়ার্কফোর্স স্ট্র্যাটেজি ২০২৩’ শীর্ষক স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কৌশলপত্রের তথ্য অনুযায়ী, অ্যানেসথেসিওলজিস্ট ও ল্যাব টেকনিশিয়ানের অভাবে কোনো কোনো সরকারি হাসপাতালে সার্জারি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। শহরের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে অবেদনবিদের মতো বিশেষায়িত চিকিৎসকের সংকট আরো বেশি।

বাংলাদেশ সোসাইটি অব অ্যানেসথেসিওলজিস্টসের তথ্য অনুযায়ী, উচ্চতর পোস্ট-গ্র্যাজুয়েটধারী অবেদনবিদের সংখ্যা তিন হাজারের বেশি। এর মধ্যে সরকারি হাসপাতালে রয়েছেন ৮০০ থেকে ৯০০ জন। এর বাইরে অনেকে আছেন দেশের বাইরে। আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী, দেশে অবেদনবিদ প্রয়োজন কমপক্ষে ১২ থেকে ১৩ হাজার।

বাংলাদেশ সোসাইটি অব অ্যানেসথেসিওলজিস্ট ক্রিটিক্যাল কেয়ার অ্যান্ড পেইন ফিজিশিয়ানের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ডা. কাওসার সরদার বলেন, ‘এই ধরনের ঘটনা এখনই যে ঘটছে, তা কিন্তু নয়। বছরের পর বছর ধরে ঘটছে। কিন্তু কেন ঘটছে? এর পেছনের কারণগুলো কী? তা আমাদের জানা দরকার।’

ডা. কাওসার সরদার বলেন, “আমাদের দেশে অবেদনবিদের সংকট রয়েছে। দেখা যায়, প্রশিক্ষণ নেই বা অন্য বিষয় নিয়ে লেখাপড়া করেছেন, তিনিও অ্যানেসথেসিয়া দিচ্ছেন। এটি দেওয়ার জন্য যে ‘স্ট্যান্ডার্ড সেটআপ’ দরকার, সেটি অনেক অপারেশন থিয়েটারে নেই। অ্যানেসথেসিয়া দেওয়া থেকে শুরু করে সেখানে যদি রোগীর হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়, সেটি পুনরায় সচল করার ব্যবস্থা থাকতে হবে। সেটি অনেক জায়গায় থাকে না। অথচ সার্জারি চলছে।”

শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ ও বিভাগীয় প্রধান (অ্যানেসথেসিওলজি) অধ্যাপক ডা. এ বি এম মাকসুদুল আলম বলেন, ‘উন্নত বিশ্বে একজন চিকিৎসকের চেয়ে অ্যানেসথেসিওলজিস্টের বেতন ও সামাজিক মর্যাদা অনেক বেশি। আমাদের দেশে উল্টো। পদায়ন পদোন্নতির নানা সীমাবদ্ধতা থাকে। অ্যানেসথেসিয়ার বিষয়টি কিছুটা কঠিন। এ ছাড়া কাজও বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। এর সঙ্গে সামাজিক মর্যাদাও অন্যান্য চিকিৎসকের তুলনায় কম হওয়ায় শিক্ষার্থীদের আগ্রহ অনেক কম থাকে।’

এ বি এম মাকসুদুল আলম বলেন, ‘স্বাস্থ্য খাতে প্রতিটি অপারেশন থিয়েটারের (ওটি) বিপরীতে অন্তত একজন অ্যানেসথেসিওলজিস্ট থাকা বাঞ্ছনীয়। আমাদের সার্জনের বিপরীতে অ্যানেসথেসিওলজিস্ট তেমন বাড়েনি।’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) পেডিয়াট্রিক সার্জারি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. এ কে এম জাহিদ হোসেন বলেন, হাসপাতালে সাধারণত শিশু পেডিয়াট্রিক সার্জন খতনার কাজটি করে থাকেন। কিন্তু সারা দেশে শিশু সার্জন অপ্রতুল থাকায় অন্যান্য সার্জনও কাজটি করে থাকেন।

ডা. এ কে এম জাহিদ হোসেন বলেন, একজন রোগীকে পুরো অজ্ঞান করা সব সময় ঝুঁকিপূর্ণ। তাই কোনো রোগীকে অজ্ঞান করে অপারেশন করার আগে তার ফিটনেস যাচাই, ঝুঁকি পরিমাপ করা এবং রোগী কিংবা তার পরিবারের সঙ্গে বিস্তারিত আলাপ করা প্রয়োজন।

তিনি বলেন, রোগীকে অজ্ঞান করার ছয় ঘণ্টা আগে থেকে শক্ত খাবার এবং চার ঘণ্টা আগে থেকে তরল খাবারসহ সব ধরনের খাওয়া বন্ধ করা জরুরি। এ ছাড়া রোগীর জন্মগত হার্ট, ফুসফুস, লিভারের সমস্যা থাকলেও পুরো অজ্ঞান করাটা ঝুঁকিপূর্ণ। তাই যার অপারেশন লাগবে, তার জন্য জেনারেল অ্যানেসথেসিয়া একমাত্র উপায়, নাকি কোনো বিকল্প আছে, তা ভেবে দেখা জরুরি। কালের কণ্ঠ


পিএনএস/এমএইউ

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন