কীভাবে উমরা পালন করবেন

  26-07-2017 01:48AM

পিএনএস ডেস্ক: সামর্থ্যবান মুসলমানের জন্য জীবনে একবার হজ পালন অবশ্যকর্তব্য। আমরা সব সময় চর্চা করি না বলে হজ পালন সম্পর্কে অনেক কিছুই জানা থাকে না। হজের শুদ্ধ পদ্ধতি, হজের প্রস্তুতি এসব বিষয়ে জানা আমাদের কর্তব্য।

উমরার প্রস্তুতি
উমরা শব্দের আভিধানিক অর্থ সাক্ষাৎ করা, পরিদর্শন করা। ইসলামের পরিভাষায় বছরের যে কোনো সময়ে নির্ধারিত নিয়মে কাবা পরিদর্শন করাকেই বলা হয় উমরা।

উমরার ফরজ ২টি
১. ইহরাম (মিকাত হতে)।

২. কাবা তাওয়াফ করা।

উমরার ওয়াজিব ২টি
১. সাফা ও মারওয়া সাঈ করা।

২. মাথা মুণ্ডন করা বা মাথার চুল ছাঁটা।

অজুখানা
আপনি যখনই হোটেল থেকে বের হবেন, তখনই আপনি অজু করেই একসঙ্গে বের হবেন। আপনি যখন ডান পা দিয়ে মসজিদুল হারামে ঢুকবেন, দোয়া পড়বেন, ভেতরে যাওয়ার পরে আপনি কাবা দেখতে পাবেন। কাবা দেখার পরে পড়ার জন্য রাসুল (সা.) নির্ধারিত, নির্দিষ্ট কোনো দোয়া দেখিয়ে দিয়ে যাননি। হজরত ওমর (রা.) একটি দোয়া পড়েছিলেন, আমরা ওই দোয়াটি পড়তে পারি।

‘আল্লাহুম্মা আনতাস সালাম ওয়া মিনকাস সালাম, ফাহাইয়্যানা রব্বানা বিস-সালাম’ (‘হে আল্লাহ! আপনি শান্তিময়, আপনি শান্তির উৎস। আপনি আমাদেরকে শান্তির সঙ্গে বাঁচিয়ে রাখুন’।)

তাওয়াফ
কাবার পাশে হাজরে আসওয়াদ বা কালো পাথর বরাবর গিয়ে তাওয়াফ শুরু করতে হবে। কাবার দরজার পাশে হারামের এবং কাবার যে কর্নার তাকে বলা হয় হাজরে আসওয়াদ কর্নার। কারণ এখানে হাজরে আসওয়াদ নামক পাথরটি বসানো আছে। তারপর দেখতে পাবেন মাকামে ইব্রাহিম, এই পাশের কর্নারটাকেই বলা হয় ইরাকি কর্নার, তারপরে হিজর আল কাবা বা হাতিম। এরপরের যে কর্নার, তার নাম শামি কর্নার। তারপরের শেষ যে কর্নারটি, সেটা হলো ইয়েমেনি কর্নার। যাকে আমরা বলে থাকি রুকুনে ইয়েমেনি। যদি এই জায়গাটুকু চিনে রাখেন তাহলে আপনাদের তাওয়াফ করাটা খুব সহজ হয়ে যাবে এবং মনে রাখতে হবে কাবা তাওয়াফের জন্য রাসুল (সা.) নির্দিষ্ট কোনো দোয়া দেখিয়ে দিয়ে যাননি। শুধু একটা দোয়া আপনারা পড়বেন যখন রুকুনে ইয়েমেনি বা ইয়েমেনি কর্নারে পৌঁছাবেন। রুকুনে ইয়েমেনি থেকে আপনারা হাজরে আসওয়াদ পর্যন্ত একটা নির্দিষ্ট দোয়া পাঠ করবেন ইনশাআল্লাহ।

কাবায় একটি সবুজ বাতি দেওয়া আছে। সেখান থেকে আপনারা কাবা তাওয়াফ শুরু করবেন। যখনই কাবা তাওয়াফ শুরু করবেন, তখন পুরুষদের জন্য একটি সুন্নাহ কাজ করতে হবে। একে বলা হয় ইসতিবা।

ইসতিবা
আপনার ওপরে যে সেলাইবিহীন সাদা কাপড়টি আছে, সেটি আপনি ডান বগলের নিচে দিয়ে এনে বাম হাতের ওপরে রেখে দেবেন। অর্থাৎ আপনার ডান কাঁধটি খালি থাকবে। সাতটি চক্কর শেষ করা পর্যন্ত আপনাকে ইসতেবারত অবস্থায় থাকতে হবে। তারপর আপনি হাজরে আসওয়াদ বরাবর হবেন, হাজরে আসওয়াদকে চুমু খাবেন যদি সম্ভব হয়, যদি সম্ভব না হয় হাজরে আসওয়াদকে আপনি ছড়ি দিয়ে বা অন্যকিছু দিয়ে স্পর্শ এবং তাতে চুমু খাবেন। তাও যদি সম্ভব না হয় তখন আপনাকে ইশারা করতে হবে। ডান হাত উঠিয়ে বলবেন ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ এটা বলে আপনি শুরু করবেন এবং আল্লাহর প্রশংসা দিয়ে কাবা তাওয়াফ শুরু করবেন।

পুরুষরা যখনই কাবা তাওয়াফ শুরু করবেন, তখন আপনার আরেকটি কাজ শুরু হবে, সেটি হলো ‘রমল’ (ছোট পায়ে দ্রুত কদমে চলা) এবং রমল হবে তিনটি চক্কর পর্যন্ত। এরপর আপনি যতটুকু জানেন আল্লাহর প্রশংসা, আল্লাহর তাসবিহ, দোয়া এগুলো পাঠ করতে থাকব। পাঠ করতে করতে যখন রুকুনে ইয়েমেনি বরাবর চলে আসবেন তখন একটা নির্ধারিত কাজ আছে, সেটি করতে হবে। সেই কাজটি হচ্ছে, রুকুনে ইয়েমেনি বরাবর আসবেন, এখানে একটি সুন্নাহ আছে, চেষ্টা করবেন, যদি সম্ভব হয় এই সুন্নাহটি পালন করবেন। সুন্নাহটি হলো রুকুনে ইয়েমেনিকে স্পর্শ করা। যদি স্পর্শ করতে না পারেন তাহলে এখানে ইশারা করবেন না। শুধুমাত্র দোয়াটা পড়বেন, সুরা বাকারার (পবিত্র কোরআনের ২নং সুরা) ২০১ নম্বর আয়াত, ‘রাব্বানা আতিনা ফিদদুনিয়া হাসানাতাও ওয়া ফিল আখিরাতে, হাসনাতাও ওয়াকিনা আজাবান নার’। এই দোয়াটা করতে করতে আপনি আবার হাজরে আসওয়াদ বরাবর চলে আসবেন। আবার ইশারা করবেন আল্লাহু আকবার অথবা বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার বলে আপনার দ্বিতীয় চক্কর শুরু করবেন। এভাবে সাতটি চক্কর যখন সম্পন্ন হবে, তখন আপনার ইসতিবাটাকে বন্ধ করে দেবেন। অর্থাৎ আপনার যে ডান কাঁধটি খোলা ছিল, এই খোলা জায়গাটিকে আবার কাপড় দিয়ে ঢেকে দেবেন। কাঁধটি ঢেকে দিয়ে আপনি চলে আসবেন মাকামে ইব্রাহিমের পেছনে। মাকামে ইব্রাহিমের পেছনে আসার সময় একটা সুন্নাহ পালন করার জন্য চেষ্টা করবেন, সেটি হলো সুরা বাকারার ১২৫ নং আয়াতের একটি অংশ ‘ওয়াত্তাখিজু মিম্মাকামি ইব্রাহিমা মুসাল্লা’। আল্লাহ সুবানাহু তায়ালা বলেন, ‘তোমরা মাকামে ইব্রাহিমকে নামাজের জায়গা বানাও’ -এ কথা বলাটাই একটা সুন্নাহ। এরপর দুই রাকাত নামাজ পড়বেন এবং আমাদের মা-বোন যাঁরা আছেন তাঁরা অবশ্যই একেবারে পেছনের কাতারে চলে যাবেন। এখানেও রাসুল (সা.) একটি সুন্নাহ দেখিয়ে দিয়েছেন, ছোট ছোট দুটি সুরা, প্রথম রাকাতে সুরা কাফিরুন এবং দ্বিতীয় রাকাতে সুরা ইখলাস পাঠ করা। এটা সুন্নাহ, চেষ্টা করবেন এটা পালন করতে ইনশাআল্লাহ। সালাতুল তাওয়াফ যখন শেষ হয়ে যাবে, কাবা তাওয়াফ, এই ফরজটুকু শেষ হবে।

এরপরে আপনি সাঈ করবেন। কিন্তু সাঈ করতে যাওয়ার আগে আরেকটা সুন্নাহ পালন করবেন, সেটা হলো জমজমের পানি পান করা। এই জমজমের পানি পান করা সম্পর্কে রাসুল (সা.) বলেন যে, ‘জমজমের পানি পৃথিবীর সর্বোত্তম পানি।’ তিনি জমজমের পানি পান করতেন এবং তিনি বলতেন ‘এটা বরকতময়, পরিতৃপ্তিকারী এবং এটি রোগীর প্রতিশেধক’। সুবহান আল্লাহ। আপনি প্রতিদিন যতবার জমজমের পানি পান করবেন, ততবার আপনি এই সুন্নাহগুলো পালন করার চেষ্টা করবেন। বিসমিল্লাহ বলবেন, কাবামুখী হবেন, দোয়া করবেন, দাঁড়িয়ে পান করবেন, তিন নিশ্বাসে পান করবেন, তৃপ্তি সহকারে পান করবেন এবং যখন পান করা শেষ হয়ে যাবে তখন ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করবেন।

হারাম শরিফের ভেতরে প্রচুর জমজমের পানির কনটেইনার পাবেন, জমজমের পানি পানের জায়গা পাবেন। এই কনটেইনারের পানিগুলো প্রচণ্ড ঠান্ডা। এই ঠান্ডা পানি যদি আপনি একদিনের বেশি খান, তাহলে আপনার গলা আক্রান্ত হবে, আপনি জ্বরে আক্রান্ত হবেন। যে কনটেইনারগুলোতে নীল কালি দিয়ে ‘not cold’ লেখা আছে, সেই কনটেইনারের পানি পান করবেন। ইনশাআল্লাহ সহজ হয়ে যাবে আপনার জন্য এবং সেখানে উপুড় করে নতুন গ্লাস রাখা থাকবে, সেখান থেকে গ্লাস নেবেন, পান করবেন এবং গ্লাসটিকে সোজা করে রেখে দেবেন। জমজমের পানি পান করা শেষ হলো। এরপর আপনি উমরার জন্য প্রথম যে ওয়াজিব কাজটি করবেন, সেটি হলো সাঈ করা।

সাফা মারওয়া সাঈ
ঠিক তাওয়াফের মতো আপনি নিয়ত করবেন, সাফা থেকে সাঈ শুরু হবে, মারওয়াতে গিয়ে শেষ হবে যেটা রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ যা দিয়ে শুরু করেছেন আমিও তা দিয়ে শুরু করব।’ সাফা থেকে মারওয়ার পর্যন্ত পুরো দূরুত্বটুকু শেষ করতে হবে এবং সাতবার চক্কর শেষ করতে হবে। যাঁরা সক্ষম, তাঁরা অবশ্যই পায়ে হেঁটে সাফা-মারওয়া সাঈ করবেন এবং উমরা পালনকারী ব্যক্তি ইহরাম অবস্থায় সাঈ করবেন।

আপনি সাফা পাহাড়ের কাছে আসবেন, নিয়ত করবেন, তারপর এই অংশটুকু পাঠ করবেন— ‘ইন্নাস সাফা ওয়াল মারওয়াতা মিন সাঈ লিল্লাহ’ (‘নিশ্চয়ই সাফা এবং মারওয়া আল্লাহর নিদর্শনগুলোর অন্তর্ভুক্ত’) এটা পড়বেন। আপনি কাবামুখী হবেন, আল্লাহর একত্ববাদ, বড়ত্বের ঘোষণা দেবেন। ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারিকালাহু লাহুল মুলকু ওয়ালাহুল হামদু, ওয়া হুয়া ‘আলা কুল্লি শাইয়িন ক্বদীর’। এই দোয়াটা আপনারা তিনবার পড়বেন। রাসুল (সা.) তিনবার বলেছেন তিনবার বলবেন এবং তিনবার দোয়া করবেন। এটার সঙ্গে আরো একটি দোয়া আছে, এই দোয়াটাও আপনারা পড়বেন এবং যখন দোয়া করা শেষ হবে, তখন সাফা পাহাড়ের শেষ প্রান্ত থেকে মারওয়ার দিকে হেঁটে যাবেন।

যখনই আপনি সাফা থেকে মারওয়ার দিকে হাঁটা শুরু করবেন, তখন দেখতে পারবেন নিচতলা, একতলা, দোতলায় সাঈ করা যায়। কিছু কিছু ফ্লোরে যতটুকু সবুজ বাতি আমাকে দৌড়াতে হবে ততটুকুই সবুজ বাতি দেওয়া আছে। আর কিছু কিছু ফ্লোরে প্রথমে এবং শেষে সবুজ বাতি দেওয়া আছে। এই দুটি সবুজ বাতিতে আপনাকে একটু দ্রুত দৌড়াতেই হবে, দ্রুত হাঁটতেই হবে এবং এখানে একটি দোয়া পড়া সুন্নাহ। আপনি চেষ্টা করবেন এই দোয়াটি যেন পড়তে ভুলে না যান। ‘রাব্বিগফির ওয়ার’হাম ওয়াআনতাল আ’আজ্জুল আকরাম’। ইনশাআল্লাহ আপনি চেষ্টা করবেন এটি পড়তে। একইভাবে যখন আপনি সাঈ করবেন, আপনাকে মনে রাখতে হবে তাওয়াফের মতো এখানেও কোনো নির্দিষ্ট দোয়া নেই। আপনার জানা দোয়া এবং তাসবিহগুলোই এখানে বেশি বেশি করে পাঠ করবেন। এভাবে হেঁটে আপনি মারওয়া পাহাড়ে পৌঁছাবেন। মারওয়া পাহাড়ে পৌঁছানোর পর সাফা পাহাড়ে যা যা করেছিলেন, একইভাবে কোরআনের আয়াতটুকু না পড়ে বাকি সবগুলোই আপনি করবেন এবং করে আবার আপনি সাফা পাহাড়ের দিকে চলে আসবেন। যখন সাফা পাহাড়ে আসতে থাকবেন, তখন আবার ওই সবুজ বাতি দুটি পাবেন, আবার জোরে একটু হাঁটবেন এবং দোয়াটা পড়বেন। যখন সাফা থেকে মারওয়া এবং মারওয়া থেকে সাফা আসলেন, তখন আপনার দুটি চক্কর সম্পন্ন হলো। এভাবে আপনার প্রথম, দ্বিতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠ ও সপ্তম চক্কর, যেটা সাফা থেকে মারওয়াতে গিয়ে সম্পন্ন হবে।

আল্লাহর মসজিদুল হারাম থেকে যখন বের হবেন, আপনি অবশ্যই এই সুন্নাহ পালন করবেন, বাম পা দিয়ে বের হবেন এবং দোয়াটা পড়বেন। প্রতিবার, যতবার আপনি মসজিদে ঢুকবেন এবং বের হবেন, ততবার আপনি এই সুন্নাহগুলো পালন করবেন। এরপর আপনি চলে আসবেন হোটেলে, আসার পরে প্রতিটা হোটেলের নিচেই আপনি পর্যাপ্ত সেলুন দেখতে পাবেন। যিনি পুরুষ তিনি সেলুনে যাবেন, সেলুনে গিয়ে আপনি দুটি কাজ করতে পারেন হলক অথবা কসর। এটা উমরাহর দ্বিতীয় ওয়াজিব। হলক মানে মাথা মুন্ডানো, কসর মানে চুল ছোট করে কাটা। আগে পুরুষরা হলক অথবা কসর করে আসবেন, এসে আপনার সঙ্গে আপনার মা বা স্ত্রী বা বোন বা মেয়ে যে থাকবেন, আপনি তখন ওনারটা কেটে দেবেন। মা-বোনদের চুল ততটুকু কাটাতে হবে, ওনারা চুলের গোছাটুকু ধরবেন, একদম নিচে নিয়ে এসে ওখান থেকে অর্ধাঙ্গুলি পরিমাণ কাটতে হবে। যিনি মাহরাম থাকবেন, তিনি কাটবেন। মনে রাখতে হবে চুল কাটানো শেষ না করা পর্যন্ত কোনোভাবেই একজন পুরুষ অথবা একজন মহিলা নিজের চুল নিজে কাটবেন না। যখন আপনার চুল কাটা সম্পন্ন হয়ে যাবে, আপনার উমরাহর যে দুটো ওয়াজিব, সেটি সম্পন্ন হবে এবং আপনার উমরাহর জন্য যে বিধি-বিধানের মধ্যে ছিলেন, সেখান থেকে হালাল হবেন, আপনি স্বাভাবিক পোশাক পরিধান করবেন এবং ইনশা আল্লাহ এইভাবেই আপনার একটা উমরাহ আপনি সম্পন্ন করতে পারবেন।

আগামী পর্বে আপনারা কীভাবে হজ পালন করবেন, সে বিষয়ে আলোকপাত করব।


পিএনএস/আলআমীন

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন