পরিচ্ছন্ন কর্মীদের অপরিচ্ছন্ন জীবন

  28-10-2016 06:31AM

পিএনএস: অপরিচ্ছন্ন এবং ঝুঁকিপূর্ণ জীবনযাপন করছে রাজধানীর পরিচ্ছন্ন কর্মীরা। কর্মরত শ্রমিকদের একটি বড় অংশ কিছুদিন পরই পরই চর্ম ও পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হচ্ছেন। বিশেষ করে ল্যান্ডফিলের কর্মীরা লিভার ফুসফুসসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। কিন্তু তাদের চিকিৎসায় কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেই সিটি করপোরেশনে।

ডিএসসিসির স্ক্যাভেঞ্জার্স অ্যান্ড ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল লতিফ জানান, পরিচ্ছন্ন কর্মীদের রাস্তা ঝাড়ু দেয়া, সেই ময়লা নিয়ে যাওয়া এবং ডাস্টবিন ও বাসা-বাড়ির ময়লা পরিষ্কার করতে হয়। এছাড়া স্টর্ম সুয়্যারেজ লাইন পরিষ্কার এবং ল্যান্ডফিলে ময়লা ওঠানো-নামানোর কাজ করতে হয়। এসব ময়লা ফেলতে সিটি করপোরেশন থেকে হ্যান্ডস গ্লাভস দেয়া হয়, কিন্তু অনেকেই এটি ব্যবহার করে ঠিকভাবে কাজ করতে পারে না। এ কারণে বেশিরভাগ পরিচ্ছন্ন কর্মীই খালি হাত-পায়ে কাজ করেন। এতে নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন কর্মীরা।

রোগব্যাধির কারণে অনেকেই লিভার ও ফুসফুসজনিত জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। কিন্তু অর্থাভাবে ঠিকমতো চিকিৎসা করাতে না পেরে অকালেই প্রাণ হারাচ্ছে। এছাড়া, চর্ম ও পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হন প্রতিনিয়ত।

মাতুয়াইল ল্যান্ডফিলে কাজ করেন ১০ জন পরিচ্ছন্ন কর্মী। এর মধ্যে সাড়ে আট বছর ধরে কর্মরত সুধামা দাস বলেন, এক সময় জাইকা থেকে গাম বুট ও হাতের গ্লাভস দিতো, কিন্তু তারা এখন আসে না, সিটি করপোরেশন থেকেও গ্লাভস-গাম বুট দেয় না। খালি হাতে কাজ করতে হয়। এ কারণে হাতে চর্ম রোগ হয়েছে। পায়ে ঘা হয়ে গেছে। প্রায়ই পেট খারাপ হয়। কিন্তু দেখার কেউ নেই। এখানে বিশুদ্ধ পানি খাওয়ারও ব্যবস্থা নেই। জীবন বাঁচানোর তাগিদে অনেকটা বাধ্য হয়েই কাজ করতে হয় জানিয়ে তিনি বলেন, সারা শহরের ময়লা আসে এখানে। গন্ধে টেকা যায় না। বৃষ্টি হলে তখন অবস্থা আরো ভয়াবহ হয়ে যায়।

ডিএনসিসির স্ক্যাভেঞ্জার্স অ্যান্ড ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ইসমাইল হোসেন বলেন, পরিচ্ছন্ন কর্মীদের দুর্ভোগের শেষ নেই। বেশির ভাগ কর্মীই চর্মসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। কিন্তু সঠিক চিকিৎসা নিতে পারেন না তারা। এ কারণে অনেকেই অকালে মৃত্যুবরণ করেন। ডিএনসিসি’র ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন সভাপতি আবুল কালাম বলেন, ডিএনসিসিতে মোট দুই হাজার ৭শ’ ৪২ জন পরিচ্ছন্ন কর্মী রয়েছে। এর অর্ধেকের বেশি নারী। কর্মীরা রাত ৪টা থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত কাজ করেন। কিন্তু তাদের প্রাকৃতিক প্রয়োজন হলেও কোনো উপায় থাকে না। মানুষের বাসায় থাকা কাজের লোকদের বাথরুমও ব্যবহার করতে দিতে চায় না। তখন অনেক কষ্টে কাজ করতে হয় মহিলাদের। এ কারণে তারা নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। প্রতিটি ওয়ার্ডে অন্তত একটি করে হাজিরা ঘর থাকলেও মহিলারা প্রাকৃতিক কাজ সম্পন্ন করতে পারতেন। আবার বৃষ্টি হলেও রক্ষা পাওয়া যেত। এছাড়া রাতে নারীরা ছিনতাই ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন বলেও তিনি জানান। তিনি বলেন, আমিনবাজার ল্যান্ডফিলে ১০ জন পরিচ্ছন্ন কর্মী থাকার কথা, অথচ সেখানে মাত্র দুই জন দায়িত্ব পালন করছে। ডিএসসিসির স্ক্যাভেঞ্জার্স অ্যান্ড ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সভাপতি আব্দুস সাত্তার বলেন, পরিচ্ছন্ন কর্মীরা রাতে কাজ করার সময় প্রায়ই দুর্ঘটনার মুখোমুখি হচ্ছেন। বেপরোয়া ট্রাক ড্রাইভাররা রাস্তায় কাজ করার সময় গায়ের উপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে দেয়। অথচ আমাদের কোনো ঝুঁকি ভাতা নেই, চিকিৎসা খরচও পাই না। কোনো শ্রমিক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে পড়ে থাকলে তার ছেলেমেয়ে যদি তার কাজ করে না দেয় তাহলে বেতনও পায় না। তিনি জানান, পরিচ্ছন্ন কর্মী মারা গেলে উত্তর সিটিতে এক লাখ টাকা দেয়। কিন্তু আমাদের দক্ষিণ সিটিতে আগে ৫০ হাজার করে টাকা দিত, এখন তাও দেয়া বন্ধ করে রেখেছে। এজন্য ইউনিয়ন থেকে প্রতি মাসে ৭০ হাজার টাকা করে মোট ৫ জনকে সাড়ে তিন লাখ টাকা দেয়া হয়। এভাবে এখন প্রায় ৩০ জন তালিকায় রয়েছেন বলে তিনি জানান।

এ ব্যাপারে ডিএসসিসির অতিরিক্ত প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা খোন্দকার মিল্লাতুল ইসলাম বলেন, নগরীর পরিচ্ছন্নতার কাজটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এজন্য কর্মীদের ঝুঁকি ভাতার বিষয়টি বিবেচনা করা হচ্ছে। একই সঙ্গে তাদের আবাসনের ব্যবস্থাও করা হচ্ছে। তিনি বলেন, পরিচ্ছন্ন কর্মীরা চর্মরোগসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়। এ থেকে বাঁচতে তাদের গ্লাভস, বুট, ড্রেস এবং বৃষ্টির সময় রেইনকোর্ট দেয়া হয়। তারা যাতে এগুলো ব্যবহার করে সেজন্য কড়াভাবে তদারকিও করা হচ্ছে। তিনি বলেন, মহিলাদের প্রাকৃতিক কর্ম সম্পাদনের জন্য আগে তেমন ব্যবস্থা ছিল না। এখন দক্ষিণের ৫৭ ওয়ার্ডে একটি করে হাজিরা ঘর করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। এসব হাজিরা ঘরের প্রতিটিতে টয়লেট ব্যবস্থা রাখা হবে। ইতিমধ্যে নিউমার্কেট, আজিমপুরসহ কয়েকটি স্থানে এ ধরনের টয়লেট নির্মাণ করা হয়েছে। নারী কর্মীদের নিরাপত্তার বিষয়ে প্রতিটি থানা পুলিশের কাছে লিখিত আবেদন করা হয়েছে বলে তিনি জানান। মারা যাওয়া কর্মীদের এককালিন অনুদান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কিছুদিন টাকা দেয়া বন্ধ ছিল। তবে আবারো এটি চালু করা হচ্ছে। কোনো কর্মী মারা গেলে দাফন বাবদ সাত হাজার এবং অনুদান হিসেবে তার পরিবারকে আরো ৫০ হাজার টাকা দেয়া হয় বলে তিনি জানান।


পিএনএস/বাকিবিল্লাহ্



@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন