এবার ভাঙা হচ্ছে ঢাকার তিন'শ বছরের প্রাচীন শাহি মসজিদ

  18-01-2017 08:46AM


পিএনএস ডেস্ক: ঐতিহ্যবাহী মুঘল স্থাপত্যরীতিতে ১৭৪৬ সালে নির্মাণ করা হয়েছিল আজিমপুর শাহি মসজিদ। বাংলার শাসনভার তখন নবাব আলীবর্দী খানের হাতে। তার নির্দেশে ঢাকায় যে কয়েকটি মসজিদ নির্মাণ করা হয়, এটি সেগুলোর অন্যতম। প্রত্নতত্ত্ব আইন অনুযায়ী, ১০০ বছরের বেশি পুরনো যে কোনো ভবন ভাঙতে অনুমতি লাগবে। কিন্তু ২৭১ বছরের পুরনো হলেও আজিমপুর শাহি মসজিদ 'সংরক্ষিত পুরাকীর্তি' নয়। তাই ঐতিহাসিক প্রাচীন এ মসজিদ ভাঙতে এর কমিটিকে কোনো বেগ পেতে হচ্ছে না। আশির দশকে সম্প্রসারণের নামে এটির মূল ভবনের তিন দিকে স্থাপনা তোলা হয়। স্থাপনার ভিড়ে ঢাকা পড়ে যায় মসজিদটি, এমনকি এর গম্বুজটি।

তখন আড়ালে পড়লেও টিকে ছিল এগুলো। কিন্তু এবার পুরো মসজিদটি ভেঙে ছয়তলা ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে মসজিদ কমিটি। উন্নয়নের নামে ভেঙে ফেলা হচ্ছে এটি।

গত রোববার সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা যায়, মসজিদের উত্তর পাশের তাহসিল ভেঙে ফেলা হয়েছে। লাল পোড়া ইট, চুনমাটিতে মিশিয়ে এর দেয়াল ও ছাদ গেঁথে ছিলেন আলীবর্দী খাঁর কর্মীরা। সেগুলোও ভেঙে ধূলিসাৎ করা হয়েছে। এরপর স্থানীয় অধিবাসীদের প্রতিবাদের মুখে ভাঙার কাজ বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছে মসজিদ কমিটি। মসজিদের ভাঙা অংশে পাওয়া গেল তিন কিশোরকে। তারা বলল, 'এত প্রাচীন একটি মসজিদ ভেঙে ফেলা উচিত হচ্ছে না। আমাদের খুব খারাপ লাগছে এতে।' তারাই পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল মসজিদের অভ্যন্তরে। এর প্রাচীন স্থাপত্য সৌন্দর্য দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করে, বিস্মিত করে।

মসজিদ কমিটির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আবুল কাসেম মৃধা দাবি করেন, প্রত্নতত্ব অধিদপ্তরের অনুমতি নিয়েই ভাঙা হচ্ছে এটি। দাবির সপক্ষে তিনি প্রমাণও দেখান। তিনি বলেন, 'মসজিদের তিন দিকে ভবন উঠেছে। এখন এর সৌন্দর্য বাইরে থেকে দেখা যায় না, পুরনো ভবনটির আর সেই আকর্ষণ নেই।'

'প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর মসজিদটি ভাঙার অনুমতি দিয়েছে কি-না?'_এ প্রশ্নের উত্তরে অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আলতাফ হোসেন বলেন, 'আজিমপুর মসজিদ তালিকাভুক্ত সংরক্ষিত পুরাকীর্তি নয়, তাই অধিদপ্তর বাধা দিতে পারে না। তার পরও আমরা কমিটিকে ডেকেছি। তাদের অনুরোধ করব, ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনা করে তারা যেন মসজিদটি না ভাঙেন।' 'এটিকে কেন সংরক্ষিত তালিকাভুক্ত করা হয়নি?'_ এ প্রশ্নের জবাবে মহাপরিচালক বলেন, 'নানা কারণে সব ঐতিহাসিক স্থাপনাকে আমরা সংরক্ষিত ঘোষণা করতে পারছি না।'

পাথুরে ভিত্তির ওপর এ মসজিদের পাটাতন নির্মাণ করা হয়। তার ওপর বানানো হয় মূল মসজিদ। নিচতলায় দ্বিতীয়তলা ও ভারী গম্বুজের মূল ভিত। নিচতলায় মুঘল রীতিতে চতুর্কেন্দ্রিক খিলান ও ভল্টের সমন্বয়ে মোট আটটি কক্ষ রয়েছে। নিচতলাটি উত্তর ও দক্ষিণে দ্বিতীয় তলার চেয়ে বিস্তৃত। নিচতলার আট কক্ষের ওপর নির্মিত হয়েছে দ্বিতীয় তলা। দ্বিতীয় তলা এক কক্ষের। এটিই ছিল নামাজ আদায়ের স্থান। এর পূর্ব দিকে রয়েছে খিলানযুক্ত তিনটি প্রবেশপথ। দ্বিতীয় তলার পূর্ব দিকে ছিল স্বল্প পরিসরের একটি সাহান। উত্তরে দক্ষিণে ছিল সিঁড়ি। সিঁড়ির ওপর ছিল ছাদ। আজিমপুর মসজিদের মূল আকর্ষণ ছিল এর গম্বুজ। দ্বিতীয় তলায় নামাজ আদায়ের কক্ষের ছাদজুড়ে এ গম্বুজের অবস্থান।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রত্নপ্রত্ত্ব বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক নূরুল কবির বলেন, 'নামাজ ঘরে প্রাপ্ত শিলালিপি থেকে জানা গেছে, মসজিদটি ১৭৪৬ সালে নির্মিত। মুঘল যুগে ঢাকায় দ্বিতল বা তাহখানা যুক্ত মসজিদ নির্মাণের রীতি প্রথম প্রবর্তন করেন শায়েস্তা খাঁ। পরবর্তী সময়েও এ ধরনের স্থাপত্যরীতি বজায় থাকে। মুর্শিদ কুলি খান নির্মিত করতলব খান মসজিদ এবং পরবর্তী সময়কালে খান মোহাম্মদ মৃধা মসজিদ নির্মাণে এ রীতি বজায় থাকে।

আশির দশকে মসজিদের তিন দিকে স্থাপনা তুলে মাদ্রাসা নির্মাণ করা হয়। গম্বুজের তিন দিকেও গড়ে ওঠে স্থাপনা। এ কারণে বাইরে থেকে মসজিদের প্রকৃত অবয়ব বোঝা যায় না। গম্বুজে উঠে দেখা যায়, দক্ষিণে তিন-চার ফুট দূরেই শ্রেণিকক্ষ নির্মাণ করা হয়েছে। মাদ্রাসার একজন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, 'আমরাও চাই না এমন একটি পুরনো মসজিদ ভাঙা হোক। কিন্তু কমিটির সিদ্ধান্তের কারণে ছাত্র-শিক্ষক কেউ কিছু বলতে পারছে না।' তিনি বলেন, 'মসজিদের ঐতিহাসিকতা, গুরুত্ব ও সৌন্দর্য রক্ষা করতে হলে তিন দিকে নির্মাণ করা ভবনগুলোও অপসারণ করা উচিত।'

আসরের নামাজ আদায় করতে আসা স্থানীয় মুসলি্ল কাওসার আজম বলেন, 'সুস্থ মস্তিষ্কের কেউ এমন একটি প্রাচীন মসজিদ ভাঙতে পারে না। ঢাকায় শত শত ছয়তলা মসজিদ আছে। তিনশ' বছরের পুরনো মসজিদ আছে কয়টি?' তিনি জানান, জুমার নামাজের সময় ছাড়া অন্য সময়ে মুসলি্লর সংখ্যা মসজিদের ধারণক্ষমতার চেয়ে কমই থাকে। কাওসার আজম বলেন, 'জুমার হিসাব করলে ঢাকার সব মসজিদই ভেঙে বড় করতে হবে।' সূত্র: সমকাল

পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন