ঐতিহ্যবাহী বগুড়ার দই এখন বিশ্ববাজারে-যাচ্ছে সউদি আরব, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে

  22-11-2014 06:46PM

বছরে প্রায় তিন’শ কোটি টাকার দই বিক্রি হয়-রপ্তানীতে আসবে কয়েক হাজার কোটি টাকা

চীনে রপ্তানীর উজ্জ্বল সম্ভাবনা, অর্জিত হবে বিপুল পরিমান বৈদেশিক মুদ্রা


পিএনএস(আশরাফুল ইসলাম রতন), বগুড়া : বগুড়ার দই, ভোজন বিলাসীদের কাছে নিঃসন্দেহে একটি সুস্বাদু খাদ্য। রসনা তৃপ্তিতে অবদান রাখতে বগুড়ার চিনিপাতা দই এর জুড়ি নেই। বর্তমান বিশ্বের বহুদেশে বগুড়ার দই এর কদর সর্বজনস্বীকৃত। ঐতিহ্যবাহী বগুড়ার দই এখন বিশ্ববাজারে,যাচ্ছে সউদি আরব, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে। চীনে রপ্তানীর উজ্জ্বল সম্ভাবনা, অর্জিত হবে বিপুল পরিমান বৈদেশিক মুদ্রা।

রাজধানী ঢাকাসহ স্থানীয় বাজারে বছরে প্রায় তিন’শ কোটি টাকার দই বিক্রি হয়। সরকারি তত্বাবধানে রপ্তানীর উদ্যোগ নিলে ফি-বছরে হাজার হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব।

হিন্দু সম্প্রদায়ের মতে, রাধাকৃষ্ণ জন্মের পর তারা দুধ থেকে তৈরিকৃত এক ধরনের খাবার খেত, যাকে ঐ সময় দধি বলা হতো। এই দধি থেকেই কালক্রমে দই নামকরণ চলে এসেছে বলে পৌরাণিক ধারনা রয়েছে।
দই এর কয়েকটি প্রকার ভেদ রয়েছে। এসবের ভিতর টকদই, সাদাদই, চিনিপাতা দই এবং মিষ্টি দই প্রধান। এসব দই নানান পাত্রে বাজারজাত হয়ে থাকে। মাটির এসব পাত্র সরা, পাতিল, বারকী, কাপ, বাটি প্রভৃতি নামে পরিচিত।



বগুড়ার আনাচে কানাচে বাহারী নামে বগুড়ার দই বিক্রি কেন্দ্র রয়েছ্। তবে বগুড়ার জিরোপয়েন্ট সাতমাথা কেন্দ্রীক রয়েছে বেশির ভাগ দই এর দোকান। তবে জনশ্রুতি রয়েছে, আজকের জনপ্রিয় এই দই এর উৎপত্তি বগুড়া জেলার শেরপুর উপজেলা থেকে। মুলতঃ বগুড়ার দই মানেই শেরপুরের দই।

অনুসন্ধানে জানা যায়, বগুড়া দই এর ইতিহাস শতবর্ষ আগেকার। শেরপুর উপজেলায় এর উৎপত্তি হলেও বগুড়া সদরের দই এখন দেশ ছেড়ে বিশ্বেও স্বীকৃত। বিভিন্ন দেশে কেবল মাত্র বগুড়া থেকেই যে দই যায় তার কদর সবচেয়ে বেশি।

বগুড়ায় স্বাধীনতাপূর্ব দই এর উৎপত্তি শুরু করে চেলোপাড়ার কুড়ানু ঘোষ এবং শুটকা ঘোষ নামের হাতে গোনা কয়েকজন ঘোষ পরিবার। আস্তে আস্তে তাদের কাছে হাতে খড়ি হয় বাঘোপাড়ার রফাত, খান্দারের মহররম, নবাববাড়ি রোডের গৌর গোপালের।

এভাবে চলতে চলতে বগুড়ায় বর্তমানে দই দোকানের সংখ্যা প্রায় ৩ শতাধিক। তবে খ্যাতির শীর্ষে হাতে গোনা কয়েকটি দই দোকানের নাম বগুড়াবাসীর জানা থাকলেও অধিকাংশ দই দোকানের নাম অনেকেই জানে না।



স্বাধীনতার পূর্বে শেরপুরে নীলকন্ঠ ঘোষ, নারায়ন ঘোষ, সদানন্দ ঘোষ অর্থাৎ ঘোষ পরিবারের সদস্যদের হাতে প্রথম দই এর প্রচলন শুরু হয়। তখন টক দই এর প্রচলন ছিল বেশী। আস্তে আস্তে হিন্দু এবং মুসলমান পরিবারের অনেকে এই পেশায় সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে। পরবর্তীতে শেরপুরের সাউদিয়া, জলযোগ, বৈকালী, আলিবাব, সম্পা প্রভৃতি নামে দই এর দোকানের প্রসার লাভ ঘটে। এভাবেই আস্তে আস্তে বগুড়ায় প্রসার লাভ ঘটে দই এর বিস্তৃত বাজার।

স্থানীয় ভাবে যে প্যাকেট দই দেয়া হয় তা শীত কালে ৪ থেকে ৫ দিন, আর গরম কালে ২-৩ দিন ঠিক থাকে।

উত্তরাঞ্চলে কোনো বিদেশী বেড়াতে এলে তারা যাবার সময় এই দই নিয়ে যান। হাতে হাতেই এ দই পৌছে যায় বিভিন্ন দেশে। তবে বগুড়া থেকে এখনো দই রপ্তানী প্রক্রিয়া শুরু হয়নি বলে জানা যায়।
বর্তমানে বগুড়া শহরের চেলোপাড়ার কুড়ানু, নবাববাড়ির রুচিতা, কবি নজরুল ইসলাম সড়কের আকবরিয়া, বিআরটিসি মার্কেটের দই বাজার, মিষ্টি মহল, সাতমাথার চিনিপাতা, এশিয়া দই ,মহরম দই, দই ঘরসহ ২০ থেকে ২৫ টি স্টলে দই বিক্রি হচ্ছে। আবার শহরের বাইরে বাঘোপাড়ার রফাত, শেরপুরের রিপন দধি ভান্ডার, সৌদিয়া, জলযোগ, বৈকালী ও শুভ দধি ভান্ডার থেকে প্রতিদিন প্রচুর দই বিক্রি হয়।



স্পেশাল সরার দই এর দাম ১৬০ টাকা, সাধারন ৯০-১১০ টাকা ও সাদা দই ১০০ টাকা পিস হিসেবে বিক্রি হয়। এখানে দই এর চাহিদা প্রচুর। এছাড়া বাজারে কিছু কম দামে আরও বিভিন্ন ব্রান্ডের দই পাওয়া যায়। যার প্রতিটি বিক্রি হয় ৬০ থেকে ৮০ টাকা।

ছোট বড় বিভিন্ন আকৃতির মাটির পাত্রে দই ভরানো হয়। আগে কেজি হিসেবে দই বিক্রি হলেও এখন উপকরনের মূল্য বৃদ্ধির কারনে দই বিক্রি হয় প্রতি পিস হিসেবে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মানুষ বগুড়া এলে এখানকার দইয়ের স্বাদ না নিয়ে যেতে পারেন না। যাওয়ার সময় প্রিয়জনের জন্য নিয়ে যান বগুড়ার দই।

বগুড়ার দই দেশের সীমারেখা ছাড়িয়ে বিদেশেও ব্যাপক সমাদৃত হয়েছে। গুনে মানে স্বাদে বগুড়ার দইয়ের তুলনা হয় না। পরবাসীরা বগুড়ার দই নিয়ে ফিরে যান বিদেশে। বিদেশীরাও মুগ্ধ এ দইয়ের স্বাদে। বগুড়ার দই পৌছে যায় কানাডা, ফিলিপাইন, আমেরিকা, ইউরোপ, অষ্ট্রোলিয়াসহ বহু দেশে। সাধারন প্যাকেটই বিশেষ ভাবে সংরক্ষন করে এ দই পাঠানো হয় বিদেশে।

দই মিশে আছে বগুড়ার প্রানে প্রানে। বগুড়ার ঐতিহ্যবাহী দই একবার খেয়ে আবার খাওয়ার আগ্রহ দেখায়নি এমন লোক খুঁজে পাওয়া মুশকিল।

দেশের সব জেলাতেই কমবেশি দই তৈরি হয়। তবে মানে আর গুনে বগুড়ার দইএর তুলনা হয় না। আর ভোজ উৎসব আছে অথচ তালিকায় দই নেই এমন কেউই ভাবতে চাননা। হোক সে অতি দরিদ্র কিংবা শহরের অতি বিলাসী পরিবার। অতিথি আপ্যায়নে বগুড়ায় দইয়ের বিকল্প নেই।



বিদেশে বগুড়ার দইয়ের বিশাল বাজার তৈরির সম্ভাবনা থাকলেও শুধু সরকারের পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে তা সম্ভব হচ্ছে না। বগুড়ায় শতাধিক দোকানে প্রতিদিনি প্রায় ৩০ লাখ টাকার দই বেচাকেনা হয়। তবে কিছু অসাধূ ব্যবসায়ী দৌরাত্মের কারণে প্রকৃত ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসার পরিধি বাড়ানোর ঝুঁকি নিতে চান না। এ কারনে সম্ভাবনাময় এ শিল্পের প্রসার ঘটছে না।

গাভীর দুধ দিয়ে দই তৈরী হয়। এক হিসেবে জানা যায়, এক মণ দুধ দিয়ে ২৫/২৬ টি সরার দই তৈরী করা হয়। একটি সরার দই এর ওজন ৭০০ থেকে ৭৫০ গ্রাম। অভিযোগ রয়েছে, অনেকে ১মণ দুধ দিয়ে ৩৫/৩৬ টি দই তৈরী করে থাকে। এতে দই এর স্বাদ বা কোয়ালিটি রক্ষা করা যায় না। দুধের দাম বৃদ্ধির কারনে দই এর দামও আস্তে আস্তে বৃদ্ধি পেয়েছে।

২৫ বৎসর পূর্বে একটি দই এর দাম ছিল ৪০/৫০ টাকা। তা বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে ১০০ থেকে ১৬০ টাকা হলেও দই এর স্বাদ ক্রমান্নয়ে নীচের দিকে ধাবিত হচ্ছে। ভূঁইফোঁড় কিছু দই ব্যবসায়ী এবং বগুড়ায় দই এর ব্যবসা একটি সস্তা ব্যবসা হিসেবে পরিগণিত হওয়ায় বগুড়ায় দই এর ঐতিহ্য হুমকির মুখে পতিত হয়েছে। প্রকৃত ঘোষদের হাত থেকে দই এর ব্যবসা চলে এসেছে কিছু অব্যবসায়ীদের হাতে।



বি.এস.টি.আই এর অনুমোদনহীন এই সুস্বাদু খাবার দই, ভোজন পিয়াসীদের রসনাতৃপ্তি মিটালেও নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে এর তৈরী প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশাসনের কোন মাথা ব্যথা নেই। অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে এক প্রকার ক্ষতিকর রং মিশিয়ে দই তৈরী করা হচ্ছে। অতিরিক্ত লাভের আশায় দুধকে অল্প জ্বাল দিয়ে তৈরী হচ্ছে স্বাদহীন দই। ছোট ছোট কিছু দই দোকানদারদের নামে এমন স্বাদহীন দই এর বিক্রির অভিযোগ উঠলেও প্রতিষ্ঠিত বড় বড় দোকানগুলো প্রতিনিয়ত পাল্টাচ্ছে ব্যবসায়ীক কৌশল।

নানান নামে, নানান স্বাদে এবং নানান ভাবে উপস্থাপন করছে বগুড়া দই এর ঐতিহ্যকে। বিভিন্ন পেশা থেকে আশা এই দই ব্যবসাকে আকঁড়ে ধরার কারনে প্রকৃত হিন্দু সম্প্রদায়ের ঘোষরা এখন এই ব্যবসা থেকে বিচ্যুত। বগুড়ায় দই এর ব্যবসা সস্তা ব্যবসা হিসেবে লুফে নিয়েছে অনেকে। তাদের মধ্য ঠিকাদার, কসমেটিক দোকান ব্যবসয়ী, সাংস্কৃতিজন, বাস মালিক, হোঠেল মালিক থেকে শুরু করে মুদি দোকানদার, ফটোষ্ট্যাট ব্যবসায়ীরাও জড়িয়ে পড়েছে। ভূঁইফোঁর এসব মালিকদের কারনে স্বাভাবিক ভাবেই বগুড়ার দই এর স্বাদ ও ঐতিহ্য আজ বিলুপ্তির পথে। কিন্তু এই ঐতিহ্যকে ধরে রাখার ব্যপারে বগুড়ায় কারও কোন মাথা ব্যাথা নেই।

কোয়ালিটি রক্ষা করে বগুড়ার দই এর দেশীয় বাজারের সাথে সাথে আন্তর্জাতিক বাজার সৃষ্টি করতে পারলে এর মাধ্যমে বছরে বিপুল পরিমান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হওয়া সম্ভব।
অপ্রচলিত পণ্য হিসেবে বগুড়ার চিনিপাতা দই এর বাজার সৃষ্টি করতে সরকারের পৃষ্টপোষকতার সাথে দরকার প্রকৃত ঘোষ বা দই প্রস্তুতের কারিগর। আর এসবের সমন্বয় ঘটলে বগুড়ার দই এর সুস্বাদু খ্যাতির সাথে সংযুক্ত হবে নতুন মাত্রা, নতুন সম্মৃদ্ধি।


পিএনএস/দোজা/শাহাদাৎ

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন