ফাঁদ এড়িয়ে কৌশলে এগোতে চায় বিএনপি

  10-01-2017 08:29AM



পিএনএস: মন্ত্রীদের শত উসকানি সত্ত্বেও এ মুহূর্তে রাজপথের আন্দোলনে রাজি নন খালেদা জিয়া অযথা শক্তি ক্ষয় করবে না দল। অবস্থার পরিবর্তন হলে মাঠে নামবে তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সংঘাত এড়িয়ে চলার পরামর্শ দলের নেতাকর্মীদের সাংগঠনিক কাঠামো শক্তিশালী করার পাশাপাশি জনসংযোগ করার পরামর্শ।

রাজপথের উত্তপ্ত আন্দোলনে নামার বহুমুখী তাগিদ থাকলেও কৌশলগত নানা কারণে এখন সে পথ এড়িয়ে এগুতে চায় বিএনপি। এমনকি যে সব কর্মসূচিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কিংবা ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডারদের সঙ্গে মুখোমুখি হওয়ার শঙ্কা রয়েছে আগামীতে তা পরিহার করারও সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে সরকারবিরোধী সর্ববৃহৎ এ দলটি। নীতি-নির্ধারকদের শঙ্কা, রাজনৈতিক অঙ্গনে সংঘাত-সহিংসতা সৃষ্টি করে তার দায় বিএনপির ওপর চাপিয়ে দিয়ে আবারও নেতাকর্মীদের গণহারে ধরপাকড় ও মামলার জালে জড়াতে চায় সরকার। আর এরই ধারাবাহিকতায় ক্ষমতাসীনরা তাদের দীর্ঘদিন ধরে নানা উসকানি দিচ্ছে ।

বিএনপির শীর্ষ নেতাদের দাবি, শান্তিপূর্ণ বিভিন্ন কর্মসূচিতে হামলা এবং গত তিন বছরে তাদের বড় কোনো সভা-সমাবেশ করার অনুমতি না দেওয়াসহ নানা কর্মকাণ্ডে সরকারের অগণতান্ত্রিক স্বরূপ জনসম্মুখে উন্মোচিত হয়েছে। তাই বড় ধরনের কোনো আন্দোলনে না গিয়ে সাংগঠনিক কাঠামো শক্তিশালী করার পাশাপাশি জনসমর্থন অর্জনে দলীয় নেতাকর্মীরা সর্বোচ্চ তৎপর হলে তা আগামী সংসদ নির্বাচনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করেন তারা।

দলের উচ্চ পর্যায়ের একাধিক সূত্রে জানা গেছে, সরকারের মন্ত্রীদের শত উসকানিতেও এ মুহূর্তে খালেদা জিয়া রাজপথের আন্দোলনে নামতে রাজি নন। তিনি তাড়াহুড়া করে অগোছালোভাবে কিছু করতে চান না। তাই 'গণতন্ত্র হত্যা দিবস' উপলক্ষে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করার অনুমতি না পেলেও রোববার শুধু বিক্ষোভ কর্মসূচির মতো সাদামাটা কর্মসূচি দিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছে দলটি। এদিন সব মহানগর ও জেলা শহর এবং ঢাকার থানায় থানায় বিক্ষোভ মিছিলের কর্মসূচি পালন করার কথা থাকলেও সব ধরনের সহিংসতা এড়িয়ে চলতে আগাম পরামর্শ দেয়া হয়েছে। বিশেষ করে র্যাব-পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কোনো বাহিনীর সঙ্গে যাতে কোনো ধরনের সংঘর্ষ না বাধে দলের শীর্ষ নেতারা সে ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক করেছেন।

বিএনপির প্রথম সারির একজন নেতা বলেন, এ সতর্কাবস্থা কাটিয়ে কবে নাগাদ তারা সোচ্চার আন্দোলনে নামবে তা এখনও নির্ধারণ করা হয়নি। এজন্য যথোপযুক্ত সময়-সুযোগের অপেক্ষা করা হবে। ওই নেতার ভাষ্য, সরকারের ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পা দিয়ে অযথা এখুনি শক্তির অপচয় করা নেহাৎ বোকামি। তাই তারা সার্বিক অবস্থা পর্যালোচনায় রয়েছেন।

দায়িত্বশীল ওই নেতা আরও জানান, সরকারের আগ্রাসী ভূমিকার মুখে সর্বস্তরের নেতাকর্মীকে 'সেফ সাইডে' থাকার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। শুধুমাত্র এ অবস্থার পরিবর্তন হলেই তারা মাঠে নামবে।

এদিকে সরকারের নানামুখী নির্যাতনে কোণঠাসা হয়ে আত্মগোপনে কিংবা ধাওয়ার মুখে থাকা কর্মীরা যাতে হতাশাগ্রস্ত হয়ে না পড়ে সেদিকে নজর রাখতেও স্থানীয় পর্যায়ের নেতাদের নানা দিকনির্দেশনা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। জানা গেছে, এ ব্যাপারে বেশকিছু কৌশল নির্ধারণ করে শিগগিরই তা তৃণমূলে অবহিত করা হবে। এছাড়াও দলীয় কোন্দল যাতে কোনোভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে সেদিকেও কড়া নজর দেবে বিএনপি।

দলীয় হাইকমান্ডের ধারণা, নানা উসকানিতে উত্তাপ ছড়িয়ে রাজনৈতিক সংঘাত-সহিংসতা সৃষ্টিতে ব্যর্থ হলে ক্ষমতাসীনরা নানা প্রলোভন ও ভয়-ভীতিতে দলে ভাঙন ধরানোর চেষ্টা চালাবে। পাশাপাশি ভাড়াটে সন্ত্রাসীদের দিয়ে বেশকিছু নাশকতার ঘটনা ঘটিয়ে দলের সক্রিয় নেতাদের ফাঁসানোর ফন্দি আঁটারও শঙ্কা রয়েছে। তাই এ পরিস্থিতিতে যাতে নিজেদের নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে রাখা যায় তার পথ খুঁজছেন তারা।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো আরও জানায়, সরকার বিএনপিকে আগামী আন্দোলন এবং নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে দলের সিনিয়র নেতাদের নামে একের পর এক মামলার অভিযোগ গঠন শুরু করে। কিন্তু এতেও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নিশ্চিন্ত হতে না পারায় জামায়াতকে এককভাবে রাজপথে নামানোর প্রচেষ্টা চালায়। আর এর অংশ হিসেবে ত্বরিতগতিতে অনেক দিনের ঝিমানো মামলাগুলোকে একসঙ্গে সচল করে একের পর এক রায় দেয়া হয়। এর প্রতিবাদে অন্য সময়ে জামায়াত লাগাতার হরতাল কর্মসূচি পালন করলেও নেতাকর্মীরা সক্রিয়ভাবে রাজপথে নামেনি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির প্রথম সারির একজন নেতা জানান, রাষ্ট্রপতির সংলাপে রাজনৈতিক সঙ্কট কেটে যাবে_ এমন আশা তারা কখনও করেনি। তবে এরপরও তারা 'সংলাপ' প্রক্রিয়ায় পুরোপুরি সায় দিয়ে তা এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেছেন।

প্রবীণ ওই নেতার দাবি, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তথা সরকার যে কায়দায় বিরোধী গোষ্ঠীকে দীর্ঘদিন করে কোণঠাসা করে রেখেছে, তা হয়তো আর বেশি দীর্ঘায়িত করা সম্ভব হবে না। বরং নানামুখী চাপে সরকারকে সহসাই নমনীয় মনোভাব দেখাতে হবে। আর বিএনপি এ সময়ের জন্যই অপেক্ষা করবে।

এদিকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর সরকার মূলত বেকায়দা পরিস্থিতিতে রয়েছে। মধ্যবর্তী নির্বাচনের জন্য জাতিসংঘ থেকে শুরু করে প্রত্যেকটি বন্ধু রাষ্ট্র নানাভাবে চাপও দিয়েছে। এছাড়াও জনমত জরিপে সরকারের অবস্থান তলানিতে রয়েছে বুঝতে পেরে দলটি এখন নানা অপকৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে। এর ধারাবাহিকতায় তারা জামায়াতকে রাজপথে আন্দোলনে নামানোর চেষ্টা করেছে। অন্যদিকে সরকারের এ কৌশলের অংশ হিসেবে পার্শ্ববর্তী একটি দেশের গণমাধ্যমে প্রতিনিয়ত জঙ্গিসংক্রান্ত সংবাদ পরিবেশন করে বহির্বিশ্বকে বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি সতর্কবার্তা পেঁৗছে দেয়ার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে বলেও তারা মনে করেন।

বিএনপি নেতারা জানান, সরকারের এ কৌশল বুঝতে পেরে দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারকরা রাজপথে সহিংস আন্দোলন থেকে কর্মীদের নিবৃত করেন।

এদিকে যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীদের সঙ্গে বিএনপির নেতাকর্মীদের মাঠপর্যায়ে যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে তা সাময়িক বলে মনে করেন দলীয় হাইকমান্ড। তাদের মতে, আন্দোলনের মাঠে এর কোনো বিরূপ প্রভাব পড়বে না। সময় সুযোগ বুঝে বিএনপি রাজপথে নামলে জামায়াত-শিবির তাতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করবে।

বিএনপির দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র জানায়, সরকারের কূট কৌশলের অংশ হিসেবে জোটের মধ্যে অবিশ্বাসের ধারা চালু করার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু দলের চেয়ারপারসনের প্রচেষ্টায় সেই কৌশল বাস্তবায়নে সরকার ব্যর্থ হয়েছে। তাই এখন দেশে জঙ্গিবাদের ধুয়ো তুলে বহির্বিশ্বকে নিজের পক্ষে টানার চেষ্টা করছে। যদিও তাদের সে প্রচেষ্টা এরই মধ্যে অনেকটা ব্যর্থ হয়েছে। বরং দেশি বিদেশি অনেক সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে আটককৃত বেশকিছু যুবককে দীর্ঘদিন আগে আটক করে এখন জঙ্গি হিসেবে গ্রেপ্তার দেখানো হচ্ছে। অথচ গ্রেপ্তারের আগে ওইসব পরিবারের সদস্যরা থানা পুলিশের কাছে নিখোঁজ ব্যক্তির সন্ধান চেয়ে জিডিও করেছিলেন। এছাড়া এ দেশের মানুষ ধর্মভীরু, কিন্তু কট্টরপন্থী নয়। সুতরাং তাদের এই কৌশলও ব্যর্থ হয়েছে।

বিএনপির দলীয় সূত্র জানায়, দেশ-বিদেশের পুরোসমর্থন নিয়ে তবেই মাঠে নামতে চান দলের নীতিনির্ধারকরা। সেই সময়টার জন্য অপেক্ষা করছেন তারা। কারণ হিসেবে তারা মনে করছেন, ক্ষমতা এখন নাগালের কাছাকাছি। তাই তাড়াহুড়া না করে পরিকল্পনা মাফিক মাঠ গোছাতে চাইছে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট।

আগামী আন্দোলন ও সরকারের কৌশল সম্পর্কে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, 'আন্দোলনের জন্য কোনো টাইম ফ্রেম থাকে না। তবে জনগণের ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে গেলে আন্দোলন এমনিতেই হবে। বিএনপি এখন সে সময়েরই অপেক্ষা করছে।'

দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, একের পর এক গণতান্ত্রিক কর্মসূচির অনুমতি না দিয়ে এবং অনেক কর্মসূচিতে বাধা দেয়ার মাধ্যমে উসকানি দিয়ে সরকার বিএনপিকে সংঘাতের দিকে ঠেলে দিতে চাইছে। তবে বিএনপি সংঘাতের রাজনীতিতে বিশ্বাস করে না। বিএনপি ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতা পরিবর্তনে বিশ্বাস করে। তাহলে অনুমতি না পেলে বিএনপি কি কোনো কর্মসূচিই পালন করবে না_ এমন প্রশ্নের জবাবে ফখরুল ইসলাম বলেন, 'তা সময়ই বলে দেবে।'

এদিকে বিএনপির মাঠপর্যায়ের নেতারা মনে করেন, বিএনপির ব্যাপারে সরকারের কঠোর অবস্থানের দীর্ঘদিনে কোনো পরিবর্তন হয়নি এবং ভবিষ্যতেও আর তা হবে না। বরং সরকার এ ব্যাপারে আরও কঠোর হবে।

আলাপকালে দলটির নেতারা বলছেন, এখন সে অর্থে বিএনপির কোনো কর্মসূচি নেই। তবু তাদের দিবসভিত্তিক কর্মসূচিও পালন করতে দেয়া হচ্ছে না। সরকার বিএনপিকে আবারও সহিংসতার দিকে নিয়ে যেতে চাইছে।

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মো. শাহজাহান বলেন, বিএনপি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় থাকতে চায়। অথচ সরকারের আচরণে কোনো নমনীয়তা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। ৫ জানুয়ারি বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে আচরণ, ওইদিন দেশের বিভিন্ন জায়গায় কর্মসূচিতে বাধা দেয়া, ৭ জানুয়ারি সমাবেশ করতে না দেয়া_ এসবের মাধ্যমে বোঝা যায়, বিএনপি যতই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় থাকতে চাক না কেন, সরকার স্বৈরাচারী আচরণ করেই যাবে। যেহেতু এই সরকার স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় বিশ্বাস রাখছে না, তাই সবার মতামতের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন গঠন, নির্বাচনকালীন সরকার গঠন বা সুষ্ঠু নির্বাচন আশা করা যায় না।

তবে এতে প্রকারান্তরে সরকারই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দাবি করে বিএনপি নেতারা বলেন, সরকারের কর্তৃত্ববাদী চরিত্র মানুষের কাছে আরও বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠছে। বিএনপি যে সরকারকে ফ্যাসিবাদী বলে আসছে, তা প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে।

পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন