আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতাদের ক্ষোভ

  15-02-2017 12:12AM

পিএনএস: দলীয় অভ্যন্তরীণ কোন্দল, ত্যাগী নেতাদের মূল্যায়ন না করা, হাইব্রিডদের দলে জায়গা করে দেওয়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সিনিয়র নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগসহ দীর্ঘদিনের ক্ষোভ প্রকাশ করলেন ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতারা।

আজ মঙ্গলবার বিকেলে রাজধানীর ধানমণ্ডির একটি কমিউনিটি সেন্টারে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের যৌথ সভায় দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের উপস্থিতিতে দলের সিনিয়র নেতাদের একহাত নেন তৃণমূল নেতারা।

সভায় সাভার উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আলী হায়দার বলেন, ‘আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সাভার থেকে যাকে নমিনেশন (মনোনয়ন) দেওয়া হবে, আমরা তাঁর জন্য কাজ করব। তবে যাকে মনোনয়ন দেওয়া হবে তাঁর নাম এক বছর আগে ঘোষণা দেওয়া হলে, তাঁর নেতৃত্বে দলে ছোটখাটো যেসব ভুলত্রুটি রয়েছে তা সমাধান করে আমরা ঐক্যবদ্ধ হতে পারব।’

এ সময় উপস্থিত কেন্দ্রীয় নেতাদের উদ্দেশে আলী হায়দার বলেন, ‘আপনারা সাভার উপজেলায় আসেন। আমরা মিটিং ডাকি, আপনারা আমাদের কথা শুনবেন, আমরাও আপনাদের কথা শুনব। দলের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কিছু কোন্দল রয়েছে, যা সংশোধন করে সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করব।’

আলী হায়দার আরো বলেন, ‘আমি বিগত দুই বার উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। কিন্তু আমার উপজেলায় কে ছাত্রলীগ, যুবলীগ এবং সহযোগী সংগঠনের দায়িত্বে তা জানি না কিংবা শুনি নাই। কয়েকদিন পরপর এলাকায় যুবলীগ, ছাত্রলীগের সভাপতি, সেক্রেটারির পোস্টার লাগানো হয়, এটা কীভাবে সম্ভব?’

ধামরাই উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত হোসেন সাকু বলেন, ‘১৯৭৩ সালের নির্বাচনী জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ধামরাই উপজেলাকে উত্তর পাকিস্তান উল্লেখ করেছিলেন। সেই উত্তর পাকিস্তানকে ১৯৭৫ সালের পর ধীরে ধীরে বেনজির আহমেদসহ (বর্তমান জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি) আমরা আওয়ামী লীগ, অঙ্গ-সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনকে সংগঠিত করে তিন-চারবার নির্বাচনের পর ২০০৮ সালে বেনজির আহমেদ সংসদ সদস্য নির্বাচিত করতে পেরেছি। এরপর ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে এম এ মালেক সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। নির্বাচিত হওয়ার পর কয়েক মাস বেনজির ও মালেক ভাই একসঙ্গে দলীয় প্রোগ্রাম করেছিল। কিন্তু হঠাৎ করে দুজন দুই প্রান্তে চলে গেল। এর কারণ আমরা বুঝতে পারলাম না। এ নিয়ে আমরা হতাশায় ভুগছি।’

সাখাওয়াত হোসেন আরো বলেন, ‘ধামরাই উপজেলায় আওয়ামী লীগসহ সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের অবস্থান আগের মতো নেই। দীর্ঘ ১২ বছর উপজেলা যুবলীগের সম্মেলন হয় না, আর ছাত্রলীগের সম্মেলন হয় না ১৪ বছর। দুই নেতার কারণেই কি এটা হচ্ছে না? না আমাদের কারণে? সেটা আমরা জানি না। সংগঠন যদি ঐক্যবদ্ধ না হয়, তাহলে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন কঠিন হয়ে যাবে।’

জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বেনজির আহমেদকে উদ্দেশ করে সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘আপনি (বেনজির আহমেদ) আমাদের সংগঠনের মুরুব্বি। আপনি কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে গ্রুপিং নিরসনের চেষ্টা করুন। অনেক হাইব্রিড মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার চেষ্টা করছে। ঘরে ঘরে চুক্তি হচ্ছে। সেই চুক্তি থেকে বিরত থেকে আপনারা সঠিক মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই করুন।’

সাভার উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হাসিনা দৌলা বলেন, ‘আমরা দীর্ঘদিন ধরেই রাজনীতি করছি। রাজনীতির জন্য শ্রম, ঘাম ও অর্থ ব্যয় করলাম। কিন্তু হঠাৎ করেই আপনারা (কেন্দ্রীয় নেতা) অন্য কাউকে সংসদ সদস্য বানিয়ে দেন। কিন্তু কেন? আমাদের মতো মানুষদের কি আপনারা চোখে দেখেন না? আমরা কি যোগ্যতার সঙ্গে রাজনীতি করি নাই?

হাসিনা দৌলা বলেন, ‘আমাকে দিয়ে সব কাজ করিয়েছেন। আর হঠাৎ করে মুরাদ জংকে এমপি (২০০৮ সালের নির্বাচন) বানিয়ে দিলেন। মেনে নিলাম। মুরাদ জংকে সংসদ সদস্য বানানোর পর আমি পাঁচ বছর কর্নারড (কোণঠাসা) হয়ে রইলাম। এরপর আবার বানালেন এনামুর রহমানকে, যাকে আমরা চিনি না, জানি না।’

তৃণমূলের এই নেতা আরো বলেন, ‘আপনারা কি জানেন, তিনি (এনামুর রহমান) কোন সংগঠন করেছেন। আমাদের মতো মানুষকে যদি তাদের মেনে নিতে বলেন, তার আগে আমাদের গুলি করে মেরে ফেলেন, তারপর যেন এসব লোক এমপি হয়।’ তিনি বলেন, ‘আগামীতে এমপি পদে মনোনয়ন দেওয়ার আগে ভেবেচিন্তে দেবেন। আমরা যারা বৃদ্ধ হয়ে গেছি, আমাদের মনে কষ্ট দিয়েন না। কষ্ট দেওয়ার অধিকার আপনাদের নেই। আমরা বিরোধী দলে থাকতে অনেক কষ্ট করেছি। টিয়ার গ্যাস, মার খেয়েছি, মুখের রং পুড়িয়েছি। কিন্তু কোনো সুফল পেয়েছি? আমরা সংগঠনকে শক্তিশালী করতে চাই। যদি না করতে পারি, আমাদের বহিষ্কার করে দেন।’

সভায় ধামরাই পৌরসভার মেয়র গোলাম কবির বলেন, ‘ধামরাই আওয়ামী লীগে আগে দ্বন্দ্ব ছিল না। কিন্তু এখন অনেক দ্বন্দ্ব দেখা যাচ্ছে। এ দ্বন্দ্ব মিটিয়ে ফেললে আগামী নির্বাচনেও বিপুল ভোটে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বিজয়ী হবে।’

দোহার উপজেলার চেয়ারম্যান আলমগীর হোসেন বলেন, ‘আওয়ামী লীগের বর্তমান সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুল মান্নান সাহেব যখন মন্ত্রী ছিলেন তখন তাঁর কথামতো সংগঠন চলত, নেতারা পদ-পদবি পেত। আবার যখন মান্নান ভাই সাংসদ হলেন না, তখন জেলার সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুর রহমানের পছন্দমতো নেতাকর্মীরা দলে পদ পেয়েছেন; যা খুবই স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু আগের কমিটি বিলুপ্ত করে নতুন কমিটি করা হয়েছে। যদি এ কমিটিগুলো দলীয় গঠনতন্ত্র মেনে করা হয়, তাতে দল শক্তিশালী হবে। আগামী নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী বিজয়ী হবে।’

সভায় বক্তব্যে ধামরাই উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সংসদ সদস্য এম এ মালেক বলেন, ‘ধামরাই উপজেলা আওয়ামী লীগে বিভেদ আছে, তা সত্য। কী কারণে এ বিভেদ তা আমি বলতে চাই। উপজেলা নির্বাচনের প্রার্থী নির্বাচনের জন্য আমি যৌথ সভা ডাকি। যাতে কয়েকজন প্রার্থীও হলো। তখন সবাই বলল বেনজির আহমেদ ও আমি যাকে বলব তিনিই প্রার্থী হবেন।

আমি বললাম না বেনজির ভাই যাকে বললেন, তিনিই প্রার্থী হবেন। কয়েকদিন পরে বেনজির ভাই বললেন তৃণমূলের ভোটে প্রার্থী বাচাই হবে। এতে আওয়ামী লীগ খণ্ডিত হলো। শুধু দ্বিখণ্ডিত না চার ভাগের তিন ভাগ একদিকে, আরেক ভাগ অন্যদিকে।’ তিনি বলেন, ‘তৃণমূলের নির্বাচনে আমি যাকে সমর্থন করলাম তিনি পেলেন ২৫২ ভোট। আর বেনজির ভাই যাঁকে সমর্থন করলেন তিনি পেলেন ১১৪ ভোট। যাতে প্রমাণিত হলো মানুষ বেনজির সাহেবের সঙ্গে নেই। এতেই দূরত্ব সৃষ্টি হলো।’

এ সময় মঞ্চ থেকে বেনজির আহমেদ এসব কথা বলতে নিষেধ করেন। তখন এম এ মালেক বলেন, ‘এগুলো না বললে তো মানুষ বুঝবে না। এরপর তৎকালীন ঢাকা বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন আমাকে ফোন দিয়ে বলেন, ওপর থেকে প্রার্থী পরিবর্তন করা হয়েছে। পরের দিন নেত্রীর সঙ্গে আমি দেখা করেছি। তিনি আমাকে বললেন, না আমি পরিবর্তন করি নাই।’

এম এ মালেক আরো বলেন, ‘আমি যখন থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রার্থী হয়েছি, তাকে নিষ্কণ্টক করার জন্য বেনজির সাহেবের বাসভবনে বৈঠকও করেছি। কিন্তু তিনি বহুভাবে চেষ্টা করেছেন আমি যাতে সভাপতি না হতে পারি। কিন্তু কর্মীরা আমার পক্ষে। এরপর আবার তাঁর বাসায় বৈঠক করেছি তখন তিনি (বেনজির) বলেছেন, তুমি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় হতে পারো। এ জন্য তুমি আবুলকে ২০ লাখ টাকা দিয়ে দাও। তখন আমি বললাম, আমার কাছে তো এত টাকা নাই। তখন তিনি বললেন তাহলে ১০ লাখ টাকা দাও। তখন আমি চেকের মাধ্যমে ১০ লাখ টাকা দিয়েছি।’ এ সময় সভায় হট্টগোল সৃষ্টি হয়।

এ সময় এম এ মালেক বলেন, ‘আমার কথা শেষ হলে তিনি কথা বলবেন (বেনজির)। এরপর পৌরসভা নির্বাচন হয়েছে। সেখানে তাঁর (বেনজির) প্রার্থী আমার প্রার্থীর কাছে নমিনেশনে হেরে যান। এরপরও তিনি বিরোধিতা করেন। কিন্তু আমি আমার প্রার্থীকে পাস করিয়ে আনি।’

তিনি বলেন, যত জায়গায় নির্বাচন হয়, তাঁর (বেনজির) প্রার্থী পরাজিত হয়। ফলে তাঁর সঙ্গে তৃণমূলের দূরত্ব সৃষ্টি হয়। এখানে আমি কিছু করি নাই।’

এম এ মালেক অভিযোগ করে বলেন, ‘আমি আর বেনজির সাহেব একসঙ্গে মুক্তিযদ্ধে গিয়েছি, ট্রেনিং করেছি, খেয়েছি এবং যুদ্ধ করেছি। আর এখন মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাচাই কমিটির সভাপতি বেনজির আহমেদ এবং সাধারণ সম্পাদক সাকু। তাঁরা এখন মুক্তিযোদ্ধার তালিকা থেকে আমার নামটা কেটে দিয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধা সংসদের তালিকা আমার কাছেও আছে।’

এ সময় এম এ মালেককে বিষয়টি বলতে নিষেধ করা হয় মঞ্চ থেকে। কিন্তু তিনি কথা বলতে চেষ্টা করেন। এরপর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের তাঁকে মাইক থেকে সরিয়ে দেন।

ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘এত ঝগড়া কেন? এত বাদানুবাদ কেন? একই পরিবারে কাজ করতে গিয়ে মতবিরোধ হয়। তার সমাধানও হয়। কিন্তু ঘরের ভেতর ঘর কেন? ঘরের ভেতর ঘর সহ্য করা হবে না। আপন ঘরে শত্রু হলে, বাইরে শত্রুর দরকার আছে? আপন ঘরে শত্রু তৈরি করবেন না। কেউ জনগণ ও দলের ক্ষতি হয়ে দাঁড়ালে এর পরিণতি কী হয়, তার প্রমাণ অতিসম্প্রতি সিরাগঞ্জে এবং ঢাকা কলেজে নেতৃবৃন্দদের পরিণতি।

ওবায়দুল কাদের আরো বলেন, ‘কেউ প্রার্থী হতে পারবে না। প্রার্থী হবে নৌকা। ইতিমধ্যে কয়েক দফা যাচাই বাচাই হয়েছে। হতে থাকবে এবং সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যক্তিকে মনোনয়ন দেওয়া হবে। জনবিচ্ছিন্ন নেতাকে মনোনয়ন দেওয়া হবে না।’

সভায় ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বেনজির আহমেদ বলেন, ‘কাদা ছড়াবেন না। ছড়ালে সবার গায়েই লাগবে। সাংগঠনিক ডিসিপ্লিন মেনে চলুন। কেউই ধুয়া তুলসি পাতা না। ইট মারলে পাটকেল খেতে হয়। সময়-সুযোগমতো শ্বেতপত্র প্রকাশ হতে পারে। তিন বছরের যে কীর্তিকলাপ আছে তা প্রকাশ হতে পারে।’


পিএনএস/বাকিবিল্লাহ্

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন