সাঁওতালদের মাছের দাবি

  06-12-2016 03:44PM

পিএনএস, গাইবান্ধাঃ গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের রংপুর চিনিকলের (রচিক) সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খামারে চাষ করা ধান বুঝে পাওয়ার পর এখন পুকুরের মাছের দাবি করেছেন সাঁওতালরা। তবে রচিক কর্তৃপক্ষ এ দাবি নাকচ করে দিয়ে বলেন, সাঁওতালরা পুকুরে মাছ চাষ করেনি।

সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খামারের ১৩৫ একর জমিতে চাষ করা প্রায় ১ হাজার মণ আমন ধান মেশিন দিয়ে কেটে মাড়াইয়ের পর সাঁওতালদের কাছে বুঝিয়ে দিয়েছে মিল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু ওই খামারের পাঁচটি পুকুরে সাঁওতালদের চাষ করা মাছ এখনও তাদের বুঝিয়ে দেওয়া হয়নি। খামারের বসতভূমি থেকে সম্প্রতি উচ্ছেদ হওয়া সাঁওতালরা প্রশ্ন তুলেছেন, এখন ওই মাছের কী হবে?

উপজেলার মাদারপুর গ্রামের সাঁওতাল সর্দার ভবেন মার্ডী বলেন, ধানগুলো নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় শুকানো হচ্ছে। এসব ধান যেহেতু যৌথভাবে চাষ করা হয়েছে সেজন্য কমিটির সভায় আলোচনা করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

তিনি আরও বলেন, ধান তো পেলাম কিন্তু এখন পর্যন্ত মাছ তো পেলাম না। খামারের পাঁচটি পুকুরে আমাদের চাষ করা বিভিন্ন প্রজাতির মাছগুলোর কী হবে? চিনিকল কর্তৃপক্ষ তো ওই মাছ বুঝিয়ে দেওয়ার বিষয়ে কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। এছাড়া সরিষা, কলাই, শাক-সবজিসহ অন্যান্য ফসল, যা চিনিকল কতৃপক্ষ ট্রাক্টর দিয়ে গুড়িয়ে দিয়েছে। তার ক্ষতিপূরণ কে দেবে?

রংপুর চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আব্দুল আউয়াল দাবি করেন বলেন, সাঁওতাল সম্প্রদায়ের লোকজন ওই পাঁচ পুকুরে কোনও মাছ চাষ করেনি। মিল কর্তৃপক্ষই পুকুরে মাছ চাষ করেছে। এছাড়া উচ্ছেদের পর খামারের কোনও জমিতে পাট, সরিষা, কলাই ও শাক-সবজিসহ অন্য কোনও ফসলের চিহ্ন ছিল না।

তিনি আরও জানান, সাঁওতালদের চাষ করা সম্পূর্ণ জমির ধান কাটা শেষ। ধানগুলো সাঁওতালদের বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন ওই জমিতে আখ লাগানোর কাজ চলছে।

উল্লেখ্য, ১৯৬২ সালে গোবিন্দগঞ্জের ওই এলাকায় সাঁওতাল ও বাঙালিদের ১৮টি গ্রামের এক হাজার ৮৪০ দশমিক ৩০ একর জমি অধিগ্রহণ করে রংপুর চিনিকল কর্তৃপক্ষ। সম্প্রতি চিনিকল কর্তৃপক্ষ ওইসব জমি লিজ দিলে তাতে ধান-পাটসহ বিভিন্ন ফসলের চাষ করা হয়। এ কারণে চিনিকলের বিরুদ্ধে অধিগ্রহণের চুক্তি ভঙ্গের অভিযোগ এনে দুই বছর আগে থেকে সাঁওতাল ও স্থানীয় বাঙালি জনগণের একাংশ জমি ফেরত পেতে আন্দোলন শুরু করে।

এক পর্যায়ে তারা চলতি বছরের ১ জুলাই ওই ইক্ষু খামারে বসতি স্থাপন করে একশ একর জমিতে ধান এবং আটশ একর জমিতে মাস কালাই, সরিষা ও পাট এবং পাঁচটি পুকুরে মাছ চাষ করে। বাকি জমিতে ছিল মিলের ইক্ষু ক্ষেত।

গত ৬ নভেম্বর রংপুর চিনিকলের ওই খামারের জমিতে আখ কাটাকে কেন্দ্র করে চিনিকল শ্রমিক-কর্মচারিদের সঙ্গে সাঁওতালদের সংঘর্ষ হয়। এতে শ্যামল হেমরম, মঙ্গল টুডু ও রোমেশ মার্ডী নামে তিনজন সাঁওতাল মারা যান। গুলিবিদ্ধ হন চারজন। নয় পুলিশ সদস্য তীরবিদ্ধ হন। এছাড়া উভয় পক্ষের কমপক্ষে ২০ জন আহত হন।

পরে অভিযান চালিয়ে সাঁওতালদের ওই জমির বসতি থেকে উচ্ছেদ করা হয়। সে সময় তাদের বসত-ঘরগুলো আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। ফলে আশ্রয়হীন হয়ে পরে শত শত সাঁওতাল পরিবার। ওই পরিবারগুলোর কেউ কেউ খামারের পাশে সাঁওতাল পল্লী মাদারপুর গির্জার সামনের ও জয়পুর গ্রামের একটি ইউক্লিপটার্স গাছের বাগানের মধ্যে কলাগাছের পাতা দিয়ে ছোট্ট ছোট্ট কুঠুরি বানিয়ে, আবার কেউ কেউ ত্রাণে পাওয়া তাঁবু টানিয়ে কোনও রকমে ঠাঁই নিয়ে আছেন।

অনেকে থাকছেন পরিত্যক্ত স্কুলঘরে খড় বিছিয়ে। ঘটনার দিনই গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগীসহ বিভিন্ন গৃহস্থালী দ্রব্যাদি ও তাদের চাষ করা আটশ একর জমির মাস কালাই, সরিষা ও পাটের একাংশ লুট হয়। মিল কতৃপক্ষ বাকি সরিষা, মাস কলাই, শাক-সবজি ও অন্য ফসল ট্রাক্টর দিয়ে জমিতে মিশিয়ে দেয় বলে অভিযোগ রয়েছে।

পরবর্তীতে, এক রিট আবেদনের শুনানি শেষে গত ১১ নভেম্বর বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথের হাইকোর্ট বেঞ্চ ওই জমিতে সাঁওতালদের চাষের ধান তাদের কাটতে দিতে অথবা চিনিকল কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় প্রশাসন ধান কেটে সাঁওতালদের বুঝিয়ে দিতে নির্দেশ দেন।

সেই মোতাবেক চিনিকল কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় প্রশাসন ওই ধান কেটে মাড়াইয়ের পর ধান দুই দফায় সাঁওতালদের বুঝিয়ে দেয়। প্রথম দফায় গত ২৪ নভেম্বর থেকে ২৮ নভেম্বর পর্যন্ত দেওয়া হয় ৩৯৭ বস্তা। দ্বিতীয় দফায় গত ৩ ডিসেম্বর দেওয়া হয় ১৫৩ বস্তা। কিছু জমির ধান না পাকায় মাঝে এই কয়েকদিন ধান কাটা বন্ধ ছিল। এতে মোট ধানের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক হাজার একশ’ মণ।

৬ নভেম্বরের সহিংস ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে ঘটনার দিন রাতেই ৩৮ জনের নাম উল্লেখ করে সাড়ে তিনশ’ জনকে অজ্ঞাত পরিচয়ে আসামি দেখিয়ে মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় পুলিশ চারজন সাঁওতালকে গ্রেফতার করে আদালতের মাধ্যমে গাইবান্ধা জেলা কারাগারে পাঠায়। পরে তারা অন্তবর্তীকালিন জামিনে মুক্ত হন।

অপরদিকে সাঁওতাল পল্লীতে হামলা, অগ্নিসংযোগ, লুট ও উচ্ছেদ ঘটনায় গত ১৬ নভেম্বর স্বপন মুরমু নামে এক আদিবাসী বাদী হয়ে ৬শ’ জনকে অজ্ঞাত আসামি দেখিয়ে সাঁওতালদের পক্ষে মামলা করেন। এ মামলায় সন্দেহভাজন ২১ জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তারা এখন জেলা কারাগারে রয়েছেন।
এরপর গত ২৬ নভেম্বর দুপুরে সাঁওতালদের পক্ষে থোমাস হেমরম বাদী হয়ে থানায় আরেকটি মামলা দেন। এতে স্থানীয় এমপি, ইউএনও ও ইউপি চেয়ারম্যানসহ ৩৩ জনের নাম উল্লেখ করে এবং ৫/৬শ’ জনকে অজ্ঞাত পরিচয়ে আসামি করা হয়েছে। গোবিন্দগঞ্জ থানার ওসি সুব্রত কুমার সরকার বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, মামলাটি নিরপেক্ষ ভাবে তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।

পিএনএস/মো: শ্যামল ইসলাম রাসেল

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন