শৈলকুপার অতিথি পাখিরা যেন গ্রামীন পরিবারেরই সদস্য

  07-11-2014 06:01PM

পিএনএস,(জাহিদুর রহমান) ঝিনাইদহ : শৈলকুপা উপজেলার ছায়াঘেরা সবুজ গ্রাম আশুরহাট। এই সবুজ গ্রামেই আশ্রয় খুঁজে নিয়েছে এক ঝাঁক এশিয়ান শামুকখোলা পাখি। স্থানীয়ভাবে শামুকভাঙ্গা এবং শামখোলা নামেই এরা পরিচিত। মাটির কাছাকাছি সবুজ প্রকৃতির সংস্পর্শে থাকা এ গ্রামের মানুষও প্রকৃতি প্রেমের এক নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। প্রায় সাত বছর আগে শামখোল পাখির আনা-গোনা শুরু হয় এ গ্রামে। শুরুতে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি এসে সারাদিন থেকে সন্ধ্যায় ফিরে যেতো।
তবে গত দু’ বছর ধরে শামখোলা পাখি এখন গ্রামের অংশ হয়ে গেছে। আলাপ হয় গ্রামের মধ্যপাড়ার আব্দুর রাজ্জাক ও গোপাল চন্দ্র বিশ্বাসের সঙ্গে। তাদের পুকুর পাড়ে শিমুল-জাম-মেহগনী গাছের মগ ডালে বাসা বেঁধেছে শত শত পাখি। আব্দুর রাজ্জাক জানান, জুলাই-আগস্ট মাসে বাসায় ডিম দিতে শুরু করে শামখোলা। আমাদের গ্রামে প্রতিটি বাসায় ছানা দেখা যাচ্ছে। নতুন অতিথিদের আগমনে যেন উৎকণ্ঠার শেষ নেই গ্রামবাসীরও। কথা হয় দিলিপ কুমারের সঙ্গে। তিনি বলেন, গ্রামের মানুষ পাখিদের এতটা ভালবেসেছে যে ধান হ্মেত নষ্ট করলেও কষ্ট পান না।



উদাহারণ টেনে তিনি বলেন, কিছু দিন আগে মজনু মিয়ার এক বিঘা ধান এই পাখি নষ্ট করে দিয়েছে। আমাদের কাছে এরা এখন আর অতিথি নয়, পরিবারের সদস্যদের মতো। এ কারণে শিকারিরাও ভয়ে গ্রামে আসে না, জানান তিনি। এগিয়ে এসে শরিফুল ইসলাম বলেন, শামখোলা পাখির সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। সরকারি হিসেবে যাই হোক, আমাদের মতে পাঁচ থেকে সাত হাজার বা তারও বেশি পাখি বসবাস করে এ গ্রামে। কিন্তু পাখিদের আবাসন সংকটের কারণে ব্যাপক হারে শামখোলের ডিম ও বাচ্চা নষ্ট হচ্ছে। আশুরহাট গ্রামে শামখোল বাসা বেধে বাচ্চা তৈরী পাখি প্রেমি ও জীব বৈচিত্রবিদদের জন্য সুখবরই বটে। পাখি ভাল বাসেন না এমন মানুষ সমাজে খুব কম আছেন। প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ নানা কারণে দেশে দিন দিন বিশেষ প্রজাতির কিছু পাখির সংখ্যা কমে আসলেও আশুরহাট গ্রামে শামখোলা পাখির অভয়ারন্য নতুন করে আশার সঞ্চার করেছে।



ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার নিত্যানন্দপুর ইউনিয়নের উন্নয়ন বঞ্চিত আশুরহাট গ্রামে ৬/৭ বছর আগ থেকে শামখোল পাখির আনাগোনা। আগে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি আসতো। সারাদিন থেকে সন্ধ্যায় চলে যেত। কিন্তু গত দুই বছর ধরে শামখোলা পাখি আর যায় না। অতিথি থেকে গ্রামবাসির কাছে এখন অতি আপন। ভাঙ্গাচোরা রাস্তাঘাট আর বিদ্যুৎ বিহীন গ্রামটিতে প্রায় তিন হাজার লোকসংখ্যা বসবাস করে। গ্রামের বেশির ভাগ মানুষ কৃষিজীবি। গ্রামের মধ্যপাড়ায় রয়েছে আব্দুর রাজ্জাক ও গোপাল চন্দ্র বিশ্বাসের তিনটি পুকুর। পুকুরের পাড়ে রয়েছে বড় বড় শিমুল, জাম, মেহগনি আর কড়াই গাছ। এই গাছগুলো এখন পাখির আবাসস্থল। উচু উচু গাছের মগডালে শত শত বাসা করেছে। জুলাই আগষ্ট থেকে শামখোল বাসা বাঁধা শুরু করেছে। এখন ডিম পড়ছে। আবার কোন কোন বাসায় বাচ্চা দেখা গেছে। গোপাল চন্দ্রের পুকুরের উত্তর পশ্চিম কোনে রয়েছে বিরাট একটি শিমুল গাছ। এই গাছে চোখে পড়ে অন্তত ৭০/৮০টি শামখোলের বাসা। পাখির ভারে গাছের ডাল ভেঙ্গে যাচ্ছে। ঘন বাসা তৈরী আর খুনসুটির কারণে প্রায় ডিম নিচে পরে নষ্ট হচ্ছে। ঝিনাইদহ সরকারী কেসি কলেজের প্রানীবিদ্যা বিভাগের সাবেক প্রধান শেখ মোহাম্মদ আলী জানান, ভারতীয় উপমহাদেশ আর দক্ষিনপূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে এসব পাখি পাওয়া যায়। শামুক এদের প্রধান খাদ্য। এছাড়া ধান ক্ষেতের পোকামাকড়ও এরা খেয়ে থাকে। বাসযোগ্য আবহাওয়া আর খাদ্য প্রাপ্যতার জন্যে এরা বহুদুর উড়ে যেতে পারে, যা দীর্ঘ এক আন্দোলনের মতো। ঝাঁক ধরে গাছের মগডালে ছোট ছোট বাসা বেঁধে শামখোলা। স্থানীয় ভাষায় এরা শামুকভাঙ্গা নামে পরিচিত থাকলেও এ পাখির বৈজ্ঞানিক নাম এশিয়ান শামুকখোল। তিনি আরো জানান, এশীয় শামুকখোল এক প্রজাতিক, অর্থাৎ এর কোন উপপ্রজাতি নেই। উপযুক্ত আবহাওয়া, পরিমিত খাবারের যোগান আর নিরাপত্তা থাকলে এরা সাধারণত কোন এক জায়গা থেকে নড়েনা।
এশীয় শামুকখোল দহ্মিনএবং দহ্মিন-পূর্ব এশিয়ার ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, মায়ানমার, থাইল্যান্ড, লাওস, কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনামে দেখা যায়। ভুটানেও এদের দেখা গেছে, তবে তাদের উৎস অনিশ্চিত। বাংলাদেশে এরা এক সময় সক্রিয়ভাবে প্রজনন করলেও এখন খুব কম সংখ্যায় প্রজনন করতে দেখা যায়। শ্রীলঙ্কায় এরা এখন আর প্রজনন করে না। ভারতেও বছর বছর প্রচণ্ড খরার কারণে এদের প্রজনন বন্ধ থাকে।



বাংলাদেশের রাজশাহীর দুর্গাপুর, নাটোরের পচামারিয়া ও পুটিয়া, ফেনী, নওগাঁর সান্তাহার ও মহাদেবপুর, জয়পুরহাটের তেলাল, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট অঞ্চলের হাওর এলাকা প্রভৃতি অঞ্চলে এখনও এশীয় শামুকখোল ছোট দলে প্রজনন করে। এশীয় শামুকখোল আকারে বেশ বড়সড় জলচর পাখি। এর দৈর্ঘ্য কমবেশি ৮১ সেন্টিমিটার, ডানা ৪০ সেন্টিমিটার, ঠোঁট ১৫.৫ সেন্টিমিটার, লেজ ২০ সেন্টিমিটার ও পা ১৪.৫ সেন্টিমিটার। প্রজননকালে প্রাপ্তবয়স্ক পাখির দেহ একদম সাদা দেখায়। আশুরহাট গ্রামের মনোহর মন্ডল জানান, শিমুল গাছে থাকা পাখিগুলোর বৈচিত্র হলো তারা সব সময় গাছে অবস্থান করে। মা ও বাবা পাখি পাল্লাক্রমে ডিমে তা দেওয়ার জন্য তারা ঠিকমতো আহারও করে না। ওই গ্রামের দিলিপ কুমার জানান, আব্দুর রাজ্জাকের দুইটি পুকুর পাড়ে রয়েছে কড়াই গাছ। এই গাছে থাকা পাখিগুলো হচ্ছে সবে মাত্র উড়তে পারা ও কৈশর পার হওয়া। এ জন্য পাখিগুলোর পালক এখনো সাদা। দিলিপ কুমার জানান, গ্রামের মানুষ শামখোলা পাখিগুলো এমন ভাবে ভালবেসেছে যে তারা কৃষকের ধান নষ্ট করলেও কষ্ট পান না। গ্রামের মজনু মিয়ার এক বিঘা ধান তে শামখোলা পাখি নষ্ট করে দিয়েছে বলেও তিনি জানান। আশুরহাট গ্রামের গৌতম বিশ্বাস ও সুকেশ চন্দ্র জানান, পাখিদের নিরাপদ আবাস গড়ে তুলে বাগান মালিক ও এলাকার সহজ সরল মানুষগুলি প্রকৃতি প্রেমের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। গ্রামবাসী রবিউল ইসলাম জানান, আমাদের কাছে পাখিরা এখন আর বনজঙ্গল বা খাল-বিলে আসা অতিথী নয়, নিজের বাড়ি-ঘরের কেউ। এ জন্য শিকারীরা সহজে আশুরহাট গ্রামে ঢুকতে পারে না। পরম মমতায় আগলে রাখি আমরা। শরিফুল ইসলাম নামে এক গ্রামবাসি জানান, আশুরহাট গ্রামে শামখোলা পাখির প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক আছে।
গ্রামবাসির মতে পাঁচ থেকে সাত হাজার পাখি ওই গ্রামে বসবাস করে। সংখ্যা বেশিও হতে পারে। তবে এ বিষয়ে ঝিনাইদহ সদর উপজেলা বন কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম জানান, আমি বিকাল তিনটার সময় আশুরহাট গ্রামে যায়। তখন যা দেখিছি তাতে পাখির আনুমানিক সংখ্যা তিন হাজার হবে।


পিএনএস/দোজা/শাহাদাৎ

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন