অযত্নের কারণেই রংপুরের নদীগুলো এখন দুর্ভোগের কারণ

  24-09-2017 11:59AM

পিএনএস, রংপুর: বিশ্ব নদী দিবস আজ। প্রতিবছর সেপ্টেম্বর মাসের শেষ রবিবার দিবসটি পালিত হলেও তিস্তার করাল গ্রাস থেকে রক্ষা পাচ্ছে না রংপুর অঞ্চলের মানুষ।

তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা পাওয়ার বিষয়টির সমাধান হয়নি এখনো। তার ওপর নদী ভাঙনে প্রতিবছর নিঃস্ব হচ্ছে হাজারো পরিবার। বিশেষ করে এই অঞ্চলের নীলফামারী, রংপুর, লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রাম জেলার মানুষের দুঃখ হয়ে দাঁড়িয়েছে তিস্তা নদী। এ ছাড়া রংপুর বিভাগের আট জেলায় ছোট বড় মিলে শতাধিক নদী আজ বিপন্নপ্রায়। নদীর প্রতি অযত্ন আর অবহেলার কারণে এসব নদী থেকে সুফলতো নয়ই বরং দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তিস্তার ভাঙনে বিলীন হচ্ছে একের পর এক জনপদ। সুষ্ঠু পরিকল্পনা না থাকায় স্বাধীনতার পর থেকে পানি উন্নয়ন বোর্ড কোটি কোটি টাকা খরচ করেও স্থায়ীভাবে তিস্তার ভাঙন রোধ করতে সক্ষম হচ্ছে না। পরিণতিতে প্রতিবছর হাজারো পরিবার নদী ভাঙনের শিকার হয়ে সহায় সম্বল ও ঘরবাড়ি হারিয়ে আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছে। বেশির ভাগ পরিবার নিরুপায় হয়ে তিস্তা প্রতিরক্ষা ডানতীর বাঁধে বসতি স্থাপন করে মানবেতর জীবন যাপন করছে।

চলতি বছরের বন্যায় তিস্তার ভাঙনে বিভিন্ন বাঁধ-উপবাঁধ ভেঙে যাওয়ায় মূলবাঁধও হুমকির মুখে পড়েছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, রংপুর বিভাগের আট জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত নদীগুলোর মধ্যে রয়েছে দিনাজপুরে আত্রাই, করতোয়া, ঢেপা, তুলসি গঙ্গা, মহিলা, চিরি, কাঁকড়া, পুনর্ভবা, ভুল্লী, ছোট যমুনা, গর্ভেশ্বরী, ইছামতি, নলশীসা, তেতুলিায়, ভেলামতি, পাথার ঘাটা, নর্ত, ভেলান, ছোট ঢেপা।

নীলফামারীতে তিস্তা, চারালকাঠা, বুড়ি তিস্তা, বুড়িখোলা, খড়খড়িয়া, যমুনেশ্বরী, দেওনাই, ধাইজান, চিকলি, পাঙা এবং শালকি। লালমনিরহাটে তিস্তা, ধরলা, সানজিয়ান, গিরিধারী, সতী, ত্রিমোহিনী, মালদহ, রত্নাই, ভেটেশ্বর, ছিনাই, ধলাকাটা, সাঁকোয়া, স্বর্ণামতি। পঞ্চগড়ে করতোয়া, মহানন্দা, পাম, তালমা, ডাহুক, পেটকি, ছোট যমুনা, বেরং, ঘোড়ামারা, মরা তিস্তা, সুই, চাওয়াই, করুম, গোবরা, ছেতনাই, আলাইকুমারী, টাঙন, আত্রাই, নাগর, বরফা, তীরনই, পাথরাজ, রণচন্ডী, ভেরসা, পাঙ্গা।

কুড়িগ্রামে ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, ধরলা, দুধকুমর, ফুলকুমর, বোয়ালমারী, শিয়ালদহ, জিঞ্জিরাম, সোনাইমুড়ি, কালনদী, গঙ্গাধর, ধরণী, হলহলিয়া, কালকিনি, নীলকমল, জালশিরা। গাইবান্ধায় বাঙালি, করতোয়া, আলাই, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা। ঠাকুরগাঁওয়ে টাঙগন, নাগর, তিরনই, কুলিক, ঢেপা, সেনুয়া, চরনা, সুক, ভুল্লী, অহনা, লাচ্ছি, ভক্তি এবং রংপুরে তিস্তা, যমুনেশ্বরী, ঘাঘট, খোকসা ঘাঘট, আখিরা, ইছামতি, মানাস, ধুম, আলাইকুমারী। যদিও আরো অনেক নদীর নাম আছে, কিন্তু বাস্তবে আজ আর তা নেই। অযত্ন-অবহেলায় মরে গেছে সেসব নদী।

নদগুলোতে শুকনো মৌসুমে পানি থাকে না। উজানের দেশ পানি প্রত্যাহার করে নেয়। এতে নদীপারে আগের মত আর ফসল ফলানো যায় না। এ ছাড়া আমাদের দেশে নদীর তলদেশ খনন না করায় পানি ধারণক্ষমতা নেই বললেই চলে। অল্প পানিতে তা উপচে বন্যা কিংবা জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। এ বছর সাম্প্রতিক বন্যায় তিস্তার পাশাপাশি যমুনেশ্বরী, ধরলা, পুনর্ভবা, আত্রাই এর পানিতে প্রচুর বন্যা হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে অনেক। ক্ষরস্রোতা তিস্তার ভাঙনতো আছেই।

সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, তিস্তার ভাঙনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা রংপুরের গঙ্গাচড়ায় নদীভাঙা সহায়-সম্বলহীন পরিবাগুলো পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধের ওপর খড়ের দু-একটি ঘর তৈরি করে পরিবার-পরিজন নিয়ে অসহায় অবস্থার মধ্যে দিনাতিপাত করছে। এসব পরিবারের অনেকেরই একসময় ২০/২৫ বিঘা আবাদি জমি, টিনের ঘর ছিল। তিস্তা নদীর ভাঙনে এখন তারা সম্পূর্ণ নিঃস্ব। যাদের বাড়িতে এক সময় আট-দশজন শ্রমিক কৃষি কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করত, সেই গৃহস্থ পরিবারের মালিক সদস্যরা বাঁধে আশ্রয় নিয়ে অন্যের বাড়িতে শ্রম দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছে। এলাকাগুলোর কিছু বিত্তশালী পরিবারও অন্যত্র স্থায়ী বসবাস করার সুযোগ না থাকায় মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিয়েছে তিস্তা প্রতিরক্ষা বাঁধে।

গঙ্গাচড়া উপজেলার ১০ ইউনিয়নের মধ্যে ৭টি ইউনিয়নের ওপর দিয়ে প্রবাহিত তিস্তা নদী। প্রতিবছর নদী ভাঙনে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় গজঘন্টা ইউনিয়নের ছালাপাক, জয়দেব, রমাকান্ত, লক্ষ্মিটারী ইউনিয়নের শংকরদহ, জয়রামওঝা, চর ইশোরকোল, চর ইচলী, গঙ্গাচড়া সদর ইউনিয়নের ধামুর, গান্নারপাড়, সিংগিমারী, কোলকোন্দ ইউনিয়নের মটুকপুর, চিলাখাল, বিনবিনা এবং নোহালী ইউনিয়নের বাগডোহরা ও চর নোহালী এলাকার মানুষজন। এসব এলাকার ১০ সহস্রাধিক পরিবার মর্ণেয়া থেকে নোহালী পর্যন্ত ১৯ কিলোমিটার তিস্তা প্রতিরক্ষা ডানতীর বাঁধে আশ্রয় নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে মানবেতর জীবন-যাপন করছে।

চলতি বছর বন্যায় পাইকান হাজিপাড়া ও শঙকরদহ গ্রামে তিস্তার ভাঙন ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। পাঁচ শতাধিক পরিবারের ঘর বাড়ি নদী গর্ভে বিলীন হয়েছে। আরও শতাধিক পরিবারের ঘরবাড়িসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও তিস্তা প্রতিরক্ষা বাঁধ হুমকির মুখে পড়েছে। শংকরদহ গ্রামের মোখলেছার রহমান, আইয়ুব আলী, নুর আমিন, আব্দুল মান্নানসহ ভাঙনের শিকার পরিবারের সদস্যরা বলেন, 'হামার গ্রামটায় শ্যাষ হয়া গেলো। ভাঙন ঠেকানো দুরের কথা-হামার খবরও কায়ও নিলো না। '

বিশ্ব নদী দিবস পালনে আজ রবিবার রিভারাইন পিপল বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় কুড়িগ্রামের চিলমারীতে ব্রহ্মপুত্র নদীপারে জনসচেতনতামুলক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। রিভারাইন পিপল’র রংপুর বিভাগীয় সমন্বয়ক সিনেটর ও বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, তিস্তা হচ্ছে উত্তরের জীবনরেখা। নির্মমভাবে ভারত একতরফা পানি প্রত্যাহার করার কারণে সেই জীবনরেখার আজ মরণদশায় পরিণত হয়েছে। তিস্তাকে বাঁচানো না গেলে উত্তরাঞ্চল মরুভূমিতে পরিণত হবে। এ ছাড়া অযত্ন আর অবহেলার কারণে এ অঞ্চলের নদীগুলো আজ মরতে বসেছে। তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে জনজীবনে। এর থেকে রক্ষায় এখনি উদ্যোগ নিতে হবে। নদী বাঁচাতে সচেতন করে তুলতে হবে সবাইকে।


পিএনএস/আলআমীন

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন