প্রেমিক, স্বামী অতঃপর খুনি

  19-10-2017 10:37AM

পিএনএস ডেস্ক: দুজনের মধ্যে চলছিল প্রেম-ভালোবাসা। কিন্তু বাদসাধে পরিবার। সম্পর্কটা মেনে না নিয়ে ফুফাতো ভাইয়ের সাথে টুম্পার বিয়ে ঠিক করে পরিবার। এ খবর শুনে পরিবারের পছন্দে বিয়ে করে ফেলে সবুজও। কিন্তু এতেও ভাঙন ধরেনি দু’জনের সম্পর্কে। সবুজের বিয়ের পর টুম্পা পরিবারের অমতেই বিয়ে করে সবুজকে। বিয়ের পর টুম্পার কাছে সবুজের প্রতারণা ধরা পড়ে। বিদ্যমান এক স্ত্রী ও দুই সন্তান থাকার বিষয়টি গোপন করেছিলেন সবুজ। প্রিয় মানুষের এমন বিশ্বাসভঙ্গে কষ্ট পান সবুজের আগের স্ত্রী জেসমিন। চলে যান বাবার বাড়ি।

সবুজের পীড়াপীড়ি ও পরিবারের সম্মতিতে ফের স্বামীর বাড়িতে ফেরেন তিনি। তার মনে হয়তো নতুন বিশ্বাস জন্মেছিল। স্বামীর প্রতারণা ভুলে নতুন করে সব কিছু শুরু করতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু হয়নি, একে অপরের প্রতি অবিশ্বাস আর সবুজের সন্দেহমূলক মনোভাবের পরিণাম টুম্পা খুন। আর খুনি বনে যান স্বামী সবুজ। গত মঙ্গলবার মধ্যরাতে রোকসানা আক্তার টুম্পা (২৬) হত্যার অভিযোগে যশোর এসআর হোটেলের একটি কক্ষ থেকে সবুজ শেখকে (২৯) গ্রেফতার করে র‌্যাব। গতকাল র‌্যাব-২ এর কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান উপ-অধিনায়ক মেজর মোহাম্মদ আলী।

জানা গেছে, গত রোববার সকালে মোহাম্মদপুরের রাজিয়া সুলতানা রোডের ২৩/এক্স নম্বর বাড়ির নিচ তলায় নব্য বুটিকস হাউজের বিক্রয়কর্মী রোকসানা আক্তার টুম্পাকে ছুরিকাঘাত করে তার স্বামী সবুজ। পরে তাকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনায় নিহতের বাবা আবুল বাশার সবুজ শেখকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।

পুলিশ জানায়, টুম্পা যে দোকানে চাকরি করতেন, সেখানে সিসি ক্যামেরা ছিল। টুম্পাকে যেভাবে ছুরিকাঘাত করা হয়, তা সিসি ক্যামেরায় ধারণ করা আছে। আমরা সে ফুটেজ সংগ্রহ করেছি। রোববার রাতেই ওই ফুটেজ টুম্পার পরিবারকে দেখানো হয়। তারা নিশ্চিত করে টুম্পাকে যে ছুরিকাঘাত করেছে তার নাম সবুজ শেখ। সবুজ টুম্পার স্বামী ছিলেন। সবুজ ও টুম্পা প্রেম করে বিয়ে করেন সাত বছর আগে। তারা মিরপুরে বাসা নিয়ে থাকতেন। বিয়ের পর টুম্পা জানতে পারেন সবুজের গ্রামের বাড়ি পিরোজপুরে তার স্ত্রী ও সন্তান রয়েছে। এরপর টুম্পা তাকে ডিভোর্স দিয়ে সাভারে তার মা-বাবার কাছে চলে যান। দেড় মাস আগে মোহাম্মদপুরের রাজিয়া সুলতানা রোডের ওই দোকানে চাকরি নেন টুম্পা। সবুজ তা জেনে যান এবং সেখানে এসেই টুম্পাকে হত্যা করেন।

হত্যাকাণ্ডের পরদিন টুম্পার বাবা আবুল বাশার খলিফা সাংবাদিকদের জানান, টুম্পাকে প্রতারণা করে বিয়ে করে সবুজ। তাকে ডিভোর্স দেয়ার পরও টুম্পাকে বিভিন্নভাবে বিরক্ত করত।

গতকাল সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাব-২ এর উপ-অধিনায়ক মেজর মোহাম্মদ আলী বলেন, রোকসানা আক্তার টুম্পা হত্যা মামলার পরপরই পুলিশের পাশাপাশি ছায়া তদন্ত শুরু করে র্যাব। তদন্তের একপর্যায়ে যশোরের একটি আবাসিক হোটেল থেকে সবুজ শেখকে গ্রেফতার করা হয়।

সবুজ খুনের কথা স্বীকার করেছে। তিনি জানান, জিজ্ঞাসাবাদে সবুজ শেখ র‌্যাবকে জানান টুম্পা তার দ্বিতীয় স্ত্রী। টুম্পার পরিবার টুম্পার ফুফাতো ভাইয়ের সাথে বিয়ে ঠিক করে। পরে সবুজও জেসমিন নামে অন্য মেয়েকে বিয়ে করেন।

কিন্তু ওই বিয়ে বিদ্যমান থাকলেও টুম্পার সাথে সবুজের প্রেমের সম্পর্ক বজায় থাকে। একপর্যায়ে টুম্পার প্রথম বিয়ের ছয় মাস পর টুম্পা নিজের মা-বাবার অমতে সবুজের প্রথম স্ত্রীকে মেনে নিয়ে বিয়ে করার জন্য নিজ বাড়ি থেকে পালিয়ে সবুজকে বিয়ে করেন। বিয়ের বছরখানেক পর থেকে তাদের দাম্পত্য কলহ সৃষ্টি হয়। তারা একে অপরের সাথে বাগি¦তণ্ডা ও বিবাদে জড়িয়ে পড়েন।

ফলে টুম্পা সবুজকে বিয়ের দুই বছর পর ডিভোর্স দেন। ডিভোর্স হওয়ার কিছু দিন পর তারা আবার মান-অভিমান ভুলে গিয়ে ফের সাভারের একটি কাজী অফিসে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হন বলে সবুজ র‌্যাবকে জানান। এরপর তারা মিরপুরে একটি ভাড়া বাসায় বাস করতে থাকেন এবং সবুজ শপার্স ওয়ার্ল্ডে এবং টুম্পা মিরপুর বুটিকস ফ্যাশনে বিক্রয়কর্মী হিসেবে যোগ দেন। কিন্তু সবুজের সন্দেহমূলক মনোভাবের কারণে আবার তাদের মধ্যে অশান্তি সৃষ্টি হয়।

র‌্যাব জানায়, সর্বশেষ সবুজের চাচাতো ভাই নাসিরের দোকানে টুম্পা বিক্রয়কর্মী হিসেবে যোগ দিলে সেখানেও সবুজ নাসিরের সাথে টুম্পার সম্পর্ক নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করলে তাদের দাম্পত্য জীবন মারাত্মক খারাপ রূপ ধারণ করে। ঘটনার দিন সকালে সবুজ ‘নব্য’ বুটিকসে গিয়ে এসব বিষয় সমাধান করার জন্য টুম্পার সাথে ‘নব্য’ বুটিকসের ভেতরেই বাগ্বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন। একপর্যায়ে চাকু দিয়ে সবুজ টুম্পার গলায় ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যান।

র‌্যাব জানায়, ঘটনার পর সবুজ নিজেকে আত্মগোপন করার জন্য প্রথমে পল্টন, তার পর যাত্রাবাড়ী হয়ে চট্টগ্রাম পালিয়ে যান। এরপর ভারতে পালিয়ে যাওয়ার জন্য সবুজ যশোরে অবস্থান করেন। তদন্তের একপর্যায়ে তার অবস্থান নিশ্চিত হয়ে র‌্যাব-২ যশোরের ওই হোটেলে অভিযান চালিয়ে সবুজ শেখকে গ্রেফতার করে।

নিহতের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করেন মোহাম্মদপুর থানার এসআই মেজবাহ উদ্দিন। তিনি ঘটনার দিনের বর্ণনা দিয়ে তার প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, ১৫ অক্টোবর সকালে টুম্পা তার অন্য সহকর্মী ফারিয়ার সাথে দোকান পরিষ্কারের কাজ করছিলেন। সকাল ১০টা ১০ মিনিটের দিকে সবুজ শেখ দোকানে প্রবেশ করেন।

এ সময় তারা দু’জন পারিবারিক বিষয় নিয়ে কথা বলতে থাকেন। একসময় তাদের মধ্যে ঝগড়া হয়। টুম্পার হাতে থাকা মোবাইল কেড়ে নেয়ার চেষ্টা করেন সবুজ। টুম্পা তখন তাকে বাধা দেন। তখন সবুজ তার প্যান্টের পকেটে থাকা চাকু বের করে টুম্পার ঠোঁটের বাম পাশের নিচে, গলার বাম পাশে মাঝামাঝি স্থানে, বাম হাতের মাঝখানের আঙুলে আঘাত করেন। এরপর সবুজ পালিয়ে যান। এতে ফারিয়া চিৎকার করলে এবং মালিককে বিষয়টি জানালে বেলা ১১টা ৪০ মিনিটের দিকে দোকানের মালিকের খালাতো ভাই বাবর টুম্পাকে রক্তাক্ত অবস্থায় সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে দুপুর ১২টার দিকে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন