মা থাকে বৃদ্ধাশ্রমে, শাশুড়ি-শ্যালকেরা থাকে বাসায়!

  28-11-2016 03:41PM

পিএনএস ডেস্ক: যে সন্তানদের মানুষ করতে জীবনটাই শেষ করে দিয়েছেন, জীবনের শেষ বেলায় এখন তাদের কাছেই বোঝা হয়ে গেছেন তারা। সকল অসহায়ত্বকে ধারণ করে বৃদ্ধ জীবনের শেষ সময়টুকু অনিচ্ছাসত্ত্বেও কাটাতে হচ্ছে রাউজানের নোয়াপাড়ার আমেনা-বশর বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্র তথা বৃদ্ধাশ্রমটিকে।

চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার সুচিয়া গ্রামের বাসিন্দা বাণী চৌধুরী (৬৩) একসময় তিনি নগরীর বিএন স্কুল এন্ড কলেজের সিনিয়র শিক্ষিকা ছিলেন। এক ছেলে ও এক মেয়ের জননী বাণী চৌধুরীর চাকুরীজীবী ছেলে সৌমেন চৌধুরী বউ, বাচ্চা, শ্যালক, শাশুড়ি সবাইকে নিয়ে শহরের বাসায় থাকেন একসাথে। আর নিজের জন্মদাত্রী মা থাকেন বৃদ্ধাশ্রমে। ৫ বছর ধরে ছেলে সম্পর্ক রাখে না মায়ের সাথে।

পটিয়া উপজেলার মুখপাড়া এলাকার অনরু ভট্টাচার্য্য। বয়স ৭৭। একমাত্র ছেলে প্রমিত ভট্টাচার্য্যরে বউয়ের লাথি, ঘুষিতে হাতের আঙ্গুল ভেঙ্গে গেছে অনরু ভট্টাচার্যের।

রাউজান উপজেলার হলদিয়া গ্রামের পঞ্চান্ন ঊর্ধ্ব আবুল হাশেমের ৩ ছেলের ২ জন থাকেন প্রবাসে। হাশেম নিজেও একসময় প্রবাসে ছিলেন। কষ্ট করে লাখ লাখ টাকা আয় করে বাড়িতে পাকাঘর গড়ে তুলেছেন। ছেলেদের বিদেশে পাঠিয়েছেন সুখের আসায়। কিন্তু সুখ আবুল হাশেমের কপালে সয়নি।

অনরু ভট্টাচার্য্য, বানী চৌধুরী, আবুল হাশেমের মতো আহমদ মোস্তফা, সুফিয়া বেগম, মিনু দাশ, নমিতা, মো. হোসেন, নজরুল ইসলামের একসময় সবই ছিল। এখন তাদের কেউই আপন নয়।

তারা কেউ ছেলেমেয়ে, কেউ স্ত্রী, কেউ পরিবার-পরিজনের অবহেলায় নিরুপায়। তাদের কাছে এখন অতি আপন ঠিকানা রাউজানের নোয়াপাড়ার আমেনা-বশর বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্র তথা বৃদ্ধাশ্রম।

ছেলেমেয়ে, স্ত্রীর অবহেলা অনাদর আর আত্মীয় স্বজনদের কাছ থেকে অনেক দূরে থাকা এসব বয়স্কদের নিরানন্দ দিন কাটছে বৃদ্ধাশ্রমটিতে।

অলস বসে দীর্ঘশ্বাস ফেলছেন তারা। বয়সের ভারে ন্যুব্জ হয়ে গেছেন। চলৎশক্তি হারিয়ে জীবনকে টেনে নিয়ে যেতে হচ্ছে। আপনজনের কাছে না থাকতে পারার কষ্ট তাড়না দিচ্ছে বেশি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে কেবলই ভাবছেন।

যে সন্তানদের মানুষ করতে জীবনটাই শেষ করে দিয়েছেন, জীবনের শেষ বেলায় এখন তাদের কাছেই বোঝা হয়ে গেছেন তারা। সকল অসহায়ত্বকে ধারণ করে বৃদ্ধ জীবনের শেষ সময়টুকু অনিচ্ছাসত্ত্বেও কাটাতে হচ্ছে রাউজানের নোয়াপাড়ার আমেনা-বশর বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্র তথা বৃদ্ধাশ্রমটিকে।

কাপ্তাই সড়কের দক্ষিণ পাশে ২০১৪ সালের ১ মে চালু হয় এই বৃদ্ধাশ্রমটি। এলাকার শিল্পপতি সামশুল আলম অসহায় নারী পুরুষকে বেঁচে থাকার অবলম্বন করে দিতে সুদৃশ্য বৃদ্ধাশ্রমটি নির্মাণ করেন। বর্তমানে এ বৃদ্ধাশ্রমে রয়েছে ১৭জন। এরমধ্যে ১১জন পুরুষ, মহিলা ৬জন।

বৃদ্ধাশ্রমের বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের দিনকাল কেমন কাটছে, এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গতকাল সকালে ৯টার পরপরই যাওয়া হয় রাউজান নোয়াপাড়া বৃদ্ধাশ্রমে। ঢুকতে দেখা গেলো পুকুর ঘাটের পাশে একটি বেঞ্চে বসে আছেন পঞ্চান্ন ঊর্ধ্ব আবুল হাশেম ও ৭০ বছর বয়সী আবদুল হালিম (ছদ্মনাম)।

আবদুল হালিম বলেন, ৪ মেয়ে ও ১ ছেলের মধ্যে ছেলে মাস্টার্স পাস করে চাকরি করছে। বউ বাচ্চা নিয়ে ঢাকায় থাকেন। মেয়েদের মধ্যে একজন পুলিশ অফিসার। বাকিরা লেখাপড়া করে।

কেন এই বৃদ্ধাশ্রমে প্রশ্ন করতেই কেঁদে ওঠে বলেন, ‘কপালে আছে, তাই সবকিছু থেকেও এখন আমার কিছু নেই।’

সুফিয়া বেগম (৭৭) এর স্বামী, বাবা, মা, ভাই কেউ নেই। চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে শ্বশুর বাড়ি। দুই মেয়ের মধ্যে এক মেয়ে বিয়ের তিনমাসের মধ্যে মারা গেছে। দেখার কেউ নেই। অসুস্থ হওয়ার পর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে তুলি ও ইলিয়াছ নামের দুইজন ডাক্তার তাকে এ বৃদ্ধাশ্রমের খোঁজ দেন।

সুফিয়া বলেন, আমার খোঁজ নেয়ার কেউ নেই। বৃদ্ধাশ্রমই আমার ঠিকানা।

এক ছেলে ও এক মেয়ের জননী মিনু দাশ (৭০)। চারমাস আগে সন্তানরা তাকে এ বৃদ্ধাশ্রমে দিয়ে যান। এরপর আর কেউ দেখতে আসেনি তাকে।

চন্দনাইশের বৃদ্ধা প্রাক্তন সিনিয়র শিক্ষিকা বাণী চৌধুরী বলেন, আসবাবপত্র, ঘরের সবকিছু রাখার জায়গা আছে, কিন্তু ছেলেদের কাছে মা-বাবাকে রাখার জায়গা হয় না। একমাত্র ছেলে আমার কাছ থেকে দূরে আছে ৫ বছর ধরে। বৃদ্ধাশ্রমের এই সবুজ গাছপালাকেই আমি সঙ্গী করে নিয়েছি। ওরা আমার দুঃখের কথা বুঝে। এই বৃক্ষরাজির সঙ্গেই দিনমান চলে আমার নীরব ভাব আদান প্রদান। সময়মতো খাবার, ঔষধ, নাস্তা পাই। ভালোইতো আছি বৃদ্ধাশ্রমে।

নগরীর বায়েজিদ থানার হাজীপাড়া এলাকার মো. হোসেন (৭০) একসময় রুবি সিমেন্টের রেস্ট হাউসে চাকরি করতেন। বয়সের ভারে আর পারেন না। ৩ ছেলে ও ৪ মেয়ের মধ্যে দুই ছেলে চাকরি করে আর এক ছেলে এখনো লেখাপড়া করছে।

মো. হোসেন বলেন, ‘ছেলেরা টাকা পয়সা দেয় না। আমার চিকিৎসা কিছুই চলছিল না। তাই ২ বছর ধরে এই বৃদ্ধাশ্রমে ঠাঁই নিয়েছি। কেউ দেখতেও আসেনা।’

রাঙ্গুনিয়ার মরিয়ম নগরের নজরুল ইসলামের (৬৫) ২ ছেলে ও ১ মেয়ে। ছেলেদের একজন থাকে আবুধাবি, অন্যজন মাস্কাটে। কিন্তু তারা ঔষধপত্রসহ কোন টাকা পয়সা না দেয়ায় ২০১৪ সালের ১ মে উদ্বোধনের দিনই চলে আসেন এই বৃদ্ধাশ্রম। গত দুই বছরে কেউ খোঁজও নিতে আসেননি জন্মদাতার খোঁজে।

নোয়াপাড়া আমেনা বশর বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রের আশ্রিত বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা জানান, কর্তৃপক্ষের সেবা ও আন্তরিকতায় তারা সন্তুষ্ট। এ বৃদ্ধাশ্রমের ম্যানেজার মো. ফারুক বলেন ‘বৃদ্ধদের সেবা করে যাচ্ছি, ভালো লাগছে। সেবার মানসিকতা নিয়ে কাজ করে যেতে চাই।

পিএনএস/আলআমীন

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন