ঘুষ না দেয়ায় শিশুকে ছুড়ে ফেলার অভিযোগ

  17-03-2024 10:37AM



পিএনএস ডেস্ক: ভোরে নিউমোনিয়া আক্রান্ত এক মাসের শিশুকে নিয়ে ঢাকা শিশু হাসপাতালে এসেছিলেন স্বজনরা। জরুরি বিভাগে চিকিৎসক দেখানোর পর অবস্থা গুরুতর দেখে শিশুটিকে ভর্তির পরামর্শ দেয়া হয়। কিন্তু হাসপাতালে প্রবেশ নিয়ে বিপত্তি বাধে। দায়িত্বরত আনসার সদস্যরা তাদের ভেতরে প্রবেশ করতে দেননি। তারা এক হাজার টাকা দাবি করেন। এ নিয়ে কথাকাটাকাটির এক পর্যায়ে আনসার সদস্যরা রোগীর এক সদস্যকে বেদম মারপিট করে। শিশু রোগীর মাকেও মারধর করা হয়। এক পর্যায়ে কোলের শিশুটিকেও ছুড়ে ফেলে দেয়ার অভিযোগ করেন স্বজনরা। এমন পরিস্থিতির শিকার হয়ে সংকটাপন্ন শিশুটিকে মিটফোর্ড হাসপাতালে ভর্তি করেছেন স্বজনরা। এ ঘটনায় শিশুটির নানি শাহনাজ বেগম বাদী হয়ে শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা করলে দুই আনসার সদস্যকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

অসুস্থ শিশু আব্রাহাম সিহানের নানি প্রত্যক্ষদর্শী শাহনাজ বেগম বলেন, বাড়ি ভোলা হলেও কর্মসূত্রে তার মেয়ে লিমা পরিবার নিয়ে লালবাগ এলাকায় বাস করেন।

বেশ কিছুদিন ধরেই সিহান ঠাণ্ডাজনিত রোগে ভুগছে। দু’দিন আগেও স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ (মিটফোর্ড হাসপাতাল)-এ নিয়ে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে তাকে। সেখানকার চিকিৎসক বলেছিলেন- সিহানকে নেবুলাইজার দিতে হবে। আমরা শুক্রবারও স্থানীয় ফার্মেসি থেকে দুইবার তাকে গ্যাস দিয়েছি। কিন্তু রাতে অনেক অসুস্থ হয়ে পড়ে। তাই দেরি না করে শনিবার সকালে একমাস বয়সী সিহানকে নিয়ে আমি, ওর মা লিমা আক্তার ও আমার ছেলে রবিন ইসলাম আকাশ ঢাকা শিশু হাসপাতালে আসি। সকাল সাড়ে ৭টার দিকে হাসপাতালের জরুরি বিভাগ থেকে টিকিট কেটে ডাক্তারও দেখাই। ডাক্তার একটা এক্স-রে করাতে বলেন আমাদের। তখন আমরা সিহানের একটা এক্স-রে করাই। এরপর আবারো ডাক্তারের কাছে যাই। ডাক্তার তখন সিহানকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে বলেন। আমরা ডাক্তারের কথামতো সেখান থেকে বের হয়ে সিহানকে ভর্তি করানোর জন্য হাসপাতালের ভেতরে প্রবেশ করতে যাই। তখন জরুরি বিভাগের গেটে দাঁড়িয়ে থাকা নূর হোসেন ও মো. কাশেম নামে দুই আনসার সদস্য আমাদের জিজ্ঞেস করেন- কোথায় যাবেন? আমরা তাদেরকে জানাই, ডাক্তার আমার নাতিতে ভর্তি করতে বলেছেন। ওর অবস্থা খুব খারাপ। এ জন্যই আমরা ভেতরে যাচ্ছি। তখন ওই আনসার সদস্যরা বলেন, কোনো সিট খালি নেই। কেউ যেতে পারবেন না। আমি তখন বলি- ডাক্তার তো ভর্তি লিখে দিয়েছে, বাচ্চাটা খুব কষ্ট পাচ্ছে। আমরা ভেতরে গিয়ে কথা বলে দেখি। তখন তারা জানায়, ভেতরে যাওয়ার নিয়ম নেই। যদি এক হাজার টাকা দেন তাহলে সকলেই ভেতরে যেতে পারবেন, সিটও পাবেন। কোনো সমস্যা থাকবে না। এখন দেখেন- আপনারা কী করবেন? এই কথা শুনে আমার ছেলে রবিন তাদের বলেন- আমরা কেন আপনাদের টাকা দিবো! এটা সরকারি হাসপাতাল, এখানে রোগী ভর্তি করতে কেন টাকা দেয়া লাগবে? আমরা ভেতরে যাবো, আমাদের যেতে দেন।

তখন ওই আনসার সদস্যরা বলেন, টাকা না দিলে কেউ ভেতরে যেতে পারবেন না। রোগী নিয়ে আপনারা অন্য হাসপাতালে চলে যান। এখানে টাকা ছাড়া কোনো কাজ হবে না। এরপর আমার ছেলে পাশের রেলিংয়ের উপর বসে আমাকে বলছে- মা তুমি আমাকে প্রশাসনে চাকরি করতে বলো, এমন চাকরিতে ঢুকলে আমাকেও তো ঘুষ খেতে হবে। এই কথার পরই ওই দুই আনসার সদস্য আমার ছেলের জামার কলার চেপে ধরে অকথ্য ভাষায় গালি দেয় আর বলে- তুই কাদেরকে কী বলছিস। কে ঘুষ খায়। আমি তখন বারবার তাদেরকে বলছি আপনাদের তো বলেনি, আমার ছেলে আমাকে বলেছে। এরপরও তারা আমার ছেলেকে টেনে-হিঁচড়ে হাসপাতালের বাইরে বের করে নিয়ে আসে। আমার ছেলেটাকে চড়-থাপ্পড়, কিল-ঘুষি, লাথি মারতে থাকে আর বলে- তোর কোন হ্যাডাম আছে দেখি আজ। এ সময় আশেপাশের আরও ৭ থেকে ৮ জন আনসার এসে যোগ দেয় তাদের সঙ্গে। যে যেমন খুশি মারতে থাকে আমার ছেলেকে। আমি কোনোভাবেই ঠেকাতে পারছিলাম না। আমার মেয়ে তাদের ঠেকাতে গেলে তাকেও চুলের মুঠি ধরে মারধর করে আনসার সদস্যরা। তখন আমার মেয়ের কোলে থাকা এক মাসের ওই অসুস্থ বাচ্চাটাকেও তার মায়ের কোল থেকে নিয়ে ছুড়ে মাটিতে ফেলে দেয় তারা।

তিনি বলেন, তারা শুধু এক জায়গায় দাঁড়িয়ে এই কাণ্ড ঘটায়নি। আমার ছেলেকে মারতে মারতে জরুরি বিভাগ থেকে নিয়ে শিশু বিকাশ কেন্দ্রের সামনে পর্যন্ত গেছে। সেখানে নিয়ে সবচেয়ে বেশি মারধর করা হয়েছে। হাসপাতালের সকলে দেখেছে তারা এক হাজার টাকার জন্য কি করেছে আমাদের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমরা দুইজন অসহায় মহিলা মানুষ। তখন কী করবো কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। তখন আমি আমার স্বামী সালাউদ্দিনকে ফোন দিই। তিনি আমাদেরকে থানায় যাওয়ার পরামর্শ দেন। পরে আমরা শেরেবাংলা নগর থানায় গিয়ে এ বিষয়ে লিখিত অভিযোগ দিলে পুলিশ এসে দুই আনসার সদস্যকে আটক করে থানায় নিয়ে যায়। ষাটোর্ধ্ব শাহনাজ বেগম বলেন, আমরা অসুস্থ নাতিটাকে নিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে এসেছিলাম, এটাই আমাদের অন্যায়। আর এই হাসপাতালের নিরাপত্তার দায়িত্বে যারা তারাই আমাদের সঙ্গে এমন করলো। কোনো কারণ ছাড়াই আমার ছেলেটাকে এইভাবে মারধর করলো। ওকে আমি প্রশাসনে চাকরি করতে বলেছিলাম কিন্তু তার সঙ্গে এমন ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটানো হয়েছে। ওকে আর কোনো দিনও আমি প্রশাসনের চাকরিতে যেতে বলবো না। আর যারা আমাদের সঙ্গে এমন করলো তাদের আমি সঠিক বিচার চাই।

শিশু সিহানের খালা সীমা রহমান বলেন, সব কিছু মেনে নেয়া যায় কিন্তু এক মাসের দুধের শিশুকে যেভাবে তার মায়ের কোল থেকে নিয়ে ছুড়ে ফেলে দেয়া হয়েছে এটা কোনোভাবেই মানতে পারছি না। যার গায়ে একবিন্দু মানুষের রক্ত আছে, সেও মেনে নিবে না। তিনি বলেন, অসুস্থ বাচ্চাকে নিয়ে এমনিতেই আমার বোনের মন ভালো না। তাকেও চুলের মুঠি ধরে মারধর করা হলো। আমরা এদের বিচার চাই।

এ বিষয়ে শিশু হাসপাতালের দায়িত্বরত আনসার সদস্যদের সহকারী কমান্ডার মো. শহিদুল বলেন, আমরা কখনোই চাই না কোনো খারাপ সদস্য আমাদের বাহিনীতে থাকুক। তারপরও সব জায়গায় ভালো-খারাপ সব ধরনের লোকই কাজ করে। তিনি বলেন, অনেক সময় আমাদের সঙ্গে রোগীর স্বজনরা না বুঝে খারাপ আচরণ করে, কিন্তু আমরা বুঝি মানুষ বিপদে পরেই হাসপাতালে আসে। তাদের মন মানসিকতা ঠিক থাকে না। কিন্তু যে ঘটনাটি ঘটেছে এটা কারোর কাম্য নয়। বিষয়টি নিয়ে পুলিশ তদন্ত করছে। যেই অন্যায় করুক তার বিচার হবে।

শিশু হাসপাতালের সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) ডা. মো. ইয়াছির রহমান বলেন, বিষয়টি আমরা শুনেছি। পরিচালক স্যার থেকে শুরু করে সকলেই বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন। তিনি বলেন, মূলত আনসাররা হাসপাতালের কোনো সদস্য না। আনসারের হেড অফিসের মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে তাদের দিয়ে আমাদের হাসপাতালের নিরাপত্তার দিকটা দেখা হয়। তাদের হেড অফিসই তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করেন। এর আগেও এমন একটা ঘটনা ঘটেছিল। আমরা তাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মাধ্যমে ব্যবস্থা নিয়েছি। এই বিষয়টিও তাদেরকে জানানো হয়েছে। এ বিষয়ে তারই ব্যবস্থা নিবেন।

এদিকে পুরো ঘটনাটি নিয়ে শেরেবাংলা নগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মু. আহাদ আলী বলেন, এ বিষয়ে মামলা হয়েছে। হাসপাতালের সিসিটিভি ফুটেজ দেখা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে আমরা ঘটনার সত্যতা পেয়েছি। এজন্য জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নূর হোসেন ও মো. কাশেমকে আটকও করা হয়েছে। তদন্তের কাজও চলমান রয়েছে। তদন্ত শেষে বিস্তারিত বলা যাবে। দোষী যেই হোক না কেন কাউকে ছাড় দেয়া হবে না।


পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন