কোথা থেকে ফিরে আসছেন তাঁরা?

  12-12-2017 03:53PM

পিএনএস ডেস্ক : এখনো নিখোঁজ সাবেক রাষ্ট্রদূত মারুফ জামান, বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষক মোবাশ্বার হাসান, সাংবাদিক উৎপল দাস, ব্যবসায়ী সৈয়দ সাদাত আহমেদ, কল্যাণ পার্টির মহাসচিব আমিনুর রহমান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইশরাক আহম্মেদ।

এই শহরে হঠাৎ ‘নিখোঁজ’ বা গুম হওয়া মানুষগুলোর মধ্যে যাঁরা ফিরে এসেছেন, তাঁদের কাছ থেকেও কোনো তথ্য আদায় করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তাঁরা কোথা থেকে ফিরেছেন, কে বা কারা তাঁদের ধরে নিয়েছিল, কোথায় রাখা হয়েছিল, সে বিষয়ে কিছুই আর জানা যাচ্ছে না। এ রহস্য উদ্‌ঘাটনে পুলিশেরও খুব একটা আগ্রহ দেখা যায় না। যদিও এ ধরনের ঘটনার ক্ষেত্রে প্রচলিত সন্দেহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দিকে।

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ফিরে আসার পরও লোকগুলো নিজেদের নিরাপদ মনে করতে পারেন না বলেই তাঁরা চুপ থাকেন। আর এভাবে ধরে বা তুলে নিয়ে যাওয়ার সংস্কৃতির কারণে মানুষ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর আস্থা হারাচ্ছে। দেশে একটা ভয়ের পরিবেশ তৈরি হয়েছে। আবার অপরাধীদের জন্যও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে অপকর্ম করা সহজ হয়ে উঠছে।

আবার ‘নিখোঁজ’ হওয়া বা তুলে নেওয়া হয়েছে বলে পরিবারের অভিযোগের বেশ কয়েক দিন পরে অনেককেই গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। মাঝের সময়টা তাঁরা কোথায় ছিলেন; এ বিষয়ে পুলিশের সাধারণ জবাব, ‘গা ঢাকা দিয়েছিলেন তাঁরা।’ এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের জনসংযোগ ও গণমাধ্যম বিভাগের উপকমিশনার মাসুদুর রহমান সাংবাদিককে বলেন, অভিযোগ পাওয়ার পর পুলিশ বিধিমোতাবেক তদন্ত কার্যক্রম চালিয়ে থাকে।

গুম হওয়ার পরে ফিরে আসার অন্তত ২০টি ঘটনা ঘেঁটে কিছু সাধারণ প্রবণতা পাওয়া যায়। এ ঘটনাগুলোর প্রায় সব ক্ষেত্রেই ‘প্রশাসনের লোক’, র‍্যাব বা ডিবির পরিচয় ব্যবহার করা হয়েছে। অপহরণকারীরা সবাই খুবই পেশাদার বা প্রশিক্ষিত। আর কোনো ঘটনাতেই অপহরণের পরে মুক্তিপণ বা চাঁদা দাবি করা হয়নি।

হংকংভিত্তিক এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন (এএইচআরসি) ও দেশীয় মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের হিসাব অনুযায়ী, ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৮ বছর ৯ মাসে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ৩৯৫ জন নিখোঁজ হয়েছেন। পরবর্তী সময়ে তাঁদের মধ্য থেকে ৫২ জনের লাশ পাওয়া গেছে। ফিরে এসেছেন ১৯৫ জন।

গত ২২ আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত গত সাড়ে তিন মাসে ১৫ জন ‘নিখোঁজ’ হন। তাঁদের মধ্যে ব্যবসায়ী অনিরুদ্ধ রায়, জামালপুরের সরিষাবাড়ী পৌরসভার মেয়র রুকনুজ্জামান ও ব্যাংক কর্মকর্তা শামীম আহমেদকে ধরে নেওয়ার পর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

ছয়জনকে পরে বিভিন্ন সময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গ্রেপ্তার দেখিয়েছে। এখনো নিখোঁজ আছেন ছয়জন। তাঁরা হলেন কল্যাণ পার্টির মহাসচিব আমিনুর রহমান, সাংবাদিক উৎপল দাস, ব্যবসায়ী ও বিএনপির নেতা সৈয়দ সাদাত আহমেদ, কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইশরাক আহম্মেদ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মোবাশ্বার হাসান ও সাবেক রাষ্ট্রদূত মারুফ জামান।

ফিরে এসে চুপ

এ পর্যন্ত যাঁরা নিখোঁজ হওয়ার পর ফিরে এসেছেন, সবাই চুপ থেকেছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও তেমন উচ্চবাচ্য করেনি।

২০১১ সালের ১৭ নভেম্বর মালিবাগ হোসাফ টাওয়ারের সামনে থেকে একসঙ্গে সাতজনকে অপহরণ করা হয়। তাঁরা হলেন মো. মিরাজ (২৬), মো. দিদার (২৮), জসীমউদ্দীন (৩৫), মো. আকাশ ওরফে বাহার (২৯), শেখ সাদী (৩৮), আরিফ হোসেন (২৮) ও মো. জুয়েল (২২)। অপহরণের পর আকাশের ক্রেডিট কার্ড নিয়ে দুই অপহরণকারী শান্তিনগর এলাকার ব্র্যাক ব্যাংকের এটিএম বুথ থেকে কিছু টাকাও তুলে নেয়। সেই টাকা তোলার সময় বুথে রাখা সিসি ক্যামেরায় তাদের ছবিও ওঠে। সেই ছবি দৈনিকে ছাপাও হয়েছিল। কিন্তু অপহরণকারী কারা, তা আজও জানা যায়নি।

ওই সাতজনের মধ্যে মিরাজ ও সাদীকে কয়েক ঘণ্টা পর গাড়ি থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়। আর কয়েক দিন পর জসীমউদ্দীনের লাশ পাওয়া যায় আশুলিয়া এলাকায়। বাকি চারজনের ভাগ্যে কী ঘটেছে, তা এখনো অজানা। কারা তাঁদের ধরে নিয়ে গেল, তা উদ্‌ঘাটিত হয়নি। মিরাজ ও সাদীর সঙ্গে ঘটনার পরপর যোগাযোগ করা হলেও তাঁরা এ বিষয়ে কিছুই বলতে চাননি।

চট্টগ্রামের স্বর্ণ ব্যবসায়ী মৃদুল চৌধুরীর অপহরণ ও ফিরে আসার ঘটনা দেশব্যাপী আলোচিত হলেও আজও জানা যায়নি কারা এ কাজ করেছিল। র‍্যাব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সোনা লুটের মামলা করার পর ২০১৪ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি তুলে নেওয়া হয় মৃদুলকে। ছয় দিন পরে কুমিল্লার বুড়িচং এলাকায় মৃদুলকে ফেলে যাওয়া হয়। কারা তাঁকে নিয়ে গিয়েছিল, সে বিষয়ে আজ পর্যন্ত কিছু জানানো হয়নি পুলিশের পক্ষ থেকে।

নিখোঁজ হওয়ার পরে বিএনপির নেতা সালাহউদ্দিন আহমদ কী করে ভারতে গিয়ে আবির্ভূত হলেন, সেটা এখনো একটা রহস্য। সালাহউদ্দিন এখনো দেশে ফিরতে পারেননি। ২০১৫ সালের ১০ মার্চ রাতে উত্তরা ৩ নম্বর সেক্টরের ১৩-বি নম্বর সড়কের একটি বাড়ির দোতলার ফ্ল্যাটে ঢুকে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিরা সালাহউদ্দিন আহমদকে ধরে নিয়ে যায়। ১২ মে সালাহউদ্দিনের খোঁজ মেলে ভারতের মেঘালয়ের শিলংয়ে।

অপহরণের পর উত্তরা ৩ নম্বর সেক্টরের নিরাপত্তাকর্মী ও কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিককে বলেছিলেন, তাঁকে ধরে নেওয়ার আগে ওই বাসার কাছেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পিকআপ দাঁড়ানো ছিল। ওই পিকআপে আসা সদস্যরা সেখানে কর্তব্যরত ৩ নম্বর সেক্টর কল্যাণ সমিতির নিয়োগ করা নিরাপত্তাকর্মীদের কাছে ১৩-বি নম্বর সড়কটির অবস্থান জানতেও চেয়েছিলেন। শুরু থেকেই সালাহউদ্দিনকে ধরে নিয়ে যাওয়ার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেই দায়ী করে আসছে তাঁর দল ও পরিবার।

তবে সালাহউদ্দিন আহমদের স্ত্রী হাসিনা আহমেদ সাংবাদিককে বলেন, তিনি এখন মোটামুটি সুস্থ। তাঁকে দেশে আনার চেষ্টা চলছে। আর কারা তাঁকে ভারতে নিয়ে গেল, এ বিষয়ে জানতে পুলিশ কোনো তৎপরতা চালাচ্ছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘পুলিশের সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ নেই।’

হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থ চুরির ঘটনার তদন্তের নানা দিক নিয়ে গণমাধ্যমে কথা বলার পর গত বছরের ১৬ মার্চ নিখোঁজ হন তথ্যপ্রযুক্তিবিদ তানভীর হাসান জোহা। এক সপ্তাহ পর ২৩ মার্চ জোহাকে বাড়িতে দিয়ে যান আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোকেরা। জোহা বিমানবন্দর সড়কে উদ্‌ভ্রান্তের মতো ঘোরাফেরা করছিলেন বলে পরিবারকে জানান কর্মকর্তারা।

মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ড হওয়া সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ছেলে হুম্মাম কাদের চৌধুরীকে গত বছরের ৪ আগস্ট পুরান ঢাকার আদালতপাড়া থেকে ডিবি পরিচয়ে ধরে নেওয়া হয় বলে অভিযোগ তাঁর পরিবার ও আইনজীবীদের। সাত মাস পর ২ মার্চ হুম্মামকে ধানমন্ডি এলাকায় ছেড়ে দেওয়া হয়। হুম্মামকে কারা তুলে নিয়েছিল, তা এখন পর্যন্ত জানা যায়নি। হুম্মামও আর মুখ খোলেননি।

হুম্মামকে তুলে নেওয়ার পাঁচদিন পর ৯ আগস্ট রাতে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ড হওয়া মীর কাশেম আলীর ছেলে আইনজীবী আহমেদ বিন কাশেমকে তাঁর মিরপুরের বাসা থেকে একদল লোক তুলে নিয়ে যায় বলে তাঁর স্ত্রী তাহমিনা আক্তার অভিযোগ করেন। এখন পর্যন্ত তাঁর খোঁজ পাওয়া যায়নি।

সম্প্রতি নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ফিরে আসা আইএফআইসি ব্যাংকের কর্মকর্তা শামীম আহমেদ, সরিষাবাড়ীর মেয়র রুকনুজ্জামান ও ব্যবসায়ী অনিরুদ্ধ রায় এত দিন কোথায় ছিলেন, সে বিষয়ে কিছুই বের করতে পারেনি পুলিশ।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে গুলশান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু বকর সিদ্দিক সাংবাদিককে বলেন, অনিরুদ্ধ পুলিশের সঙ্গে কথা বলতে চান না। তিনি গণমাধ্যমকে যে চিঠিটি দিয়েছেন, সেটিও পুলিশকে দেওয়া হয়নি।

মানবাধিকার কর্মী নূর খান বলেন, যাঁরা ফিরে আসছেন, তাঁরা হয়তো এমন একটা অবস্থার মধ্যে ছিলেন, যা তাঁদের সারাক্ষণ গ্রাস করে রাখে। ফিরে এসেও তাঁরা নিজেদের নিরাপদ ভাবতে পারছেন না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, অপহরণকারীদের শিখিয়ে দেওয়া বক্তব্যই তাঁরা দিতে বাধ্য হন।

গুম বা তুলে নিয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা অপরাধীদের জন্য অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি করছে উল্লেখ করে নূর খান বলেন, নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের পর সাধারণ মানুষ ক্রমান্বয়ে বিশ্বাস করছে যে এগুলোর সঙ্গে কোনো না কোনো সরকারি বাহিনী বা সংস্থার অভ্যন্তরের কোনো গোষ্ঠী জড়িত।

যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক আলী রীয়াজও সেই ভীতিকেই ফিরে আসা ব্যক্তিদের চুপ থাকার কারণ বলে মনে করেন। তাঁর মতে, রাষ্ট্র একটা কমিশন করতে পারে, যে কমিশন ফিরে আসা লোকগুলোর সঙ্গে কথা বলবে, তাঁদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। ফিরে আসা লোকগুলোর দেওয়া তথ্য কখনোই তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হবে না, এমন নিশ্চয়তা দেবে ওই কমিশন।-প্রথম আলো

পিএনএস/জে এ /মোহন

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন