রফতানি আয়ের নতুন দিগন্ত ‘পাট পাতার নির্যাস’

  07-12-2016 12:41AM

পিএনএস ডেস্ক : প্রথমবারের মতো পাট পাতার নির্যাস (জুট লিভস অ্যাসেন্স) রফতানি করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ভেষজ গুণাগুণও সমৃদ্ধ এ পণ্যটি আমদানি করবে জার্মানি। চা বা গ্রিন টি- এর বিকল্প হিসেবে পাট পাতার নির্যাস পানীয় সেবন করা যায়। বাংলাদেশের ওয়ার্সী এগ্রোটেক নামক একটি প্রতিষ্ঠান এ পণ্যটি রফতানি করবে। ফলে দেশে রফতানির আয়ের নতুন দিগন্ত উন্মোচন হতে যাচ্ছে। আগামী বছরের (২০১৭ সাল) জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি এ পণ্যটি রফতানি করা হবে।

নতুন এ রফতানিযোগ্য পণ্য চাষাবাদ করা হয় সারমুক্ত জমিতে। কিন্তু বাংলাদেশে পাট চাষের জন্য এ ধরনের জমি পাওয়া খুব কষ্টসাধ্য। ইতোমধ্যে এ সমস্যা সমাধানে ও খাতের উন্নয়নে ওয়ার্সী এগ্রোটেক প্রতিষ্ঠনকে জমি দিয়ে সহায়তা করছে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের আওতাভুক্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশন (বিজেএমসি)। ব্যাপক পরিসরে এ খাতের উন্নয়নে সরকারের সহায়তা খুব জরুরি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। একই সঙ্গে উন্নত বিজ, স্বল্প সুদে ঋণ সুবিধা ও বিভিন্ন অর্থিক প্রণোদনা পেলে এ খাতে বিনিয়োগে উদ্বুদ্ধ হবেন ব্যবসায়ীরা। অর্গানিক সার প্রয়োগে উৎপাদিত গাছ এবং পাতা বিশেষ প্রক্রিয়ায় সকল গুণাগুণ অক্ষুন্ন রেখে চাষ করা হয়।

আন্তর্জাতিক বাজারে জুট লিভস অ্যাসেন্সের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। ওই চাহিদার কথা বিবেচনায় রেখে এ পণ্যটি তৈরি করতে সক্ষম হয় ওয়ার্সী অ্যাকুয়া এগ্রোটেক। তিন বছরের অধিক সময় দেশে ও বিদেশে বিভিন্ন গবেষণাপত্র পর্যালোচনা করে প্রতিষ্ঠানটি সফলতা অর্জান করেছে। তবে অনুমোদন সংক্রান্ত জটিলতার কারণে দেশের অভ্যন্তরীন বাজারে নতুন এ পণ্যটি এখনই ছাড়া হচ্ছে না।

২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করার লক্ষ্যে বাজার সম্প্রসারণ ও পণ্যের বহুমূখীকরণের অংশ হিসেবে এ পাট পাতার নির্যাস রফতানির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

প্রাথমিক অবস্থায় পণ্যটি ২০০ কেজি রফতানি করা হবে। এর পর চাহিদা অনুযায়ী আরও বাড়ানো হবে। এর আগে জার্মানিতে পণ্যটির গুণগতমান পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে দেড় কেজি এবং পাবলিকের টেস্টিংয়ের জন্য ১৬ কেজি স্যাম্পল হিসেবে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ইতোমধ্যে পণ্যটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রফতানির বিষয়ে একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলোচনা শেষ পর্যায়ে রয়েছে। একই সঙ্গে মধ্যপ্রাচের বাজার ধরতে সৌদি আরবেও সঙ্গেও আলোচনা চলছে।

বাংলাদেশে পাট পাতার ব্যবহার দীর্ঘদিন আগ থেকেই হয়ে আসছে। এটি ঔষধি গুণ সমৃদ্ধ। পাট পাতায় বিটা ক্যারটিন, থিয়ামাইন বা এ, বি, সি এর মতো ভিটামিন। এ ছাড়া পাট পাতায় রয়েছে এন্টি অক্সিডেন্ট, যা প্রতিরোধ করে ক্যান্সারেরমতো দুরারোগ্য ব্যাধি। এ পাট পাতা ডায়াবেটিস রোগীর রক্তে শর্করা বেড়ে যাওয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে, ডায়াবেটিস রোগীর বার্ধক্যজনিত অন্ধত্বসহ অন্যান্য জটিল রোগের সম্ভাবনা কমিয়ে দেয়। বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় প্রমাণিত পাট পাতা পেটের পীড়া ও আলসার প্রতিরোধ করে। এতে থাকা প্রচুর অ্যান্টি অক্সিড্যান্ট মানব শরীরের দুর্বল কোষে ফ্রি রেডিক্যাল এর ক্ষতিকারক প্রভাব ফেলতে দেয় না ফলে ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা কমে। এটা নিয়মিত পান করলে কোলস্টরেল কমে, উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে।

পণ্যটির জৈব রাসায়নিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রতি ১০০ গ্রাম গুড়োতে ৪৩ থেকে ৫৮ ক্যালরি খাদ্যশক্তি, ৪.৫ থেকে ৫.৬ গ্রাম প্রোটিন, ১.৭ থেকে ২ গ্রাম ফাইবার, ৭.৬ থেকে ১২.৪ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট্স, ২.৪ গ্রাম অ্যাশ, ২৬৬ থেকে ৩৬৬ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম, ৯৭ থেকে ১২২ মিলিগ্রাম ফসফরাস, ১১.৬ মিলিগ্রাম লৌহ, ১২ মিলিগ্রাম সোডিয়াম, ৪৬৬ মিলিগ্রাম পটাসিয়াম, ৬,৩৯০ আইইউ (ইন্টারন্যাশনাল একক) ভিটামিন এ, ১৫ মিলিগ্রাম থায়ামিন (ভিটামিন বি-১), ২৮ মিলিগ্রাম রিবোফ্লাবিন (ভিটামিন বি-২), ১.৫ মিলিগ্রাম নিয়াসিন (ভিটামিন বি-৩), ৯৫ মিলিগ্রাম এসকরবিক এসিড।

অন্যান্য নিউট্রিশনগুলোর মধ্যে রয়েছে, ১ গ্রাম সুগার, ০.৭ মিলিগ্রাম ভিটামিন ই, ১০৮ মাইক্রোগ্রাম ভিটামিন কে, ০.৬ মিলিগ্রাম ভিটামিন বি-৬, ১০৪ মাইক্রোগ্রাম ফোলেট, ০.১ মিলিগ্রাম প্যানটোথেনিক এসিড, ১২.৮ মিলিগ্রাম কোলিন, ২ গ্রাম ডায়াটরি ফাইবার।

এ বিষয়ে ওয়ার্সী এগ্রোটেকের চেয়ারম্যান এইচ এম ঈসমাইল খান বলেন, ‘নতুন এ পণ্যটি রফতানি করতে পারলে বাংলাদেশ প্রচুর বৈদেশিক মূদ্রা অর্জন করতে সক্ষম হবে। একই সঙ্গে রফতানির আয়ের নতুন পথ উন্মোচিত হবে। এ জন্য আমাদের সর্বাত্মক চেষ্টা রয়েছে। পাট পাতা দিয়ে আমরা এখন শুধু জুট লিভস অ্যাসেন্স তৈরি করছি। ভবিষ্যতে আমরা এটা থেকে ট্যাবলেট, সাবান ও কসমেটিকস তৈরি করব।’

তিনি বলেন, ‘এ কাজের জন্য বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম ব্যক্তিগতভাবে আমাকে উৎসাহ প্রদান করেছেন। একই সঙ্গে তিনি বিষয়টি সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করেন এবং পরামর্শ দিয়ে থাকেন। আর সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের আওতাভুক্ত প্রতিষ্ঠান বিজেএমসি এ বিষয়ে সহায়তা করছে।’

নতুন বাজার সম্প্রসারণ ও পণ্যের বহুমূখীকরণের বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘নতুন পণ্য রফতানির বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সব সময় সক্রিয় ভূমিকা পালন করে আসছে। নতুন রফতানি নীতিমালা অনুযায়ী নতুন পণ্য বা খাতে ব্যবসায়ীদের উদ্বুদ্ধ করতে ক্যাশ ইনসেন্টিভ দেওয়া হয়ে থাকে। সে হিসেবে কেউ যদি নতুন পণ্য হিসেবে জুট লিভস অ্যাসেন্স বা পাট পাতার নির্যাস রফতানি করে থাকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হবে।’

এ দিকে ওয়ার্সী এগ্রোটেকের পণ্য ও গবেষণা দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ইসহাক ইবনে খান বলেন, ‘ভেষজ উপায়ে পাট চাষের জন্য জমি পাওয়া খুবই কষ্টকর। সারমুক্ত বা ভার্জিন জমি ছাড়া এ ধরনের চাষাবাদ কখনওই সম্ভব নয়। এ জন্য রিসার্চ ফিল্ড দরকার। আর রিসার্চ ফিল্ড কেবল সরকারই দিতে পারে। তাই ব্যাপক পরিসরে ভেষজ উপায়ে পাটের চাষ করতে হলে সরকারের সহায়তা খুব জরুরি।’

উল্লেখ্য, গত ৬ মার্চ সকালে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ‘পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন-২০১০ এর সফল বাস্তবায়ন উপলক্ষে সম্মাননা প্রদান এবং বহুমুখী পাটপণ্য মেলা উদ্বোধনকালে পাট পাতার নির্যাসের তৈরি চায়ের ভূয়সী প্রশংসা করেন প্রধানমন্ত্রী। মেলা পরিদর্শনকালে তিনি পাট থেকে তৈরি চায়ের স্টলে গিয়ে ফ্লেভার যুক্ত করার পরামর্শ দেন।

পিএনএস/হাফিজুল ইসলাম

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন