পড়ালেখার আনন্দ উধাও

  08-11-2017 05:15PM

পিএনএস ডেস্ক: প্রাথমিকের একটি শিশুর শরীরের ১০ শতাংশের বেশি ওজনের ব্যাগ বহনে আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকলেও মানে না কেউ রাজধানীর মিরপুরের একটি কিন্ডারগার্টেনে নার্সারিতে পড়ে তাহমিদ। পাঁচ বছরের এই শিশুকে পড়তে হচ্ছে ১৩টি বই।

সোনামনিদের বাংলা পড়া, অক্সফোর্ড এবিসি, স্পন্দন গণিত শেখা, বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়, জেনারেল নলেজ, অক্সফোর্ড নার্সারি রাইমস, খোকাখুকুর প্রথম লেখা প্রথম শেখা, ইংরেজি হ্যান্ড রাইটিং, ছোটদের আরবি ও ইসলাম শেখা, ফুলকুঁড়িদের মজার ছড়া, চারুকারু ও ছবি আঁকা, আমার বই এবং এসো লিখতে শিখি—এই হচ্ছে বইগুলোর শিরোনাম। এ ছাড়া রয়েছে ১০টি খাতা ও পেনসিল বক্স। পানির ফ্লাক্স ও টিফিন বক্সও নিতে হয়। গত ডিসেম্বরে প্রাথমিকের একটি শিশুর শরীরের ১০ শতাংশের বেশি ওজনের ব্যাগ বহন নিষিদ্ধ করতে নির্দেশ দেন আদালত। পাঁচ বছর বয়সী তাহমিদের ওজন ২০ কেজি। সর্বোচ্চ দুই কেজি ওজনের ব্যাগ বহন করার কথা তার। কিন্তু প্রতিদিন তাকে অন্তত ছয়টি বই, আটটি খাতাসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র, ব্যাগ মিলে চার থেকে পাঁচ কেজি ওজন বইতে হয়।

তাহমিদের মা আয়েশা আক্তার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘১৩টি বইয়ের মধ্যে দুটি বিনা মূল্যের সরকারি বই। এই দুটি বইয়ে যা আছে বাকি ১১টি বইয়ের বিষয়বস্তুও প্রায় একই।

এর পরও সব বই আমার সন্তানকে পড়তে হয়। সকাল ৮টায় স্কুল শুরু হয়। ছেলেকে ঘুম থেকে উঠতে হয় সকাল ৭টায়। এত সকালে উঠে খেতে চায় না। এর ওপর কাঁধে চাপিয়ে দিতে বাধ্য হই চার কেজি ওজনের ব্যাগ। এ কারণে মাঝে মধ্যে সে স্কুলেই যেতে চায় না। মনমরাও থাকে। ’

রাজধানী ঘুরে দেখা যায়, ভারী ব্যাগ শিশুরা বহন করতে পারে না বলে পথে অনেক মা-বাবার কাঁধে থাকে সন্তানের ব্যাগ। স্কুল গেট থেকে ভারী ব্যাগটি শিশুকেই কাঁধে তুলতে হয়। স্কুল শেষে ক্লান্ত শরীরেই ভারী ব্যাগ নিয়ে বেরোতে হয় শিশুটিকে। এ সময় অনেক শিশুকে ঝুঁকে পড়তে দেখা যায়। অভিভাবরাও আগেভাগে কাঁধ থেকে ব্যাগ নেওয়ার চেষ্টা করেন। তবে যারা স্কুলভ্যান বা অন্য যানবাহনে অভিভাবকদের ছাড়া যায় সেসব শিশুকে পুরোটা সময়ই বইতে হয় ব্যাগের বোঝা।

জাতীয় শিক্ষানীতিতে খেলা ও আনন্দেরছলে শিশুদের পড়ানোর কথা রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে তা দেখা যায় না। বইয়ের ভারে ক্লান্ত থাকে ছোট্ট শিশুরা। বাসায়ও মুক্তি মিলছে না তাদের। স্কুল থেকেই দেওয়া হচ্ছে একগাদা বাড়ির কাজ। তা নিয়েই কেটে যাচ্ছে বিকেল ও রাত। পরদিন সকালেও আবার স্কুল। স্কুলে গিয়ে যে একটু খেলাধুলা করবে সে উপায়ও নেই। বেশির ভাগ স্কুলেই নেই খেলার মাঠ। তাই ঘর-স্কুল সবখানেই বন্দি থাকতে হচ্ছে চার দেয়ালে। এভাবেই আনন্দহীনভাবেই প্রাথমিক শিক্ষা শুরু করছে শিশুরা।

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) প্রাক-প্রাথমিকের জন্য একটি বই, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে তিনটি করে এবং তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ছয়টি করে বই নির্ধারণ করেছে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এগুলোই পড়ানো হলেও তাতে আনন্দের ছিটেফোঁটাও নেই। খেলারছলে, গানের মাধ্যমে বা বিভিন্ন পন্থায় শিশুদের পড়ানোর কথা থাকলেও তা হচ্ছে না। শহর এলাকার সরকারি স্কুলে কোনো রকমে সিলেবাস শেষ করার চেষ্টায় থাকেন শিক্ষকরা। মফস্বল এলাকার অবস্থা আরো ভয়াবহ। শিক্ষকরা ঠিকমতো ক্লাসে আসেন না। শিক্ষার্থীরা না এলেও কোনো খোঁজখবর নেওয়া হয় না। কোনো রকমে শেষ হয় স্কুলের সময়। আনন্দ তো দূরের কথা।

এ ছাড়া কিন্ডারগার্টেনে শিশুদের পড়তে হচ্ছে পাঁচ-ছয় গুণেরও বেশি বই। সহায়ক বইয়ের ভারে ক্লান্ত হয়ে পড়ছে শিশুরা। প্লে অথবা নার্সারির একজন শিক্ষার্থীকে বাংলা তিনটি, ইংরেজি তিনটি, গণিতে তিনটি, একটি ড্রইং, একটি সাধারণ জ্ঞান ও একটি ধর্ম শিক্ষাসহ মোট বই ১২টি বই পড়তে হয়। শুধু ১২টি বই দিয়েই শেষ নয়, রয়েছে পৃথক ক্লাস, অ্যাসাইনমেন্ট ও টেস্ট পরীক্ষা। পরবর্তী ধাপে বেড়ে যায় আরো দু-তিনটি বই।

সংশ্লিষ্টরা জানান, কিন্ডারগার্টেনে বইয়ের অতিরিক্ত প্রতিটি বিষয়ের সি ডাব্লিউ (ক্লাস ওয়ার্ক) ও এইচ ডাব্লিউ (হোম ওয়ার্ক)-এর খাতা ব্যাগের বোঝা বাড়িয়ে দিচ্ছে। বই কম নেওয়া গেলেও আট-দশটি খাতা ঠিকই নিতে হচ্ছে। তবে ভারতসহ বিভিন্ন দেশে প্রাথমিক শুরুর পূর্বে শিশুদের ব্যাগই বহন করতে হয় না। অর্থাৎ প্লে থেকে কেজি শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা স্কুলেই হয় এবং সবকিছু স্কুলেই থাকে। এ ছাড়া অন্যান্য দেশে প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের জন্য স্কুলে লকারের ব্যবস্থা রয়েছে। প্রতিটি শিশুর জন্য আলাদা লকার থাকে। যেখানে শিক্ষকরা বেশির ভাগ বই-খাতা রেখে দেন। আর স্কুলেই পড়া শেষ করিয়ে দেন। ফলে পড়ার চাপ থাকে না শিশুদের।

শিক্ষাবিদ ও গবেষক অধ্যাপক ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ বলেন, ‘কোর্ট সিম্বলিকভাবে যথার্থ কথাই বলেছেন। কিন্তু আমাদের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থাই একটা অবৈজ্ঞানিক চিন্তা। শিক্ষা মানে এই নয় যে, অনেক বইপত্র পড়তে হবে, সর্ববিদ্যায় শিক্ষিত হতে হবে। আসলে একটি শিশুর হাসতে হাসতে খেলতে খেলতে শেখা উচিত। তবে এখনকার শিক্ষাব্যবস্থা যন্ত্র বানিয়ে দিয়েছে। কোর্ট সেই যন্ত্র থেকে মুক্তি দিতে চেয়েছেন। তবে দুঃখজনক—কোর্টের কেন এটা বলতে হবে? তাহলে আমাদের নীতিনির্ধারকরা কী করেন?’

পিএনএস/কামাল

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন