পরিবহন ধর্মঘট: উত্তরাঞ্চল ও সিলেটের ২০ জেলায় ভোগান্তি

  22-05-2017 06:48AM


পিএনএস ডেস্ক: সড়ক-মহাসড়কে শৃঙ্খলা আনতে সরকার উদ্যোগ নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পরিবহন খাতের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের ইন্ধনে দেশের বিভিন্ন স্থানে ধর্মঘট ডাকা শুরু হয়েছে। আগামী মাসে ঈদুল ফিতরের পর আবারও ধর্মঘট ডাকা হবে। পরিবহন খাতের সঙ্গে যুক্ত শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সঙ্গে আলাপকালে এ তথ্য জানা গেছে।

সূত্র মতে, প্রকাশ্যে বিভিন্ন দাবি আদায়ের নামে ধর্মঘট ডাকা হলেও তাঁদের উদ্দেশ্য মূলত প্রস্তাবিত সড়ক পরিবহন আইনে নিরক্ষরদের ড্রাইভিং লাইসেন্স না দেওয়া এবং বিভিন্ন অপরাধে জরিমানার কড়া বিধান বাতিলের জন্য সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা।

গতকাল রবিবার উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় পণ্য পরিবহন ও সিলেট বিভাগের চার জেলায় সব ধরনের পরিবহন ধর্মঘটে জনভোগান্তি ছিল চরমে। যদিও বিকেলে সিলেট অঞ্চলে ধর্মঘট প্রত্যাহার করা হয়। কিন্তু উত্তরাঞ্চলে পণ্য পরিবহন ধর্মঘট মঙ্গলবার ভোর ৬টা পর্যন্ত ডাকা হয়েছে।

সড়ক-মহাসড়কে পুলিশের হয়রানি বন্ধ, গাড়ির বাম্পার, সাইড অ্যাঙ্গেল ও হুক খোলার সরকারি আদেশ অবিলম্বে প্রত্যাহারসহ সাত দফা দাবি আদায়ে গতকাল ভোর ৬টা থেকে উত্তরাঞ্চলে পণ্য পরিবহন ধর্মঘট শুরু করে উত্তরবঙ্গ ট্রাক, ট্যাংক লরি, কাভার্ড ভ্যান ও পিকআপ মালিক শ্রমিক ঐক্য পরিষদ।

সকাল থেকেই বিভিন্ন মহাসড়কে অবস্থান নেয় মালিক-শ্রমিকরা। মহাসড়কগুলোয় পণ্যবাহী ট্রাকজট তৈরি হয়। ঢাকা থেকে পণ্যবাহী ভারী যানবাহন চলাচল করলেও শ্রমিকদের বাধার মুখে সেগুলো উত্তরের বিভিন্ন জেলায় বা আন্তজেলা ট্রাক টার্মিনালে নিয়ে রাখা হয়। বগুড়া-ঢাকা ও বগুড়া-রংপুর মহাসড়কে শত শত পণ্যবোঝাই ট্রাকসহ অন্যান্য পণ্যবাহী গাড়ি আটকে থাকে। দেশের বৃহত্তর খাদ্যভাণ্ডার নওগাঁয় ট্রাক টার্মিনালে শত শত মালবোঝাই ট্রাক, ট্যাংক লরি, কাভার্ড ভ্যান ও পিকআপ আটকা পড়ে। এতে করে দেশের কোনো স্থানে ধান-চাল আনা-নেওয়া করতে পারছেন না মিলাররা।

সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর বাঘাবাড়ী বন্দর থেকে জ্বালানি তেলসহ কোনো প্রকার পণ্য পরিবহন হয়নি।

উত্তরবঙ্গ ট্যাংক লরি শ্রমিক ইউনিয়ন, বাঘাবাড়ী ঘাট শাখার সাধারণ সম্পাদক রমজান আলী শেখ জানান, ধর্মঘটের কারণে গতকাল বাঘাবাড়ী নৌবন্দর ও বাঘাবাড়ী অয়েল ডিপো থেকে কোনো প্রকার পণ্য বা জ্বালানি তেল পরিবহন হয়নি।

বাঘাবাড়ী বন্দর সূত্রে জানা গেছে, ধর্মঘটের কারণে ব্যবসায়ীরা বিপাকে পড়েছেন।

ধর্মঘট আহ্বানকারীরা জানায়, দাবি আদায় না হলে রমজান ও ঈদের পর লাগাতার ধর্মঘটের কর্মসূচি দেওয়া হবে। এর আগে পুলিশের মহাপরিদর্শকের সঙ্গে কাগজপত্র ও ড্রাইভিং লাইসেন্স পরীক্ষার নামে সড়ক, মহাসড়কে পুলিশের হয়রানি, বাম্পার, সাইড এঙ্গেল ও হুক খোলার আদেশ প্রত্যাহার বিষয়ে একটি বৈঠক হয়েছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো সুরাহা হয়নি।

বগুড়া আন্তজেলা ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক খলিলুর রহমান বলেন, প্রতিটি জেলায় ট্রাফিক সার্জেন্ট ও মহাসড়ক পুলিশ নিয়মিত মাসিক হারে চাঁদা আদায় করে। এ জন্য বিশেষ টোকেন, আবার কোথাও কোথাও সার্জেন্টরা ডায়েরিতে এসব গাড়ির নম্বর লিখে রাখেন। রাস্তায় কাগজপত্র যাচাইয়ের নামে হয়রানি বন্ধ হচ্ছে না।

উত্তরবঙ্গ ট্রাক ট্যাংক লরি, কাভার্ড ভ্যান ও পিকআপ মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদ অধিকার আদায় ও বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়ক আবদুল মান্নান আকন্দ জানান, সাত দফা মেনে নিয়ে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করার দাবিতে ৪৮ ঘণ্টার ধর্মঘট ডাক দেওয়া হয়েছে।

সিরাজগঞ্জ জেলা ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক নামদার হোসেন বলেন, ‘সাত দফা আমাদের বৈধ দাবি। ’

সিরাজগঞ্জ জেলা ট্রাক ও ট্যাংক লরি মালিক গ্রুপের সভাপতি ও উত্তরবঙ্গ ট্রাক, ট্যাংক লরি, কাভার্ড ভ্যান ও পিকআপ মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদের সদস্য সচিব নূর কায়েম সবুজ বলেন, ‘সাত দফা দাবি আদায়ে আমরা প্রায় এক মাস ধরে বিভিন্ন কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছি। এর মধ্যে জেলা প্রশাসককে স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছে। কর্মবিরতির আগাম ঘোষণা দিয়ে বিভিন্ন জেলায় পোস্টার লাগানো হয়েছে। এর পরও সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের সঙ্গে কোনো আলোচনায় বসা হয়নি। ’ দাবি না মানলে পরবর্তী সময়ে তাঁরা কঠোর আন্দোলনে নামবেন বলে জানালেন এই নেতা।

সিলেটে যাত্রী ভোগান্তি : গতকাল সকাল থেকে শুরু হওয়া ধর্মঘটের কারণে সিলেট নগরসহ জেলার সব রুটে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। সিলেট জেলা সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের ডাকা অনির্দিষ্টকালের পরিবহন ধর্মঘটে গতকাল দিনভর সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে সাধারণ মানুষকে। পাঁচ দফা দাবিতে এই ধর্মঘট ডাকে সংগঠনটি।

ধর্মঘটের কারণে সকাল থেকে সিলেটের কদমতলী এলাকায় কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল থেকে দূরপাল্লার কোনো বাস ছাড়েনি। যাত্রীরা বাস টার্মিনালে গিয়ে বিপাকে পড়ে। সিএনজিচালিত অটোরিকশা সীমিতসংখ্যক চলাচল করলেও লেগুনাসহ অন্য পরিবহন বন্ধ ছিল। ফলে সাপ্তাহিক ছুটির পর প্রথম কর্মদিবসে ভোগান্তিতে পড়ে অফিসগামী যাত্রীরা। বাধ্য হয়ে অনেকে হেঁটে গন্তব্যের উদ্দেশে যাত্রা করে। এ ছাড়া সিলেটে অবস্থানরত পর্যটকদেরও নিজ নিজ গন্তব্যে ফিরতে দুর্ভোগের শিকার হতে হয়। বাস বা অন্য পরিবহন না থাকায় চাপ পড়ে ট্রেনের ওপর। রেলস্টেশনে টিকিটের জন্য যাত্রীদের দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে।

সকাল থেকেই পরিবহন শ্রমিকরা নগরের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নেয়। যেকোনো ধরনের যানবাহন নগরে প্রবেশ করতে তারা বাধা দেয়। দক্ষিণ সুরমার চণ্ডিপুল, এমসি কলেজ গেট, কুমারগাঁও বাসস্ট্যান্ড-সংলগ্ন তেমুখী পয়েন্টে শ্রমিকরা যান চলাচলে বাধা দেয়। এই সুযোগে নগরে রিকশাচালকরা যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় শুরু করে।

ধর্মঘট প্রসঙ্গে সিলেট জেলা পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি সেলিম আহমদ ফলিক বলেন, ‘মহান মে দিবসে আমাদের মিছিলে শ্রমিক লীগ নেতা এজাজুল হক এজাজের অনুসারীরা অটোরিকশা ভাঙচুর করে। এ ঘটনায় উল্টো আমাদের বিরুদ্ধেই থানায় মামলা করা হয়। ’ তিনি বলেন, তাঁরা এই মামলা প্রত্যাহার এবং জেলা শ্রমিক লীগ সভাপতি এজাজুল হক এজাজের ট্রেড ইউনিয়নের নিবন্ধন বাতিলসহ পাঁচ দফা দাবিতে গত ১১ মে বিভাগীয় কমিশনারের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছেন। কিন্তু প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাঁদের দাবি পূরণে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ফলে বাধ্য হয়ে তাঁরা ধর্মঘটের ডেকেছেন।

এদিকে গতকাল বিকেল ৪টার দিকে সিলেট মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. গোলাম কিবরিয়ার সঙ্গে বৈঠকের পর ধর্মঘট আজ সোমবার বিকেল ৪টা পর্যন্ত স্থগিত করা হয়। পুলিশের পক্ষ থেকে শ্রমিকদের দাবি পূরণের ব্যাপারে আশ্বাস দেওয়ার পর শ্রমিক ইউনিয়ন ধর্মঘট স্থগিতের ঘোষণা দেয়।

শ্রমিক ইউনিয়নের নেতা সেলিম আহমদ ফলিক ধর্মঘট স্থগিতের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘আজ বিকেল ৪টায় বিভাগীয় কমিশনার আমাদের নিয়ে বৈঠক করবেন। ওই বৈঠকে আমাদের দাবি পূরণে কোনো উদ্যোগ নেওয়া না হলে পুনরায় ধর্মঘট আহ্বান করা হবে। ’

মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (গণমাধ্যম) জেদান আল মুসা বলেন, ‘আমরা শ্রমিকদের দাবিগুলো বিবেচনার আশ্বাস দিয়েছি। আমাদের আশ্বাসে তারা ধর্মঘট প্রত্যাহার করেছে। আগামীকাল বিকেলে এ ব্যাপারে বিভাগীয় কমিশনারের সঙ্গে আবার বৈঠকে বসা হবে। ’

(প্রতিবেদনটির জন্য তথ্য দিয়েছেন সিলেট অফিস থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক, বগুড়া থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক, হবিগঞ্জ, নওগাঁ, শাহজাদপুর ও সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি)

পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন