স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল মর্যাদায় বাংলাদেশ মার্চেই

  14-12-2017 08:48AM

পিএনএস ডেস্ক: গরিব দেশের তকমা আর নয়, নয় তলাবিহীন ঝুড়ির গল্পও। স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায়ও থাকছে না বাংলাদেশ।

সব শর্ত পূরণ করে জাতিসংঘের কাছ থেকে উন্নয়নশীল দেশে পৌঁছানোর সক্ষমতা অর্জন করার ঘোষণা পাওয়ার অপেক্ষায় ক্ষণ গণনা শুরু করেছেন সরকারের নীতিনির্ধারকরা। আগামী মার্চেই সেই মাহেন্দ্রক্ষণ আসতে পারে। জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসির (ইউএনসিডিপি) ত্রিবার্ষিক পর্যালোচনাসভায় আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা মিলতে পারে—উন্নয়শীল দেশে উত্তীর্ণ হওয়ার সব শর্ত পূরণ করেছে বাংলাদেশ। জানা যায়, গত অক্টোবরে বাংলাদেশ সফরে আসা ইউএনসিডিপির উচ্চপর্যায়ের একটি প্রতিনিধিদল ফিরে গিয়ে সদর দপ্তরে দাখিল করা প্রতিবেদনে বাংলাদেশের জন্য এমন ‘সুখবরের’ কথা বলেছে। তবে সুখবরের সঙ্গে শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধাসহ আরো বেশ কিছু সুবিধা হাতছাড়া হবে বাংলাদেশের। সেসব সমস্যা কাটাতে একটি জাতীয় টাস্কফোর্স গঠন করা হচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রীর সাবেক মুখ্যসচিব ও প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক আবুল কালাম আজাদ বলেন, ইউএনসিডিপির প্রতিনিধিদল ফিরে গিয়ে যে প্রতিবেদন দাখিল করেছে, তাতে বলা হয়েছে—স্বল্পোন্নত (এলডিসি) দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের তিনটি সূচকের সবগুলোই বাংলাদেশ অতিক্রম করেছে। তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশ মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ সূচক (এইচএআই) ও অর্থনৈতিক সংকট সূচক (ইভিআই) জাতিসংঘের দেওয়া লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করেছে। তিনটি সূচকের যেকোনো দুটি সূচক পূরণ করলেই স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উন্নীত হওয়া যায়।

আগামী বছরের মার্চ মাসে ইউএনসিডিপির ত্রিবার্ষিক বৈঠকে বাংলাদেশ এলডিসি স্ট্যাটাস থেকে উত্তরণে সুপারিশ লাভ করবে।

পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ড. শামসুল আলম গতকাল বলেন, ‘বাংলাদেশ যে এলডিসি থেকে উত্তরণের যোগ্যতা অর্জন করেছে, তা আমরা জাতিসংঘকে জানিয়ে এসেছি। তারাও হিসাব করে দেখেছে যে বাংলাদেশ তিনটি শর্তই পূরণ করেছে। আগামী মার্চে জাতিসংঘের সিডিপির বৈঠকে বাংলাদেশকে এলডিসি থেকে উত্তরণের সুপারিশ আসতে পারে। ’ সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, এলডিসি স্ট্যাটাস থেকে উত্তরণের রোডম্যাপ বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণের জন্য একটি জাতীয় টাস্কফোর্স গঠন করা হবে। উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হলে কোন ধরনের অসুবিধা দেখা দিবে তার একটি ধারণাপত্র আগামী তিন মাসের মধ্যে প্রণয়ন করা হবে। এটি করবে ইআরডি ও বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই)।

জানা যায়, এলডিসি স্ট্যাটাস থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ নিয়ে গত ২২ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে আবুল কালাম আজাদের সভাপতিত্বে একটি বৈঠক হয়েছে। তাতে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সচিব কাজী শফিকুল আযম বলেন, গত ৯ থেকে ১২ অক্টোবর ইউএনসিডিপি সচিবালয়ের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফর করে। ওই সময় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও ইউএনডিসিপির মধ্যে এলডিসি থেকে বাংলাদেশের উত্তরণে তিনটি নির্ণায়কের মানের ব্যবধান হ্রাস পেয়েছে। সফর শেষে ইউএনসিডিপির প্রতিবেদনে তিনটি সূচকের সবটাতেই বাংলাদেশ নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করেছে মর্মে মন্তব্য সন্নিবেশ করেছে। ফলে আগামী মার্চ মাসে অনুষ্ঠেয় ইউএনসিডিপির ত্রিবার্ষিক পর্যালোচনা (ট্রাইনিয়াল রিভিউ) বাংলাদেশ এলডিসি স্ট্যাটাস থেকে উত্তরণে সুপারিশ লাভ করবে বলে আশা করা যায়।

জাতিসংঘের প্রতিনিধিদলটি আসার আগে গত ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও ইআরডি থেকে দুটি প্রতিনিধিদল জাতিসংঘে যায়। সেখানে বাংলাদেশ যে এলডিসি থেকে উত্তরণের শর্ত পূরণ করেছে, সেগুলো তুলে ধরে তারা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, এলডিসি থেকে কোন কোন দেশ উন্নীত হবে, সে সিদ্ধান্ত হবে ইউএনসিডিপির ২০১৮ সালের মার্চের বৈঠকে। শর্তপূরণ করা স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে উন্নীত করার বিষয়টি বিবেচনা করবে সংস্থাটি। আগামী নির্বাচনের আগেই তিনটি শর্ত পূরণ করা বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার পথে থাকা দেশের তালিকায় রাখতে চায় সরকার। সংস্থাটির পরের বৈঠক হবে ২০২১ সালে। এই তিন বছর তিনটি সূচকে পিছিয়ে না পড়লে ২০২৪ সালে জাতিসংঘের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি পাবে বাংলাদেশ। তবে এলডিসি হিসেবে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও অন্যান্য ক্ষেত্রে বিদ্যমান সুবিধা ২০২৭ সাল পর্যন্ত ভোগ করতে পারবে বাংলাদেশ।

জাতিসংঘের শর্তানুযায়ী, কোনো দেশ এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হতে হলে পর পর তিন বছর মাথাপিছু জাতীয় আয় (জিএনআই) এক হাজার ২৪২ ডলার হতে হবে। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের গড় মাথাপিছু আয় ১৬১০ ডলার। আর জাতিসংঘের শর্তানুযায়ী, মানবসম্পদ উন্নয়ন সূচকে ১০০-এর মধ্যে ৬৬ বা তার বেশি অর্জন করতে হয়, বাংলাদেশের অবস্থান ৭০-এ। আর অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচকে ৩২ বা তার নিচে থাকার শর্ত রয়েছে। বাংলাদেশের অবস্থান ২৫.০৩-এ। বিবিএসের এসব তথ্যের সঙ্গে জাতিসংঘের তথ্যের কিছুটা ফারাক ছিল। ইউএনসিডিপির প্রতিনিধিদের সফরের সময় উভয় পক্ষের আলোচনায় এই ফারাক কমে গেছে।

এলডিসি হিসেবে বাংলাদেশ ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডা, জাপান, অস্ট্রেলিয়াসহ এশিয়া-আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে বিনাশুল্কে রপ্তানি সুবিধা পাচ্ছে। বাংলাদেশের ৩৪ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয়ের ২৭ বিলিয়ন ডলারই আসে এসব দেশ থেকে। এ ছাড়া, স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা থেকে কম সুদে বা বিনা সুদে ঋণ সহায়তা পেয়ে থাকে। উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হলে চড়া সুদে ঋণ নিতে হবে। ২০২৭ সালের পর আন্তর্জাতিক বাণিজ্যসহ নানা ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সুবিধা কমে যাবে।

এলডিসি থেকে উত্তরণের পরও ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান, কানাডাসহ বর্তমানে যেসব দেশ বাংলাদেশকে জিএসপি সুবিধা দিচ্ছে, সেসব দেশ এ সুবিধা বহাল রাখবে বলে সম্প্রতি আশা ব্যক্ত করেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এ প্রসঙ্গে আগে বলেছেন, ৪০ বছর ধরে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় রয়েছে। এখান থেকে বেরিয়ে আসাটা এক ধরনের প্রমোশন ও সন্তুষ্টির বিষয়। এ ধরনের স্বীকৃতিতে আত্মগরিমা বাড়ে। তিনি বলেন, উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের পর উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে নেওয়া ঋণের সুদ বেড়ে যাবে। ২০১৫ সালে বিশ্বব্যাংকের বিবেচনায় বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশের খ্যাতি অর্জন করার পরপরই অনেক দেশ ও সংস্থা তাদের ঋণের সুদ বাড়িয়ে দিয়েছে বলেও জানান অর্থমন্ত্রী।

এসডিজির মুখ্য সমন্বয়ক আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘২০২৭ সালের পর আমরা আর এলডিসির সুবিধা পাব না। তবে ওই সময় যাতে আরো ভালো কোনো সুবিধা পেতে পারি, সে জন্য চেষ্টা চলছে। আমরা বিশ্বাস করি, একটি সুবিধা বন্ধ হলে ১০টি সুবিধার দুয়ার খুলবে। ’

পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ড. শামসুল আলম বলেন, ‘সুপারিশ পেলেও ২০২৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের এলডিসির সুবিধা থাকবে। এই এক দশকে বাংলাদেশও থমকে থাকবে না। অর্থনৈতিকভাবে অনেক এগিয়ে যাবে। রপ্তানিকারকরাও প্রতিযোগিতা সক্ষমতা অর্জন করবেন। তা ছাড়া, উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার পরও যাতে এখনকার মতোই জিএসপি সুবিধা পাওয়া যায়, সে জন্য চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। তাই রপ্তানি সুবিধা নিয়ে বড় উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। তবে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে ঋণ পেতে বেশি সুদ গুনতে হবে। ’ তিনি আরো বলেন, ‘উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তর হলে সুনামের পাশাপাশি বিনিয়োগ, বাণিজ্যে নতুন কিছু সুবিধাও পাওয়া যাবে। বিনিয়োগে বিদেশিদের আস্থা বাড়বে। তাই যত তাড়াতাড়ি বাংলাদেশ এলডিসি থেকে উন্নীত হবে, ততই মঙ্গল। ’

১৯৭১ সাল থেকে জাতিসংঘ বাংলাদেশসহ বিশ্বের স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে ‘এলডিসি’ তালিকায় রেখেছে। এসব দেশ নিয়ে জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠান আংকটাডের নেতৃত্বে সম্মেলন হয়েছে। সর্বশেষ ইস্তাম্বুলে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে এলডিসির অভিধায় থেকে বের হওয়ার জন্য কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে ২০২০ সাল পর্যন্ত সময় পায় দেশগুলো। ২০২০ সালের মধ্যে জাতিসংঘ স্বল্পোন্নত দেশের সংখ্যা ৪৮ থেকে অর্ধেকে নামিয়ে আনার চিন্তা করছে। সূত্র: কালের কণ্ঠ

পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন