সব নেতাকর্মীকে মাঠে নামাতে পারাই কঠিন

  16-11-2018 09:45AM


পিএনএস ডেস্ক: একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে দলীয় কোন্দল চিন্তায় ফেলেছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগকে। অভ্যন্তরীণ কোন্দল চরমে ওঠায় কোথাও ৫২, কোথাও ২৫, কোথাও ২১ জন দলীয় মনোনয়ন চেয়েছেন। ৩০০ আসনের বিপরীতে চার হাজার ২৩ জন মনোনয়নপ্রত্যাশীর চাপ দলটির সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ডের ওপর। নির্বাচনী জোটের শরিক দলগুলোকে আসন ছেড়ে দেওয়ার পর কমবেশি আড়াই শ আসনে দলীয় প্রার্থী দিতে পারবে আওয়ামী লীগ। প্রতি আসনে একজন করে প্রার্থী চূড়ান্ত করার পর এর পক্ষে মনোনয়নপ্রত্যাশী অন্য সবাইকে মাঠে নামাতে পারাই এবারের নির্বাচনে সবচেয়ে কঠিন কাজ বলে মনে করছেন দলটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর গুরুত্বপূর্ণ তিনজন সদস্য জানান, দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার কারণে তৃণমূলে দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে বিরোধ বেড়েছে। অনেক আসনে দলীয় এমপিদের সঙ্গে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের দূরত্ব অনতিক্রম্য পর্যায়ে পৌঁছেছে। ফলে সেখানে বর্তমান এমপিকে মনোনয়ন দিলে দলের অন্য সব নেতাকর্মীকে তার পক্ষে মাঠে নামানো কঠিন হবে। আবার অন্য কাউকে মনোনয়ন দিলে কঠিন হবে এমপির অনুসারীদের মাঠে নামানো। আর দলের নেতাকর্মীরা ঐক্যবদ্ধভাবে নৌকার পক্ষে না নামলে নির্বাচনে জয় পাওয়া কঠিন হবে।

জানা যায়, অন্তত অর্ধশত আসনে সংসদ সদস্যের অনুসারীদের সঙ্গে আওয়ামী লীগেরই বিরোধী পক্ষের নেতাকর্মীরা মুখোমুখি অবস্থানে আছে। বহু আসনে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের অবস্থান দলীয় সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে। দলীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের কাছে ওই সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে অসংখ্য লিখিত অভিযোগ জমা দিয়েছে দলের নেতাকর্মীরা। তাতে স্থানীয় সংসদ সদস্যদের দুর্নীতি, অনিয়ম, আওয়ামী লীগের বহু নেতাকর্মীর নির্যাতিত হওয়া, বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীদের পৃষ্ঠপোষকতা ও দলে ভেড়ানোর অভিযোগ তোলা হয়। বেশ কয়েকজন সংসদ সদস্যকে এলাকায় অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছে দলেরই স্থানীয় নেতাকর্মীরা। ফলে ওই সব আসনে বিবদমান নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ করে নৌকার পক্ষে মাঠে নামানো সম্ভব হবে কি না তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছে ক্ষমতাসীনরা।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্যাহ বলেন, ‘এবারের নির্বাচনে জয়ের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো অনেক প্রার্থী। প্রতিটি আসনে বহু প্রার্থী মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন। সারা দেশে চার হাজারের বেশি মনোনয়ন ফরম নিয়েছেন। এর মধ্যে যদি শতকরা ৭৫ ভাগ বাদও দিই এর পরও এক হাজারের মতো মনোনয়নের জোরালো দাবিদার থাকবে। সিট তো মাত্র আড়াই শ। কারণ জোটের শরিকদের সঙ্গে আসন ভাগাভাগি করতে হবে। ফলে এক প্রার্থী বেছে নেওয়া এবং তাঁর পেছনে অন্য মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মাঠে নামানো আমাদের জন্য সবচেয়ে কঠিন কাজ।’ তিনি আরো বলেন, ‘যেহেতু এবার সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন হচ্ছে সুতরাং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসরে তেমন কোনো চাপ নেই। এবার আমাদের মূল চ্যালেঞ্জ হলো দলীয় নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধভাবে নৌকার পক্ষে মাঠে নামানো।’

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘পর পর দুইবার আমরা ক্ষমতায় আছি। দেশের অনেক উন্নয়ন হয়েছে। মানুষের অর্থনৈতিক সামর্থ্য বেড়েছে। সবাই এখন এমপি হতে চায়। কেউ কারো নেতৃত্বে থাকতে চায় না। আমরা সবাইকে নৌকার পক্ষে মাঠে ঐক্যবদ্ধ রাখার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছি। জয় পেতে হলে সাংগঠনিক শৃঙ্খলা রক্ষায় এবার আমাদের খুবই কঠোর হতে হবে।’

আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ও সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের গত বুধবার মনোনয়নপ্রত্যাশীদের কঠোর বার্তা দিয়েছেন। দলে বিভেদের কারণে নির্বাচনে জিততে না পারলে দলের সভাপতির পদ ছেড়ে দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন শেখ হাসিনা। দলীয় প্রার্থীর পক্ষে মাঠে না নেমে বিরোধিতা করলে দল থেকে স্থায়ী বহিষ্কার করার হুমকি দিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক।

বিভিন্ন আসনে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের এমন কঠোর বার্তার পরও বিবদমান নেতাকর্মীদের মধ্যে সম্পর্কোন্নয়নের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। বরং প্রার্থী মনোনয়ন চূড়ান্ত হওয়ার পর বিবাদ আরো বাড়তে পারে। মনোনয়ন না পেয়ে অনেক নেতা ও তাঁর অনুসারীরা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়তে পারেন।

বিবাদ তুঙ্গে যেসব আসনে : বরগুনা-১ আসনে আওয়ামী লীগের ৫২টি মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করা হয়েছে। ওই আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকজন নেতা।

দিনাজপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য মনোরঞ্জন শীল গোপালের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন বীরগঞ্জ ও কাহারোল উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকরা। ওই আসনে মনোনয়ন ফরম বিক্রি হয়েছে ২১টি।

মাদারীপুর-৩ আসনে মনোনয়ন ফরম বিক্রি হয়েছে ১৬টি। আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ তিন নেতা ওই আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশী। তাঁরা হলেন সাবেক মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন, আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন (নাছিম) ও দপ্তর সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপ।

বরিশাল-৪ আসনের সংসদ সদস্য পংকজ নাথ, চুয়াডাঙ্গা-২ আসনের সংসদ সদস্য আলী আজগর টগর, চট্টগ্রাম-১৫ আসনের সংসদ সদস্য আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামউদ্দিনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে থাকা কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকজন নেতা মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন। এ ছাড়া বর্তমান এমপি কবিরুল হক (নড়াইল-১), আব্দুল ওদুদ (চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩), ওমর ফারুক চৌধুরী (রাজশাহী-১), মো. আয়েন উদ্দিন (রাজশাহী-৩), এনামুল হক (রাজশাহী-৪), মো. আব্দুল কুদ্দুস (নাটোর-৪), আ. মজিদ মণ্ডল (সিরাজগঞ্জ-৫), হাবিবুর রহমান স্বপন (সিরাজগঞ্জ-৬), আমানুর রহমান খান রানা (টাঙ্গাইল-৩), ফরিদুল হক খান দুলাল (জামালপুর-২), ইফতিকার উদ্দিন তালুকদার পিন্টু (নেত্রকোনা-৩), ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল (নেত্রকোনা-৫), সুকুমার রঞ্জন ঘোষ (মুন্সীগঞ্জ-১), হাবিবুর রহমান মোল্লা (ঢাকা-৫), আসলামুল হক (ঢাকা-১৪), এনামুর রহমান এনাম (ঢাকা-১৯), এম এ আউয়াল (পিরোজপুর-১) ও নিজাম হাজারীর (ফেনী-২) বিরুদ্ধেও আওয়ামী লীগের অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতা অবস্থান নিয়ে আছেন।

বরগুনা-১ আসনের এমপি প্রসঙ্গে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির বলেন, ‘আমাদের এমপি ব্যাপক দুর্নীতিবাজ। তাঁর রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি। এ দুর্নীতির কারণেই আমরা মূলত তাঁর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছি। তিনি দলের নেতাকর্মীদের মূল্যায়ন করেন না। চলেন জামায়াত-রাজাকারদের সঙ্গে নিয়ে। দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ নেই।’

বরিশাল-৪ আসনের এমপির প্রসঙ্গে কাজীরহাট উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য মেজর (অব.) মহসিন শিকদার বলেন, ‘স্থানীয় নেতাকর্মীরা বর্তমান এমপির ওপর ক্ষুব্ধ। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অনেক প্রার্থীই পরাজিত হয়েছেন এমপির বিরোধিতার কারণে। আগামী জাতীয় নির্বাচনে যদি আবারও পংকজ নাথ মনোনয়ন পান তবে অনেক নেতাকর্মীই তাঁর বিরুদ্ধে অনাস্থা দেবে।’ কাজীরহাট থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল জব্বার খান বলেন, ‘পংকজ আমাদের দলের নেতাকর্মীদের ওপর যে জুলুম নির্যাতন করছে, তা থেকে মুক্তি চাই। উনার সঙ্গে আমাদের ব্যক্তিগত কোনো দ্বন্দ্ব নেই। উনি আমাদের দলীয় কর্মকাণ্ডে কোনো সহযোগিতা করেন না, কোনো মিটিংয়ে আসেন না। উনার পয়সাপাতিতে লোভ বেশি।’

চুয়াডাঙ্গা-২ আসনের এমপি প্রসঙ্গে দামুড়হুদা থানা আওয়ামী লীগের সদস্য ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান শেখ নাজিম বলেন, ‘বর্তমান এমপি গত পাঁচ বছরে তেমন কোনো উন্নয়ন করতে পারেননি। তাঁর ভাই-ভাতিজারা এলাকায় টেন্ডারবাজি, দখলদারি চালাচ্ছে। কিছু নেতাকর্মী নিয়ে বর্তমান এমপি একটি বলয় গড়ে তুলেছেন। এ জন্য এলাকার বহু নেতাকর্মী তাঁর ওপর ক্ষুব্ধ।’

চট্টগ্রাম-১৫ আসনের এমপি প্রসঙ্গে সাতকানিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এম এ মোতালেব বলেন, ‘এমপি সাহেবের সঙ্গে দলের কোনো নেতাকর্মীর সম্পর্ক নেই। উনি আগে রাজনীতি করতেন না। রাজনীতি সম্পর্কে তাঁর ধারণাও নেই। গত পাঁচ বছরে আমাদের সাংগঠনিক কোনো কর্মকাণ্ডে তিনি সহযোগিতা করেননি। উল্টো দলের অনেক কাজে তিনি বাধা সৃষ্টি করেছেন। মামলা দিয়ে নেতাকর্মীদের হয়রানি করেছেন। এ জন্য স্থানীয় নেতাকর্মীরা সবাই ক্ষুব্ধ।’

দলীয় মেয়র-চেয়ারম্যানরা হতাশ : স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন নির্বাচনে জয় পাওয়া অনেক নেতারই স্বপ্ন থাকে পরবর্তী সময়ে জাতীয় নির্বাচনে দলের প্রার্থী হওয়া। সেই স্বপ্ন থেকেই এবার দলীয় মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন অনেক জেলা পরিষদ ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, পৌর মেয়র ও ইউপি চেয়ারম্যান। কিন্তু গত বুধবার মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় আওয়ামী লীগ সভাপতি জানিয়ে দেন স্থানীয় সরকারে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মনোনয়ন দেওয়া হবে না। এ ঘোষণায় স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে হতাশা দেখা দিয়েছে।

চুয়াডাঙ্গা থেকে নির্বাচিত একজন চেয়ারম্যান নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘স্থানীয় সরকারের কারো যদি জনপ্রিয়তা এমপির চেয়ে বেশি হয়, তাকে মূল্যায়ন করা উচিত। না হলে স্থানীয় ভোটার ও দলের নেতাকর্মী অনেকেই হতাশ হবে। দলের ভোট কমবে।’ হতাশা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আর মনোনয়ন যদি না-ই দেওয়া হবে, তবে তা ফরম সংগ্রহের আগে তো বলতে পারত। এতে ফরম কেনা ও নেতাকর্মীদের নিয়ে শোডাউনের টাকা ও সময় বেচে যেত।’

সিরাজগঞ্জ থেকে নির্বাচিত একজন চেয়ারম্যান নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘দল থেকে বলা হয়েছে একজনকে বারবার মূল্যায়ন করা যাবে না। কিন্তু আমার কথা হলো যদি কোনো চেয়ারম্যানের এমপি হওয়ার যোগ্যতা থাকে, তবে তাকে মূল্যায়ন করা উচিত। চেয়ারম্যান এমপি হলে তো সেই চেয়ারম্যানের জায়গায় দলের অন্য নেতাদের মূল্যায়ন করা যাবে।’ সূত্র: কালের কণ্ঠ

পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন