মুসলমানদের কী হবে : ইউরোপের দেশে দেশে উত্থান ট্রাম্প-ধাঁচের নেতাদের

  03-12-2016 08:46AM


পিএনএস ডেস্ক ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয়ই শেষ নয়। প্রচলিত রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতি জনমানুষের অসন্তোষ টোকা দিয়েছে ইউরোপকেও। অন্তত এমন আভাস পাওয়া যাচ্ছে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ঘনিয়ে আসা নির্বাচন থেকে। ইতিমধ্যে বৃটেনের ব্রেক্সিট ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের। ফ্রান্সে আসন্ন নির্বাচনে দক্ষিণপন্থিদের অবস্থা রমরমা। কট্টর ডানপন্থি ম্যারিন ল্য পেন তো আছেনই। মূলধারার রাজনৈতিক দল রিপাবলিকান পার্টির মনোনয়ন পেয়েছেন আরেক ডানপন্থি সাবেক প্রধানমন্ত্রী ফ্রাঁসোয়া ফিলন। নেদারল্যান্ডসে প্রধানমন্ত্রিত্বের দৌড়ে এগিয়ে আছেন কট্টর মুসলিমবিদ্বেষী ও অভিবাসনবিরোধী রাজনীতিক গ্রিট উইল্ডার্স। মুক্ত দুনিয়ার উদারপন্থার শেষ বাতিঘর জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেলের আসনও টলায়মান। এর বাইরে ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশে হালে পানি পাচ্ছেন জনতোষণবাদী নেতারা।

ইতালি


রোববার ইতালিতে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে গণভোট। প্রধানমন্ত্রী মাত্তেও রেঞ্জি কিছু সাংবিধানিক সংস্কারের প্রস্তাব দিয়েছেন। তার ওপরই অনুষ্ঠিত হবে এ গণভোট। এ সংস্কার পাস হলে রেঞ্জির সরকার আইন পাসে আরো ক্ষমতা পাবে। আর গণভোটে ‘না’ জয়ী হলে রেঞ্জির রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের ইতি ঘটবে তৎক্ষণাৎ। তিনি ইতিমধ্যে ঘোষণাও দিয়েছেন, ফলাফল পক্ষে না এলে পদত্যাগ করবেন। কিন্তু এরই মাঝে আবির্ভূত হয়েছেন পপুলিস্ট নেতা বেপ্পে গ্রিলো (৬৮)। অগোছালো চুল আর ক্ষেপাটে চেহারার এই ভদ্রলোক আবার বামপন্থি। ইউরোপের অন্যান্য জনতোষণবাদী নেতার সঙ্গে তার এখানটাতেই কেবল ফারাক। গ্রিলো (৬৮) সরকারবিরোধী ফাইভ স্টার মুভমেন্টের নেতা। তার আরেকটি বড় পরিচয় তিনি একজন খ্যাতনামা কমেডিয়ান। রাজনীতিতে নেমে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অভিন্ন মুদ্রা ইউরো বাতিলের প্রশ্নে গণভোট দাবি করেছেন। প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ক্ষমতায় গেলে এ গণভোট আয়োজন করবেন তিনি। ১৯৮০ সালে একবার এক গাড়ি দুর্ঘটনায় দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন গ্রিলো। বামপন্থি এই নেতা প্রচলিত রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিরোধী। কিন্তু তার কিছু নীতি ডানপন্থার সমার্থক। যেমন, তিনি অভিবাসন ও ইসলাম নিয়ে উগ্র ধারণা পোষণ করেন। নিজেকে ডনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে তুলনাও করেন। তার দলের সমর্থন আছে মোটাদাগে ৩০ শতাংশ। যা শাসক দল ডেমোক্রেটিক পার্টি থেকে সামান্য কম। দলটির এক প্রার্থী সম্প্রতি রাজধানী রোমের মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন। ইতালিতে এখন তরুণদের বেকারত্বের হার ৩৭.১ শতাংশ। এ বছর উত্তর আফ্রিকা থেকে রেকর্ড ১ লাখ ৭১ হাজার অভিবাসী পাড়ি জমিয়েছে দেশটিতে। তাই ফাইভ স্টারকে ভয়ই পাচ্ছে মূলধারার দলগুলো।

ফ্রান্স


ম্যারিন ল্য পেনকে ইতিমধ্যে ‘ফ্রান্সের ট্রাম্প’ উপাধি দেয়া হয়ে গেছে। তবে জনমত জরিপে দেখা যাচ্ছে, তিনি নন; বরং ফ্রান্সের রিপাবলিকান দলের প্রার্থীর সম্ভাবনাই সবচেয়ে বেশি। এ দলের প্রার্থী নির্বাচিত হয়েছেন ফ্রাঁসোয়া ফিলন। মোটামুটি মূলধারার এ প্রার্থী সাবেক প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু তিনি বেশ দক্ষিণপন্থি। অনেকে তাকে বৃটেনের লৌহমানবী খ্যাত সাবেক প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচারের সঙ্গে তুলনা করে ‘ফ্রান্সের থ্যাচার’ ডাকছেন। অর্থাৎ, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন এখন কার্যত এক দক্ষিণপন্থি ও আরেক উগ্র দক্ষিণপন্থির লড়াই। ফিলন ভূমিধস বিজয় পেয়ে রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থিতা আদায় করেছেন। অপরদিকে তার সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী ম্যারিন ল্য পেনের দল ন্যাশনাল ফ্রন্ট অনেক আগ থেকেই ফ্রান্সের উগ্র ডানপন্থিদের প্ল্যাটফর্ম। ব্রেক্সিট ধাঁচে তিনিও ফ্রান্সকে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে সরিয়ে আনার পক্ষে। এ নিয়ে গণভোটেরও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি। অপরদিকে ফিলন প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন আয়কর হ্রাস, সরকারি চাকরির সংখ্যা কমানো ও শ্রমিক ইউনিয়নের ক্ষমতা কমিয়ে আনার। তিনি শক্তিশালী ‘পারিবারিক মূল্যবোধে’র ডাক দিয়েছেন। ইসলামপন্থিদের ব্যাপারেও কড়া অবস্থান তার। বর্তমান অবস্থা বজায় থাকলে সহজেই ল্য পেনকে হারাবেন ফিলন।

জার্মানি


জার্মানিতে আবির্ভাব ঘটেছে ফ্রক পেট্রির। চার সন্তানের জননী ৪১ বছর বয়সী এ নেত্রী জার্মানির টানা তিনবারের চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেলের কড়া প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছেন। মার্কেল দুই বছর আগেও জার্মানিতে তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয়তা ভোগ করছিলেন। কিন্তু ইউরোপের শরণার্থী সংকটে অভিবাসীদের প্রতি তার ‘মুক্তদ্বার’ নীতি দেশে অত জনপ্রিয়তা পায়নি। বরং, অনেকের বিরাগভাজন হন মার্কেল। তবে ইউরোপের অন্যান্য দক্ষিণপন্থির তুলনায় ফ্রক পেট্রিকে কিছুটা উদার বলতেই হবে, যদিও জার্মানির মানদণ্ডে তিনি আসলেই কড়া ডানপন্থি। পেট্রি ঘোষণা দিয়েছেন, প্রতি বছর ২ লাখের বেশি আশ্রয়প্রার্থীকে নেবেন না তিনি। পাশাপাশি তার মত, সীমান্তে অভিবাসীদের দিকে গুলি ছোড়ার অধিকার থাকা উচিত পুলিশের। একবার এই নেত্রী বলেছিলেন, ‘জার্মানিতে ইসলামের কোনো স্থান নেই।’ তিনি মসজিদে সরকারি অর্থায়ন নিষিদ্ধ করতে চান। সাম্প্রতিক এক আঞ্চলিক নির্বাচনে তার কট্টরপন্থি দল অল্টারনেটিভ ফর জার্মানি (এএফডি) মার্কেলের ক্ষমতাসীন ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক পার্টিকে তৃতীয় স্থানে ঠেলে দিয়েছে।

অস্ট্রিয়া


অস্ট্রিয়ায় জনপ্রিয়তা পেয়েছেন নর্বার্ট হফার। রোববার দেশটিতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন পুনরায় অনুষ্ঠিত হবে। এ নির্বাচনে ফ্রিডম পার্টির প্রার্থী হলেন উগ্র-ডানপন্থি হফার। ধারণা করা হচ্ছে, নির্বাচন শেষে তিনিই জয়মাল্য পরবেন। আর তা ঘটলে, তিনি হবেন ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন (ইইউ) প্রতিষ্ঠার পর এর কোনো সদস্য রাষ্ট্রের প্রথম কট্টর ডানপন্থি রাষ্ট্রপ্রধান। মৃদুভাষী নর্বার্ট হফার (৪৫) রাজনীতিতে আসার আগে মধ্যবিত্ত প্রকৌশলী ছিলেন। চার সন্তানের জনক এই নেতা নিজের ‘সুরক্ষা’র জন্য সঙ্গে পিস্তল বহন করেন। তিনি বেশ রক্ষণশীল। সমকামী বিয়ে নিষিদ্ধ করতে চান, বোরখা পরিধান অবৈধ ও মসজিদে নজরদারি বাড়ানোর পক্ষে তার অবস্থান। অভিবাসনের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ব্রেক্সিটের মতো ইইউ থেকে অস্ট্রিয়ার প্রস্থানের একটি দাবি হালে পানি পেয়েছিল। ওই দাবিতে প্রথমে সমর্থন দিলেও পরে পিছু হটেন হফার। এ বছরের গোড়ার দিকের অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তিনি ৪৯.৭ শতাংশ ভোট পেয়েও হেরেছেন। গ্রিন পার্টির ইইউ-পন্থি প্রার্থী অ্যালেক্সান্ডার ভ্যান দার বেলেন ৫০.৩ শতাংশ ভোট পেয়ে সামান্য ব্যবধানে জিতেছেন। তবে কিছু অঞ্চলের ভোটের ফলাফল উচ্চ আদালত বাতিল করায় নির্বাচন আবার অনুষ্ঠিত হচ্ছে। দেশটির তরুণ বেকারত্বের হার ১১.৭ শতাংশ। গত বছর ৯০ হাজার অভিবাসী দেশটিতে প্রবেশ করেছে, যা দেশের মোট জনসংখ্যার ১ শতাংশ। ফলে হফারের সম্ভাবনা বেশ উজ্জ্বল।

নেদারল্যান্ডস


গ্রিট উইল্ডার্স হল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী পদে সবচেয় অগ্রগামী প্রার্থী। এই উগ্র ডানপন্থি নেতাকে ২০০৮ সালে বৃটেন থেকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। ইসলামবিরোধী ও ইইউ নিয়ে সংশয়বাদী তিনি। আগামী বসন্তে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে তার জয়ের সম্ভাবনাই সবচেয়ে বেশি। তিনি ‘নেদারল্যান্ডের ইসলামীকরণে’র বিরুদ্ধে লড়াই করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি মুসলিমদের পবিত্র গ্রন্থ কোরআন ও মসজিদ নিষিদ্ধ করতে চান। তিনি পবিত্র কোরআনকে হিটলারের আত্মজীবনী মেইন ক্যাম্ফের সঙ্গে তুলনা করেছেন। তার বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ উসকে দেয়ার অভিযোগে আদালতে মামলা হয়েছে। খুব দ্রুতই এ মামলার রায় আসবে। এতে মূলত তার একটি বক্তৃতাকে উপজীব্য করা হয়েছে। ওই বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, নেদারল্যান্ডে মরোক্কান অভিবাসীর সংখ্যা মাত্রাতিরিক্ত। ৩৩ শতাংশ সমর্থন নিয়ে জরিপে এগিয়ে আছে তার দল ফ্রিডম পার্টি।

সার্বিয়া


ইউরোপের অপর দেশ সার্বিয়ায় প্রেসিডেন্ট তমিস্লাভ নিকোলিকের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীতে পরিণত হয়েছেন কট্টর জাতীয়তাবাদী ভোজিস্লাভ সেসেলজ। এর আগে তিনি ছিলেন দেশের উপ-প্রধানমন্ত্রী। আসন্ন নির্বাচনে কট্টর ডানপন্থিদের প্রতিনিধিত্ব করবেন তিনি। তার দলের নামও অনেকটা ইঙ্গিতবাহী: সার্বিয়ান র্যাডিক্যাল পার্টি। বর্তমানে পার্লামেন্টের ২৫০টি আসনের মধ্যে ২২টি আসন দলটির দখলে। হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে দলটির বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ ছিল। তবে তারা ওই অভিযোগ থেকে রেহাই পেয়েছে। এ সিদ্ধান্তকে অনেক মানবাধিকার সংস্থা সমালোচনা করেছে। কেউ কেউ বলেছেন, ‘এটি জাতিগত নির্মূলের সমর্থকদের জন্য বিশাল বিজয়’। সেসেলজ ডনাল্ড ট্রাম্পের বড় ভক্ত। ট্রাম্প ‘বিশ্বায়নের বিকল্প’ বলেও মন্তব্য করেছেন সেসেলজ।

নরওয়ে


ইউরোপের সবচেয়ে সমৃদ্ধ ও উদারপন্থি দেশগুলোর একটি নরওয়ে। আর এখানেই উত্থান সিভ জেনসেনের। তিনি মার্গারেট থ্যাচারকে আদর্শ মানেন। তাকে বলাও হয় ‘নরওয়ের ম্যাগি থ্যাচার’। কট্টরপন্থি দল প্রোগ্রেস পার্টির নেত্রী তিনি। কথা বলেন কড়া ভাষায়। আগামী শরতে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে তিনি আরো ক্ষমতালাভের প্রত্যাশায় আছেন। বর্তমানে অর্থমন্ত্রীর পদে থাকা জেনসেন জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে আসছেন। ইসরাইলের কট্টর সমর্থক। অভিবাসন নিয়ন্ত্রণেরও পক্ষে তিনি। বহু-সংস্কৃতিবাদ বা সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের সমালোচক। ইউরোপের ‘বাধাহীন ইসলামীকরণে’র নিন্দা জানিয়েছেন জেনসেন। জরিপে দেখা যাচ্ছে, মধ্য-ডানপন্থি রক্ষণশীল শাসক জোটের বিরুদ্ধে তার দল সমানে সমান লড়ছে।

চেক রিপাবলিক


ডনাল্ড ট্রাম্পের মতো আন্দ্রেজ বাবিসও বেশ ধনী। এক আশ্চর্য কারণে তার সমর্থনও চেক রিপাবলিকের প্রান্তিক মানুষদের মাঝেই বেশি। প্রধানমন্ত্রী বোহুস্লাভ সোবোতকার মধ্য-বামপন্থি দল সোস্যাল ডেমোক্রেটরা জরিপে পিছিয়ে পড়েছে তাদেরই জোটসঙ্গী পপুলিস্ট দুর্নীতিবিরোধী দল এএনও’র কাছে। এই দলের প্রধান হলেন বিলিয়নিয়ার ব্যবসায়ী আন্দ্রেজ বাবিস, যিনি চেক রিপাবলিকের দ্বিতীয় শীর্ষ ধনী। বর্তমানে তিনি উপ-প্রধানমন্ত্রী। আগামী বছরের নির্বাচনে তার প্রধানমন্ত্রিত্ব অনেকটাই নিশ্চিত। গণমাধ্যম ও কৃষি-রাসায়নিক ব্যবসা আছে তার। তিনি নিজেকে উপস্থাপন করেছেন চেক শ্রমিকদের প্রতিনিধি হিসেবে, যাদের কিনা অভিবাসন ও জঙ্গিবাদী ইসলামের কাছ থেকে সুরক্ষা প্রয়োজন।
(ডেইলি মেইল অবলম্বনে)

পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন