গ্যাস সংকটে সরকার নিজেই যেখানে চ্যালেঞ্জ মনে করছেন

  21-02-2017 12:07PM


পিএনএস, এবিসিদ্দিক: গ্যাস সংকট বড় হয়েই দেখা দিচ্ছে। আর সরকারও এটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবেই মনে করছেন। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের ভাষ্য হচ্ছে-‘বর্তমানে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ৩২০০ মিলিয়ন ঘনফুট আর উৎপাদন হচ্ছে ২৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট। বর্তমান মজুদ ১৪ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন ঘনফুট।

আগামী দুই বছরের মধ্যে বর্তমান মজুদ হতে গ্যাস উৎপাদনের হার সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌছাবে। পরবর্তীতে বর্তমান মজুদ হতে গ্যাস উৎপাদনের হার দ্রুত হ্রাস পেতে থাকবে। সুতারাং উৎপাদন বৃদ্ধি ও নতুন গ্যাস আবিষ্কার এই মুর্হূতে গ্যাস সেক্টরের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। উল্লেখ্য কিছু কিছু ফিল্ডে উৎপাদন হ্রাস পেলেও কিছু কিছু ফিল্ডে আগামীতে উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে’। এই হলো সরকারি ভাষ্য। ভবিষৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে বলা হয়েছে ‘চাহিদা মেটানোর লক্ষ্যে ভূতাত্ত্বিক জরিপ ৫৭০ কিলোমিটার লাইন, দ্বিমাত্রিক জরিপ ১২০০ কিলোমিটার ও ২৮৪০ বর্গ কিলোমিটার ত্রিমাত্রিক জরিপ সম্পন্ন করা হবে’।

এছাড়া আরো বলা হয়েছে বাপেক্স কৃর্তক ২০২১ সালের মধ্যে ১০৮ টি কুপ খনন (৫৩ টি অনুসন্ধান ও ২০ টি ওয়ার্কওভার) পরিকল্পনা আছে। এসব কূপ থেকে দৈনিক ৯৪৩ থেকে ১১০৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়ার আশা করা যায়। এলএনজি আমদানির মাধ্যমে দৈনিক প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হবে। মহেশখালি ও পায়রায় ২ টি ১০০০ মিলিয়ন ঘনফুট ক্ষমতা সম্পন্ন টার্মিনাল স্থাপন করার কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে। ভারতের নুমালিগড় থেকে পাইপ লাইনের তেল আমদানি করা হবে। এই হলো গ্যাস নিয়ে সরকারের ভাষ্য। পেট্রোবাংলার গত নবেম্বর মাসের(এটাই তাদের সর্বশেষ রিপোর্ট) এম আই এস রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, গ্যাসের উৎপাদন কমছে। ২০১৬ সালের অক্টোবর মাসে গ্যাসের উৎপাদন ছিল ২৩৪৪ দশমিক ৯১৭ মিলিয়ন ঘনফুট যা নভেম্বরে ২২৫৭ দশমিক ১৪০ মিলিয়ন ঘনফুটে নেমে আসে। গত ৯ ফেব্রুয়ারীর রিপোর্টে দেখানো হয়-দৈনিক গ্যাসের উৎপাদন ২৭৪১ মিলিয়ন ঘনফুট। এরমধ্যে ৬০ শতাংশই উৎপাদন করছে আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানী(আইওসি)। এম আই্্ এস রিপোর্টে আরো বলা হয়-২০১৫-১৬ অর্থবছরে বিদ্যুৎ খাতে সরকারি ৩০ হাজার মিলিয়ন আর বেসরকারি বিদ্যুৎ খাতে ১৯৪৮ দশমিক ৭২১ মিলিয়ন ঘনফুট, সার উৎপাদনে ১৫২৫ দশমিক ৯২৬ মিলিয়ন ঘনফুট, ক্যাপটিভ পাওয়ারে ৪২৪৮ দশমিক ৬৩১ মিলিয়ন ঘনফুট,শিল্পে ৪১৮২ দশমিক ৯৪৫ মিলিয়ন ঘনফুট, বাণিজ্যিক ২৫৮ দশমিক ৩৭৪ মিলিয়ন ঘনফুট, চা-বাগানে ২২ দশমিক ৬৯৭ মিলিয়ন ঘনফুট, সিএনজিতে ১২১৫ দশমিক ঘনফুট আর গৃহস্থালীতে ৩৩৪৬ দশমিক ৭১৮ মিয়িলন ঘনফুট গ্যাস ব্যবহার হয়েছে।

আর গত অর্থবছরে কয়লার ব্যবহার ছিল ৮ লাখ ৩৬ হাজার ৩২২ দশমিক ৫০০ টন। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে আরো জানা যায়, চলতি ২০১৭ সালে গ্যাসের চাহিদা ধরা হয়েছে ১১৯১ বিলিয়ন ঘনফুট। ২০১৮ সালে ১২৩৯ বিলিয়ন ঘনফুট, ২০১৯ সালে ১২৫৮ বিলিয়ন ঘনফুট আর ২০২০ সালের চাহিদা ধরা হয়েছে ১২৭৬ বিলিয়ন ঘনফুট। বর্তমানে ২০ ক্ষেত্র থেকে গ্যাস উত্তোলন বা উৎপাদন হচ্ছে। উৎপাদনে যায়নি এমন ক্ষেত্র ৩ টি আর স্থগিত ২টি ক্ষেত্রের। পেট্রোবাংলার তথ্যমতে উত্তোলনযোগ্য গ্যাসের মজুদ ছিল ২৭ দশমিক ১২ ট্রিসিএফ(ট্রিলিয়ন ঘনফুট), গত ২০১৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত উত্তোলন হয়েছে ১৩ দমমিক ৪৮ টিসিএফ আর মজুদ আছে ১৩ দশমিক ৬৪ টিসিএফ। বর্তমানে সর্বাধিক গ্যাস ব্যবহার হয় বিদ্যুৎ খাতে ৫৮ দশমিক ৪০ শতাংশ। এর মধ্যে ক্যাপটিভ পাওয়ারে ১৭ দশমিক ৩ শতাংশ। এছাড়া শিল্পে ১৫ দশমিক ৯৮, গৃহস্থালীতে ১২ দশমিক ২৬, সার কারখানায় ৫ দশমিক ৩৮ শতাংশ, বাকিটা অন্যান্য খাতে।

গ্যাসের যে চাহিদা দেখানো হয়েছে বা হচ্ছে তা গ্রাহক ভিত্তিতে। প্রকৃত পক্ষে চাহিদা অনেক। গ্যাসের চাহিদা বাড়লেও সে তুলনায় উৎপাদন ন্ইে। সংকট ঘনিভূত হচ্ছে। গ্যাস সংকট মানেই গোটা অর্থনীতির সংকট। গ্যাস সংকট মানেই বিদ্যুৎ সংকট, সার সংকট, শিল্পায়ন সংকট, নতুন শিল্প না হওয়ার সংকট। শিল্পায়ন না হওয়া মানেই অর্থনীতির গতি স্থবির হয়ে যাওয়া, কর্মসংস্থান না হওয়া। বর্তমানে যে কয়টি ইউরিয়া সার কারখানা আছে সেগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ২৩ লাখ টন(বার্ষিক)। আর বার্ষিক প্রকৃত চাহিদাও ২২ থেকে সাড়ে ২২ লাখ টন। কিন্তু গ্যাস সংকটের কারণে কারখানা দিনের পর দিন আর মাসের পর মাস বন্ধ রাখতে হচ্ছে। ফলে ইউরিয়ার উৎপাদন ৯ লাখ থেকে সাড়ে ৯ হচ্ছে। বাকিটা আমদানি করতে হচ্ছে। গ্যাস সংকটের কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। অদুর ভবিষতে এর বড় ধরণের খেসারত দিতে হবে। গ্যাস সংকটের কারণে নতুন শিল্পায়ন নেই, বিনিয়োগেও স্থবিরতা। নতুন শিল্পায়নতো দুরের কথা, অনেক চালু শিল্প বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বা হয়ে গেছে। অবস্থাটা হয়েছে এমন যে, বিদ্যুৎ উৎপাদন্ কেন্দ্র চলেতো, সার কারখানা চলে না, সার কারখানা চলেতো বিদ্যুৎ কেন্দ্র চলেনা, আবার সিএনজি ষ্টেশনও মাঝে-মধ্যে বন্ধ রাখা হয়। নতুন শিল্পে গ্যাস সংযোগ বন্ধ। আবার সরকারের দায়িত্বশীল মন্ত্রীরা বলছেন, বাসাবাড়িতে আর গ্যাস সংযোগ দেয়া হবে না। একটা হ-য-র-ল অবস্থা। সরকার ২০০৯ সালের ৩১ জুলাই থেকে শিল্প খাতে নতুন সংযোগ দেওয়া বন্ধ রেখেছে।

তবে সিলেট অঞ্চল এ নিষেধাজ্ঞার বাইরে রাখা হয়েছিল। কারণ হিসেবে জ্বালানি মন্ত্রণালয় বলেছিল, অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতায় সিলেটের ক্ষেত্রগুলো থেকে তোলা সব গ্যাস দেশের অন্যত্র সঞ্চালন করা যাচ্ছে না। তাই উদ্বৃত্ত গ্যাস ব্যবহারের জন্য সিলেট অঞ্চলে নতুন সংযোগ বন্ধ করা হয়নি। গত ছয় বছরেও অবকাঠামোর সেই সীমাবদ্ধতা কাটেনি। আবার অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বাজেটপূর্ব এক আলোচনায় অর্থনীতিবিদ ও শিল্পপতিদের বলেছিলেন, ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেটে বিধান রাখা হবে নতুন শিল্পকারখানার জন্য ২ শতাংশ গ্যাস মজুত রাখার। বিনিয়োগ বোর্ডের মাধ্যমে এই গ্যাস পাবে সেসব শিল্প।

কিন্তু বাজেটে তেমন কিছু উল্লেখ করা হয়নি। শিল্পে গ্যাস ব্যবহারেই মূল্য সংযোজন হয় সবচেয়ে বেশি। তবু এই খাতে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় সংযোগ বন্ধ রাখায় সংশ্লিষ্ট গ্রাহকেরা হতাশ। এই খাতে ২০১০ সালের ১৩ জুলাই নতুন সংযোগ বন্ধ করা হয়। ২০১৩ সালের ৭ মে আবার তা চালু করার মধ্যবর্তী সময়ে ব্যাপক দুর্নীতির মাধ্যমে প্রায় এক লাখ অবৈধ সংযোগ দেওয়া হয়। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবাসিকে সংযোগ বন্ধের নির্দেশনা দেন। এরপর প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ একাধিক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের বলেন, আবাসিক সংযোগ বন্ধ করা হবে। বিকল্প হিসেবে এলপি গ্যাস সহজলভ্য করা হবে। যাক সেসব কথা। গ্যাস সংকট অদুর ভবিষতে আরো বাড়বে, এটা পরিষ্কার। আর সংকট বাড়া মানেই গোটা আর্থ-সামাজিক খাতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়া। দেশের অর্থনীতিতে স্থবিরতা বিরাজ করা।

পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন